অনেক দূর থেকে আমরা যদি ক্রমে একটা পরমাণুর দিকে এগিয়ে যেতে পারতাম, তাহলে প্রথম দর্শনেই পরমাণুটিকে বৈদ্যুতিকভাবে চার্জিত অতি ক্ষুদ্র কণাদের জঙ্গল হিসেবে দেখতে পেতাম। এগুলোই ইলেকট্রন। এই কণাকে প্রকৃতির বর্ণমালার অন্যতম মৌলিক অক্ষর বলে মনে করা হয়। ইলেকট্রনের গহীনে যদি আরও কোনো মৌলিক কণা লুকিয়ে থাকে, তাহলে আমরা এখনও তাদের কোনো ইঙ্গিত পাইনি। প্রতিটি ইলেকট্রনই আকার, আকৃতি, ভর এবং চার্জের দিক থেকে হুবহু একই রকম।
এদের বৈদ্যুতিক চার্জ মাপা হয় কুলম্ব একক ব্যবহার করে। একে প্রকাশ করা হয় ইংরেজি বড় হাতের সি (C) দিয়ে। একটা ইলেকট্রনের চার্জের পরিমাণ নগণ্য। মাত্র এক মাইক্রো কুলম্ব চার্জের জন্য মোট ৬ ট্রিলিয়ন বা ৬০ হাজার কোটি ইলেকট্রন একসঙ্গে জড়ো করতে হবে। বলে রাখা ভালো, এক মাইক্রো কুলম্ব মানে এক কুলম্বের দশ লাখ ভাগের এক ভাগ মাত্র। বুঝতেই পারছেন, একটা ইলেকট্রনের চার্জ কত সামান্য।
তবে সামান্য ধূলিকণাতেও যে পরিমাণ পরমাণু আছে, তা আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে থাকা নক্ষত্রের চেয়ে বেশি। আর (হাইড্রোজেন ছাড়া) প্রতিটি পরমাণুতেই আছে একাধিক ইলেকট্রন। তাই একটা ইলেকট্রনের চার্জ নগণ্য হলেও এই ধূলিকণার পরমাণুতে ইলেকট্রনের সংখ্যা অগণিত। আর তার ফলাফল মারাত্মক। হয়তো ভাবছেন, কতটা মারাত্মক?
উদাহরণ দেওয়া যাক। আপনি প্রতিবার শ্বাসের সঙ্গে বুক ভরে অক্সিজেন নিচ্ছেন। বলা ভালো, ফুসফুসে ভরে নিচ্ছেন। তবে একটা-দুটো অক্সিজেন নয়, প্রায় ১০ বিলিয়ন ট্রিলিয়ন অক্সিজেন পরমাণু প্রতিবার আপনার ফুসফুসে ঢুকে পড়ছে। প্রতিটি অক্সিজেন পরমাণুতেই বেশ কটি ঋণাত্মক চার্জের ইলেকট্রন থাকে।
সব কটি ইলেকট্রনের চার্জ হিসেব করলে, এর মধ্যে রয়েছে প্রায় ১৫ হাজার কুলম্ব বৈদ্যুতিক চার্জ। সেটা ১০০০টি বজ্রপাতের ঝলকের সমান। কিন্তু সেটা ঘটছে আপনার অজান্তেই। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, বিপুল পরিমাণ বৈদ্যুতিক চার্জ বুকের ভেতর টেনে নিয়েও কোনো বৈদ্যুতিক শক অনুভব করছেন না আপনি। শ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে ঢোকা ইলেকট্রনগুলো যদি বৈদ্যুতিক প্রবাহ তৈরি করত, তাহলে তার পরিমাণ দাঁড়াত ৩ হাজার অ্যাম্পিয়ার (এক অ্যাম্পিয়ার হলো এক সেকেন্ডে এক কুলম্ব চার্জের প্রবাহ)।
আপনাকে মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট। কী আশ্চর্য! তবু আমরা বহাল তবিয়তে বেঁচে আছি। কিন্তু কোনো কারণে আমাদের গভীরের এই বিদ্যুৎ নিজ রূপে প্রকাশিত হতে পারছে না। কেন হচ্ছে না, সেটাও আপাতদৃষ্টিতে একটা রহস্য বা প্যারাডক্স বলে মনে হতে পারে।
