জুমবাংলা ডেস্ক : বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের (বাপশক) সাম্প্রতিক সংকট শুধু একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অসুবিধার প্রতিফলন নয়, বরং এটি দেশের বিজ্ঞান গবেষণা ও পরমাণু শক্তি পরিচালনার ভবিষ্যতের ওপর একটি গুরুতর প্রশ্নচিহ্ন রেখে যাচ্ছে। কমিশনের প্রায় ৬০০ জন বিজ্ঞানী এবং ২৫০০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী গত দুই মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না। এই ঘটনাটি শুধু মানবিক সংকট নয়, বরং এর মাধ্যমে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল খাতের কাঠামোগত দুর্বলতা ও নীতিগত জটিলতাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পরমাণু শক্তি কমিশন একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, যেটি দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে পরমাণু প্রযুক্তি, গবেষণা, চিকিৎসা ও শিল্পে বিশেষায়িত সেবা প্রদান করে আসছে।
Table of Contents
পরমাণু শক্তি কমিশন: নেতৃত্বহীনতা ও আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপে সংকট
বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের বর্তমান পরিস্থিতি গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কমিশনের শীর্ষপদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য থাকায় সুশাসনের অভাব স্পষ্ট। একটি স্বাধীন ও পেশাদার কমিটি থাকার কথা থাকলেও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অযাচিত হস্তক্ষেপ এবং কর্তৃত্ববাদী আচরণ কমিশনের কার্যক্রমে গুরুতর প্রভাব ফেলছে।
ড. এএমএস সাইফুল্লাহ, বাংলাদেশ পরমাণু বিজ্ঞানী সংঘের সভাপতি, সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “বিজ্ঞানীদের বিদেশে প্রশিক্ষণ গ্রহণে বাধা দেয়া হচ্ছে, যদিও তাদের পূর্ণ স্কলারশিপ রয়েছে।” এটি গবেষণা উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক দক্ষতা অর্জনের প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন সৃষ্টি করছে।
এই পরিস্থিতির একটি বড় উদাহরণ হচ্ছে ভারতীয় একটি প্রতিষ্ঠানের তৈরি সফটওয়্যারের মাধ্যমে বেতন-ভাতা প্রদানের প্রক্রিয়া। বিজ্ঞানীরা অভিযোগ করেছেন, এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে সমস্ত ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক তথ্য বিদেশে নিয়ন্ত্রিত হয়, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং কমিশনের ভূমিকা
বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পাবনা জেলার রূপপুরে নির্মিত হচ্ছে। এটি ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি ইউনিট নিয়ে গঠিত এবং এর সরবরাহকারী রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান ঔঝঈ অঃড়সংঃৎড়ুবীঢ়ড়ৎঃ। ২০১৫ সালে চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে চলেছে। এই প্রকল্পে কমিশনের বিজ্ঞানীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
আইন অনুযায়ী, এই প্রকল্পের তত্ত্বাবধান ও পরিচালনার দায়িত্ব মূলত বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের, যদিও একটি আলাদা কোম্পানি, রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (NPCBL), প্রশাসনিক দায়িত্বে রয়েছে। কিন্তু, কমিশনকে বাদ দিয়ে পিডিবি এবং NPCBL-এর মধ্যে বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তির চেষ্টা কমিশনের স্বায়ত্তশাসন ও কার্যক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
এই ঘটনার ফলে কমিশনের অভ্যন্তরীণ কাঠামো ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (IAEA) নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক পদক্ষেপ কমিশনের ভবিষ্যৎ কৌশলগত অংশীদারিত্ব ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
কমিশনের ভবিষ্যৎ: স্বায়ত্তশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও গোপনীয়তা রক্ষা
গবেষণায় স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা
বিজ্ঞান গবেষণায় স্বাধীনতা একটি অপরিহার্য শর্ত। পরমাণু শক্তি একটি বিশেষায়িত ক্ষেত্র যেখানে প্রযুক্তিগত দক্ষতা, গোপনীয়তা এবং আন্তর্জাতিক সমন্বয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সফটওয়্যার-নির্ভর ব্যবস্থার মাধ্যমে বিদেশি নিয়ন্ত্রণে থাকা তথ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি করছে, যা বিজ্ঞানীদের জন্য শুধু হতাশাজনক নয় বরং দেশের নিরাপত্তার জন্যও হুমকিস্বরূপ।
সংশ্লিষ্ট দপ্তরের আয়-ব্যয়ের হিসাব, বিজ্ঞানীদের পরিবারিক তথ্য এবং বৈদেশিক চুক্তির বিবরণ এক সফটওয়্যারে যুক্ত করে তা চেন্নাইয়ের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করায় কমিশনের তথ্য স্বাধীনতা এবং গবেষণা স্বায়ত্তশাসন পুরোপুরি বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
নীতিগত সুসংহত সিদ্ধান্তের প্রয়োজনীয়তা
সামগ্রিকভাবে, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের এই সংকটের পেছনে রয়েছে একটি গভীর কাঠামোগত সমস্যা। বেতন বন্ধ করা, গবেষণার সুযোগ সীমিত করা, আন্তর্জাতিক সংস্থার নির্দেশনা উপেক্ষা করা – এসব কিছুই প্রতিষ্ঠানটির সামগ্রিক সক্ষমতা, মনোবল এবং দক্ষতা কমিয়ে দিচ্ছে।
অতএব, এখনই প্রয়োজন একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে কমিশনের স্বাধীনতা, গবেষণার স্বচ্ছতা এবং কর্মীদের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার জন্য সুস্পষ্ট নীতিগত পদক্ষেপ।
বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন যেন ভবিষ্যতে একটি স্বাধীন, স্বচ্ছ এবং প্রযুক্তিগতভাবে সক্ষম প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠে, সেই লক্ষ্যে সরকার, সংশ্লিষ্ট দপ্তর এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা সমন্বিত পদক্ষেপ নেবে — এটাই জাতির প্রত্যাশা।
🤔 FAQs Section
- বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের বর্তমান সংকটের মূল কারণ কী?
প্রধানত বেতন বন্ধ এবং প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ, যা কমিশনের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করছে। - কেন কমিশনের বিজ্ঞানীদের বিদেশে পাঠানো হচ্ছে না?
যদিও তাদের স্কলারশিপ রয়েছে, তবুও প্রশাসনিক জটিলতা এবং অনুমোদনের অভাবে তারা বিদেশে উচ্চশিক্ষা বা প্রশিক্ষণে যেতে পারছেন না। - বিদ্যুৎ চুক্তি কাদের সঙ্গে হওয়ার কথা?
আইন অনুযায়ী কমিশনের মাধ্যমে হওয়ার কথা থাকলেও, বর্তমানে পিডিবি ও এনপিসিবিএল-এর মধ্যে চুক্তির প্রচেষ্টা চলছে। - ভারতীয় সফটওয়্যার নিয়ে বিজ্ঞানীদের আপত্তি কেন?
এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে তথ্য নিয়ন্ত্রণ হওয়ায় গোপনীয়তা এবং গবেষণার স্বায়ত্তশাসন হুমকির মুখে পড়ছে। - রূপপুর প্রকল্পে কমিশনের ভূমিকা কী?
কমিশন মূল তত্ত্বাবধানে থাকলেও প্রশাসনিকভাবে NPCBL পরিচালনা করছে, যা দ্বৈত শাসন তৈরি করছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।