গাজীপুরের এক ছোট্ট কাঁচা ঘরে বসে রিকশাচালক রফিকুল ইসলামের চোখে যখন ক্লান্তির ছাপ, তখনও তার হাতে এক টুকরো মিষ্টি জড়ানো থাকে। শহরের অপর প্রান্তে গুলশানের হাইরাইজ ফ্ল্যাটে বসে কর্পোরেট এক্সিকিউটিভ তানজিনা হকের মোবাইলে এলার্ম বাজে – “আব্বুর ফিজিওথেরাপি সেশন”। ভৌগলিক দূরত্ব, আর্থিক বৈষম্য, পেশাগত জটিলতা – সবকিছুকে অতিক্রম করে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে এক অদৃশ্য সূত্রে বাঁধা একটি শব্দ: পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ। এই অনুভূতি কেবল আবেগ নয়, আমাদের সমাজের DNA-তে বোনা সেই মৌলিক ভিত্তি যা ব্যক্তিকে মানুষে পরিণত করে, সমাজকে ধারণ করে, সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখে।
Table of Contents
পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ: শিকড় থেকে শিখরে উঠার সোপান
বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে এক সময় “যৌথ পরিবার” শব্দটি শুধু কাঠামো নয়, ছিল দায়িত্ববোধের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। গবেষণা দেখায়, ১৯৮৫ সালে দেশের ৮০% পরিবার ছিল যৌথ কাঠামোর। আজ তা কমে ৪০%-এ নেমেছে (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, ২০২৩)। কিন্তু এই পরিবর্তন পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ-এর মৌলিকত্বকে মুছে ফেলতে পারেনি, বরং নতুন রূপ দিয়েছে। নোয়াখালীর বাসিন্দা মোহাম্মদ আলীর কথা ভাবুন, যিনি মালয়েশিয়ায় নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেও প্রতিদিন ভিডিও কলের মাধ্যমে মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানদের খোঁজ নেন। তার বেতনের ৭০% নিয়মিত বাড়িতে পাঠানো শুধু আর্থিক দায়িত্ব নয়, মানসিক বন্ধনের প্রকাশ।
বাংলাদেশি সমাজে এই দায়িত্ববোধের স্তম্ভগুলি হল:
- অর্থনৈতিক নিরাপত্তা: পরিবারের সদস্যদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও শিক্ষার ব্যবস্থা করা
- মানসিক অবলম্বন: সংকটে পারিবারিক সমর্থনের নেটওয়ার্ক তৈরি করা
- সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা: মূল্যবোধ, রীতিনীতি ও বিশ্বাসের উত্তরাধিকার রক্ষা করা
- সামাজিক মর্যাদা: পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে সদস্যদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ
মনোবিজ্ঞানী ড. ফারহানা মান্নানের মতে: “পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ মানব বিকাশের প্রাথমিক পাঠ। এটি অর্জনের মাধ্যমে শিশু শেখে সমাজে তার ভূমিকা, যা পরবর্তীতে নাগরিক দায়িত্ববোধে রূপ নেয়। এই শিক্ষা না পেলে ব্যক্তিত্বে তৈরি হয় নৈরাজ্যিক শূন্যতা।
আধুনিকতার সংঘাতে দায়িত্ববোধ: ভাঙন ও জোড়ার গল্প
ঢাকা শহরে প্রতি বছর ৫ লক্ষ মানুষ গ্রাম থেকে পাড়ি জমায় জীবিকার সন্ধানে (জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা প্রতিষ্ঠান)। এই অভিবাসনের নির্মম পরিণতি: প্রবীণ পিতামাতার একাকিত্ব, ‘পরিত্যক্ত স্ত্রী’দের যন্ত্রণা, এবং পিতৃমাতৃহীন শিশুদের মানসিক সংকট। কুমিল্লার এক প্রত্যন্ত গ্রামে বসবাসকারী ৭২ বছরের রহিমা বেগমের চোখে জল যখন তিনি বলেন, “তিন ছেলে তিন দেশে, ফোন করে মাসে একবার। হাত ধরে হাঁটতে পারতাম যদি…
যেসব চ্যালেঞ্জ দায়িত্ববোধকে প্রভাবিত করছে:
- নগরায়ণের চাপ: ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতা ও সময়ের অভাব
- নারীর কর্মসংস্থান: দ্বিগুণ দায়িত্ব (পেশা ও পরিবার)ের বোঝা
- ডিজিটাল বিচ্ছিন্নতা: প্রযুক্তি যোগাযোগ বাড়ালেও মানবিক স্পর্শ কমিয়েছে
- পুঁজিবাদী মূল্যবোধ: ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রবণতা
