মুহাম্মদ শাহ আলম : গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন চড়াইউতরাইয়ের মধ্য দিয়ে তিন মাস অতিবাহিত হতে চলছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়েই নানাবিধ চ্যালেঞ্জে পড়েছে। বিশেষ করে দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ, প্রশাসন থেকে পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের চিহ্নিত করে অপসারণ একই সাথে যোগ্য ও বঞ্চিতদের পদায়ন, গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা, নিহতের তালিকা প্রস্তুত করে তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো, সর্বক্ষেত্রে বৈষম্যের লাগাম টেনে ধরা, দুর্নীতি-লুটপাট ও অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে ব্যাংক-বীমা তথা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখা, গুম-খুনের সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা সর্বোপরি আইন-বিচার ও শাসন বিভাগের প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন, বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করে একটি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। এসব ক্ষেত্রে দেশবাসী ‘ড্রাস্টিক অ্যাকশন’ ও ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি প্রত্যাশা করে আসছে।
বাস্তবতা হচ্ছে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে পতিত স্বৈরাচারের ১৫ বছরের জঞ্জাল পরিষ্কার করে রাষ্ট্র মেরামতের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ দুই-চার মাস কিংবা এক বছর যথেষ্ট সময় না। কিন্তু নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বয়স তিন মাস অতিবাহিত হতে না হতেই আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা এবং তার দেশী-বিদেশী দোসররা অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই হুঙ্কার দেয়া শুরু করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।
পলাতক শেখ হাসিনা ভারতের মাটিতে অবস্থান করে ফোনে বর্তমান সরকার ও গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া ছাত্র-জনতা এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দেখে নেয়ার হুমকি দিচ্ছেন। সর্বশেষ গত ২৮ অক্টোবর শেখ হাসিনার কণ্ঠের মতো একজনের ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের এক নেতাকে বলতে শোনা যায়, ‘তোমাদের বাড়িঘরে যারা আগুন লাগিয়েছে, তাদের বাড়ি ঘর নেই? সব কথা কি বলে দিতে হয়? সব কিছু কি প্রকাশ্যে করতে হয়?’ এ সময় শেখ হাসিনাকে আরো বলতে শোনা যায়, ‘আর মামলা, আমার তো শুধু গোবিন্দগঞ্জ না, আমার তো সারা বাংলাদেশে ২২৭টি মার্ডার কেস। আমি বলছি সবাই তালিকা করো। তোমরাও তালিকা করো। ২২৭ জনকে মার্ডারের লাইসেন্স পেয়ে গেছি। এক মামলায় যে শাস্তি, সোয়া ২০০ মামলায়ও সেই শাস্তি। তাই না? ঠিক আছে সেই শাস্তি নেবো। তার আগে সোয়া ২০০ হিসাব করে নেবো। এটা যেন মাথায় থাকে। তার এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে গৃহযুদ্ধের সুস্পষ্ট উসকানি বিদ্যমান।
শেখ হাসিনার বিভিন্ন হুঙ্কারের কারণে সিভিল প্রশাসনে কর্মরত তার এক দোসর লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাবাসসুম ঊর্মি নিজের ফেসবুকে লিখেন, সাংবিধানিক ভিত্তিহীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, রিসেট বাটনে পুশ করা হয়েছে। অতীত মুছে গেছে। রিসেট বাটনে ক্লিক করে দেশের সব অতীত ইতিহাস মুছে ফেলেছেন তিনি। এতই সহজ। কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে আপনার, মহাশয়। এর আগে তিনি ফেসবুক পোস্টে আবু সাঈদকে ‘সন্ত্রাসী’ বলে উল্লেখ করেন এবং গণ-অভ্যুত্থান নিয়েও বিরূপ মন্তব্য করেন।
একটি রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করার দুঃসাহসিক হিম্মত কোত্থেকে আসে? তাবাসসুমরা আবু সাঈদের শাহাদত ও আত্মত্যাগকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বলে মূলত জুলাই আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। পক্ষান্তরে পুলিশ এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগ একাকার হয়ে গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালিয়ে হত্যার যে উন্মত্ততা প্রকাশ করেছে তার এক ধরনের বৈধতা দেয়ার অপচেষ্টা করেছে।
গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ এক হাজার ৫৮১ জন এবং আহত ২২ হাজার ৯০৭ জনের আত্মত্যাগ তাবাসসুমদের কাছে এক ধরনের পরিহাস। অথচ এই গণ-আন্দোলনে অংশ নিয়ে ৪০০ জন চোখ হারিয়েছেন। এর মধ্যে দুই চোখ হারিয়েছেন ২০০ জন, অনেকে চিরদিনের মতো পঙ্গুত্ববরণ করেছে।
গত ২৫ অক্টোবর সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সংগঠন বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চের ব্যানারে আট দফা দাবিতে চট্টগ্রামে গণসমাবেশ করেছে। সমাবেশ থেকে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চের ঘোষণা দিয়েছে সংগঠনটি।
সমাবেশে বক্তারা সংখ্যালঘুদের ওপর কথিত নির্যাতনের অভিযোগ তুলে সংখ্যানুপাতিক হারে হিন্দুদের সংসদে আসন বিন্যাস করার দাবি করে প্রয়োজনে ভোট বর্জন হুমকি দিয়েছেন। একই সাথে সংখ্যালঘু-বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠনসহ আট দফা দাবি তুলেছেন।