ইলেকট্রনকে পরমাণুর সাধারণ একটা কণা বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এই কণাটাই আসলে আমাদের আধুনিক বিশ্বের জন্য অতি জরুরি। কারণ, মৌলিক এই কণাটি বৈদ্যুতিক চার্জের বাহক। আপনি যখন নিজের ল্যাপটপ, ফোন বা ব্যাটারি চালিত ইলেকট্রিক কার বা গাড়ি চার্জ দেন, তখন আসলে অসংখ্য ইলেকট্রন সংরক্ষণ করে রাখছেন ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য।
আগেই বলেছি, বিদ্যুৎ বা বৈদ্যুতিক প্রবাহ হলো ইলেকট্রনের প্রবাহ। এই প্রবাহ হতে পারে কম্পিউটার চিপের মধ্যে কিংবা আপনার মস্তিষ্কের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের তন্তুগুলোর মধ্যে, যার মাধ্যমে মস্তিষ্ক থেকে দেহের বিভিন্ন অঙ্গে নির্দেশ ছড়িয়ে পড়ে। আবার মেট্রোরেল বা ইলেকট্রিক ট্রেনের ওপরের তারের মাধ্যমেও এ প্রবাহ হতে পারে, যা রেলকে শক্তি যোগায়। আমাদের বিদ্যুৎ চালিত আধুনিক শিল্পকারখানার কথা আর নাই-বা বললাম। বুঝতেই পারছেন, আধুনিক প্রযুক্তির বেশির ভাগ আসলে ইলেকট্রনের চলাচলের কারণে সচল থাকে।
আগেই এক অ্যাম্পিয়ারের সংজ্ঞা দিয়েছি। অনেকে জানতে চাইতে পারেন, এক সেকেন্ডে কত কুলম্ব চার্জ প্রবাহিত হয়? কিংবা এর জন্য কতটি ইলেকট্রনের প্রবাহের প্রয়োজন? এর উত্তর হলো, আপনার একটি হৃদস্পন্দনের সময়কালে একক একটি বিন্দুর ভেতর দিয়ে ঘটে চলেছে ৬.২৪ বিলিয়ন বিলিয়ন ইলেকট্রনের প্রবাহ।
কাজেই এই বিপুল পরিমাণ ইলেকট্রনের চলাচলের কারণে সামান্য পরিমাণ বিদ্যুৎ প্রবাহও আমাদের জন্য ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। মনে রাখবেন, মাত্র ১০ মিলিঅ্যাম্প (এক অ্যাম্পিয়ারের এক হাজার ভাগের এক ভাগ) বিদ্যুৎ প্রবাহেও আপনার বেদনাদায়ক শক অনুভূত হবে। আর ১০০ থেকে ২০০ মিলিঅ্যাম্প প্রবাহ হবে মারাত্মক।
১০ মিলিঅ্যাম্প বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছে, এমন একটা বৈদ্যুতিক তার স্পর্শ করলে আপনার মাংসপেশি এত শক্তিশালীভাবে কুঁচকে যেতে পারে যে ওই তার থেকে দূরে সরে যাওয়ার শক্তিও পাবেন না। ফুসফুসও নিয়ন্ত্রণ করে যে পেশি, তাকেও এই বিদ্যুৎ প্রবাহ প্রভাবিত করবে। ফলে অচিরেই থেমে যাবে শ্বাসপ্রশ্বাস।
আর ১০০ মিলিঅ্যাম্প বিদ্যুৎপ্রবাহে হৃৎপিণ্ডের পেশি প্রভাবিত হয়ে কাজকারবার বন্ধ হয়ে যাবে। তা মৃত্যুর ঝুঁকির দিকে নিয়ে যাবে আপনাকে। ২০০ মিলিঅ্যাম্পের বেশি বিদ্যুৎপ্রবাহে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা আছে। তবে হৃৎপেশিগুলো আটকে যাওয়ার কারণে ভেন্ট্রিকুলার ফিব্রিলেশন বাধা পাবে। সেই সঙ্গে অনুভূত হবে ভয়াবহ জ্বলুনি। মুহূর্তের মধ্যে আপনার দেহটা ভাজা ভাজা হয়ে যাবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।