তবুও আশার আলো দেখায় রাজশাহীর তরুণ উদ্যোক্তা আরিফুল ইসলাম, যিনি অনলাইন ব্যবসার মাধ্যমে গ্রামের বাড়িতে বসেই কর্মসংস্থান তৈরি করেছেন ৩০ জনের জন্য, যাতে পরিবার ছেড়ে শহরে যেতে না হয়। অথবা সিলেটের নাজমা আক্তার, যিনি অসুস্থ শ্বশুর-শাশুড়ির সেবায় সরকারি চাকরি ছেড়ে হোম-বেজড ফ্রিল্যান্সিং বেছে নিয়েছেন।
দায়িত্ববোধের বহুমাত্রিক রূপ: সম্পর্কভেদে ভিন্নতা
পিতামাতার প্রতি দায়িত্ব: ঋণের স্বীকৃতি
বাংলাদেশের সাংবিধানিক অনুচ্ছেদ ১৫(ক) বয়স্ক ভরণপোষণের অধিকার স্বীকৃত করে। কিন্তু আইনের চেয়ে গভীর আমাদের সাংস্কৃতিক প্রেরণা – “মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত”। ময়মনসিংহের কৃষক জামাল উদ্দিনের দৃষ্টান্ত: তিনি ডায়াবেটিক মাকে নিয়ে শহরের হাসপাতালে থাকাকালীন নিজের জমি বিক্রি করে চিকিৎসা করান। তার কথায়, “মা তো শুধু মা নন, আমার প্রথম ইবাদতের স্থান।”
সন্তানের প্রতি দায়িত্ব: ভবিষ্যৎ গড়ার শপথ
পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ-এর সবচেয়ে স্পষ্ট প্রকাশ সন্তান লালন-পালনে। বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হার ৯৮% ছাড়ালেও (UNICEF, ২০২৪) মানসম্মত শিক্ষা, পুষ্টি ও মানসিক বিকাশে এখনো চ্যালেঞ্জ। ঢাকার গুলশানে এক বেসরকারি স্কুলের বার্ষিক বেতন যেখানে ২ লক্ষ টাকা, সেখানে নারায়ণগঞ্জের কামরাঙ্গীরচরে বস্তিবাসী রোজিনা বেগম তার দিনমজুরির অর্ধেক ব্যয় করেন সন্তানের প্রাইভেট টিউশন ফিতে।
শিশু বিকাশ বিশেষজ্ঞ ড. তাসনিম জাহারের পর্যবেক্ষণ: “সন্তানের প্রতি দায়িত্ব শুধু আর্থিক নয়, সময় দেওয়া ও মানসিক উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ। যে শিশু পিতামাতার অবহেলা অনুভব করে, তার মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
জীবনসঙ্গীর প্রতি দায়িত্ব: সমঝোতার মহাসেতু
বিয়েবন্ধনে দায়িত্ববোধের সবচেয়ে পরীক্ষিত রূপ। বাংলাদেশ দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের সমীক্ষায় দেখা গেছে, বন্যা বা সাইক্লোনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর ৮৭% নারী প্রথমে সন্তান ও স্বামীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন, নিজের কথা পরে ভাবেন। দায়িত্ব এখানে একতরফা নয় – নারীর অর্থনৈতিক অবদান স্বীকৃতির পাশাপাশি পুরুষের গৃহস্থালি কাজ ও সন্তান লালনে অংশগ্রহণ এখন সামাজিক আলোচনায়।
দায়িত্ববোধ রক্ষার কৌশল: ভারসাম্যের শিল্প
পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ-কে টেকসই করতে প্রয়োজন সচেতন কৌশল:
- অগ্রাধিকার নির্ধারণ: জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে পার্থক্য করুন। অসুস্থ মায়ের ওষুধ কেনা জরুরি, অফিসের অতিরিক্ত ওভারটাইম নয়।
- সময় ব্যবস্থাপনা: পারিবারিক সময়কে ডায়েরিতে ‘অপরিহার্য মিটিং’ হিসেবে ব্লক করুন। সপ্তাহে অন্তত একবেলা একসাথে খাওয়া অলঙ্ঘনীয় রাখুন।
- ভালোবাসার ভাষা চেনা: গ্যারি চ্যাপম্যানের “Five Love Languages” ধারণা বাংলাদেশি প্রেক্ষাপটে প্রয়োগ করুন – কারো জন্য সময় দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ, কারো জন্য উপহার বা সেবা।
- সীমানা নির্ধারণ: বিষাক্ত সম্পর্ক বা অবাস্তব প্রত্যাশা থেকে আত্মরক্ষা করুন। দায়িত্ববোধ মানে আত্মবিলোপ নয়।
- প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার: হোয়াটসঅ্যাপ ফ্যামিলি গ্রুপ, রেমিট্যান্স অ্যাপ, ভিডিও কল – দূরত্ব মোকাবিলায় ডিজিটাল সরঞ্জাম কাজে লাগান।
জেনে রাখুন
পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ বলতে কী বোঝায়?