বস্তুত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী দোসরদের দ্বারা নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হলেও হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে মাঠপর্যায়ে বড় ধরনের কোনো আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করেননি। মানবাধিকার সংস্থা ‘আইন ও সালিশকেন্দ্র’-এর ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৩ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে হিন্দুদের ওপর তিন হাজার ৬৭৯টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। জানুয়ারি ২০১৩ থেকে জুন ২০২৪ পর্যন্ত সংগঠনটি সংখ্যালঘুদের মন্দির ও মূর্তির ওপর এক হাজার ৮৭৯টি আক্রমণ এবং দুই হাজার ১৯০টি হামলার মামলা নথিভুক্ত করেছে।
কুমিল্লায় মন্দিরে মূর্তির সামনে কুরআন রাখা এবং রংপুরের পীরগঞ্জে হিন্দুপাড়ায় আগুনের অভিযোগে পিটিয়ে মানুষ হত্যা ইত্যাদি নানাবিধ ঘটনাবলি একই সাথে বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার হলেও তখন ইসকনসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা ছিলেন নির্লিপ্ত। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে যাই করুক না কেন, সব কিছু উপেক্ষা করে থাকে। যখনই বাংলাদেশের ভিন্ন কোনো দল বা শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে তখনই সংখ্যালঘু নির্যাতন ইস্যু হিসেবে আবির্ভূত হয়।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন রাষ্ট্র মেরামতের মাধ্যমে দেশকে গণতান্ত্রিক কাঠামোয় এনে একটি অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ উন্মুক্ত করার চেষ্টা করছেন সেই সময় মতলববাজ গোষ্ঠী সংখ্যালঘু কার্ড নিয়ে মাঠে নেমেছে। প্রতিবেশী একটি দেশের ইন্ধনে সংখ্যালঘুর ব্যানারে পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের সহযোগিতায় শুরুতে শাহবাগ ও পরে চট্টগ্রামে সমাবেশের নামে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির প্রয়াস চালাচ্ছে।
পতিত স্বৈরাচারের দোসররা তাদের লুটপাটের হারানো সাম্রাজ্য ফিরে পেতে তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যবহার করে গুজব ছড়ানোর কারখানা খুলে বসেছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের দলীয় ফেসবুক পেজ থেকেও গুজব ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছে। ফেসবুকে ভুয়া আইডি খুলে ব্যাপকভাবে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়- সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর, হামলা, হত্যা, ধর্ষণ করা হচ্ছে নির্বিচারে। এই গুজব ছড়িয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আন্দোলনে নামতে উৎসাহিত করে। শেখ হাসিনা ও তার দোসররা হয়তো স্বপ্ন দেখছে ফিলিপাইনের কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিবাজ শাসক ফার্দিনান্দ মার্কোস পরিবার কিংবা হাইতির স্বৈরশাসক জাঁ ব্রার্ট্রান্ড আরিস্টিডওর মতো দেশে ফিরে আবার মসনদে বসার মতো ঘটনা বাংলাদেশও ঘটবে।
দেশ-বিদেশে এসব প্রচারণার মধ্য দিয়ে বিগত সরকারের সেবাদাসেরা জনমনে এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টির প্রয়াস চালাচ্ছে, যদি শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসে তবে দেশের পরিস্থিতি কী হবে। এই প্রচারণার প্রধান লক্ষ্য গণ-অভ্যুত্থান এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাথে সংশ্লিষ্টদের মনোবল ভেঙে দেয়া, প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা।
বস্তুত শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে সিভিল প্রশাসন থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিচার বিভাগ- সর্বত্র তার পছন্দের দলান্ধ লোকজনকে নিয়োগ, পদোন্নতি দিয়ে প্রশাসন সাজিয়েছে। ফলে এখনো প্রশাসনের পরতে পরতে রয়ে গেছে তার অনুগত আমলা, পুলিশ। দিল্লিতে বসে এখনো শেখ হাসিনা কলকাঠি নাড়ছেন আর প্রশাসনে কর্মরত তার অনুসারী কাজ করছেন।
শুধু তাই নয়, আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে দু’-একজন উপদেষ্টা, বিশেষ উপদেষ্টাদের বিগত দিনের ভ‚মিকা নিয়েও। অভিযোগ উঠেছে, যারা বিগত সরকারের সময়ে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত হয়েছে তাদের বদলে নিজেদের অনুসারীদের প্রমোশন দিচ্ছেন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে চুক্তিতে নিয়োগ দিচ্ছেন।
ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের অর্জন ব্যর্থ করতে দেশী-বিদেশী চক্র বিশেষ করে বৃহৎ প্রতিবেশী দেশটি এখনো পতিত স্বৈরাচার হাসিনাকে ফের ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার নানা ফন্দিফিকিরে ব্যস্ত। এ ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা হাসিনার দোসরদের কাজে লাগিয়ে ফায়দা হাসিলের ষড়যন্ত্র করছে।
সার্বিক পরিস্থিতিতে বলা যায়, রাষ্ট্র মেরামতের জন্য সংস্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, অপরিহার্য এবং অত্যাবশ্যক ইস্যু। চলমান সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে সরকারের স্থিতিশীলতা অত্যাবশ্যক। আর এই কারণে প্রশাসন থেকে পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের অতি দ্রুত অপসারণ জরুরি। দেশের মানুষের স্বস্তির জন্য দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করে সহনীয় পর্যায়ের নিয়ে আসার কাজটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সম্পন্ন করতে হবে।
লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।