এটি পরিবারের সদস্যদের শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক কল্যাণ নিশ্চিত করার নৈতিক বাধ্যবাধকতা। বাংলাদেশি প্রেক্ষাপটে এতে পিতামাতার সেবা, সন্তানের ভরণপোষণ, জীবনসঙ্গীর প্রতি সম্মান এবং আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর নেওয়া অন্তর্ভুক্ত।
আধুনিক জীবনে পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ বজায় রাখা কঠিন কেন?
নগরায়ণ, কর্মব্যস্ততা, যৌথ পরিবার ব্যবস্থার ভাঙন এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবনধারার কারণে পারিবারিক বন্ধনে ফাটল দেখা দিচ্ছে। এছাড়া অর্থনৈতিক চাপ অনেককে বিদেশে পাড়ি জমাতে বাধ্য করছে, ফলে দায়িত্ব পালনে ভৌগলিক বাধা সৃষ্টি হচ্ছে।
ইসলামে পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ সম্পর্কে কী বলা হয়েছে?
কুরআনের সূরা বাকারাহ (আয়াত ২১৫) ও সূরা ইসরা (আয়াত ২৩-২৪)-এ পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হাদিসে রাসূল (সা.) বলেছেন, “সর্বোত্তম দীনার হলো যা মানুষ নিজ পরিবারের জন্য ব্যয় করে।”
দায়িত্ববোধ ও অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণের মধ্যে পার্থক্য কী?
দায়িত্ববোধে রয়েছে সদস্যদের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রতি সম্মান। অন্যদিকে, অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তির সিদ্ধান্তগ্রহণের স্বাধীনতা হরণ করা হয়, যা সুস্থ সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর। ভারসাম্য রক্ষা জরুরি।
পরিবারের দায়িত্ব ও ব্যক্তিগত লক্ষ্যের মধ্যে সমন্বয় কীভাবে সম্ভব?
স্পষ্ট যোগাযোগের মাধ্যমে পারস্পরিক প্রত্যাশা নির্ণয় করুন। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় পরিবারকে অন্তর্ভুক্ত করুন। সময় ব্যবস্থাপনার কৌশল রপ্ত করুন এবং প্রয়োজন হলে পেশাদার ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং নিন।
পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ কখনো একতরফা যাত্রা নয়; এটি পারস্পরিক শ্রদ্ধার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এক সম্মিলিত মহাকাব্য। আজকের ডিজিটাল যুগে যখন ভার্চুয়াল সম্পর্ক বাস্তবের স্থান নিচ্ছে, তখন রক্তের বন্ধনই আমাদের অস্তিত্বের শেষ দুর্গ। প্রতিটি ভোর যেন শুরু হোক প্রিয়জনের জন্য এক ফোঁটা ভালোবাসা বাড়ানোর সংকল্পে, প্রতিটি সন্ধ্যা যেন শেষ হোক কৃতজ্ঞতায় – কারণ, পরিবারই সেই অদৃশ্য হাত যা আমাদের মহাকাশযাত্রায় পৃথিবীর সঙ্গে বেঁধে রাখে। আপনার পরিবারের দিকে আজই ফিরে তাকান – একটি ফোন, এক মুঠো স্নেহ, বা শুধু এক মিনিটের উপস্থিতিই হতে পারে তাদের কাছে মহাসমুদ্রের সমান। সময় নষ্ট করবেন না, এখনই কিছু করুন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।