পরিযায়ী পাখি ও আন্তর্জাতিক সীমানা: জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের এক মেলবন্ধন

পরিযায়ী পাখি

কনকনে শীত আর কুয়াশার চাদর। তার মধ্য দিয়ে সকাল সকাল একটি ভ্যান ছুটে চলেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্তবর্তী এলাকা চড়ুইল বিলে। সেখানে পৌঁছে দেখি পাখিদের সৌন্দর্যের এক মোহনীয় প্রতিচ্ছবি, যা ছিল এক পাখপাখালির স্বর্গ। মৌলভী হাঁস, ল্যাঞ্জা হাঁস, পিয়াং হাঁস, সিথি হাঁসসহ অজস্র পরিযায়ী হাঁসের আনাগোনা। জিরিয়া, বাটান, চা-পাখি, জৌড়ালি, রাফ, লালপা, সবুজ পা ঈগল, বাজসহ বিভিন্ন পরিযায়ী পাখি। বগা-বগলা, ধূপনি বক, লালচে বকসহ দুটি কালা মানিকজোড় আর একঝাঁক কালোমাথা কাস্তেচরার দেখাও পেলাম। আছে রাঙা মানিকজোড় আর মদনটাকও। তবে এখানে এসে চোখ জুড়াবে যা দেখে, তা হলো কালাপাখ ঠেঙ্গি। ২০০-৪০০ পাখির ঝাঁক দেখে যে কেউই আকৃষ্ট হবেন।

পরিযায়ী পাখি

মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়ানো পাখিদের কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানা দিয়ে আটকে রাখা যায় না। তাদের নেই কোনো সীমানা। ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে পারে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। কিন্তু দেশগুলোর তো ভৌগোলিক সীমারেখা রয়েছে। আর দুই দেশ যেখানে মিলিত হয়, সেখানে থাকে আন্তঃদেশীয় সীমানা। গবেষণা বলে, এই আন্তঃদেশীয় সীমানাগুলো বন্যপ্রাণী তথা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। পৃথিবীর মোট জীববৈচিত্র্যের ৫৭ শতাংশের খোঁজ মেলে এই এলাকাগুলোতে।

মানুষের চলাচল বা মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ড কম থাকায় এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং এই পরিবেশের গুণগত মান জীববৈচিত্র্যের আবাসস্থল হিসাবে খুব অনুকূল। তাই বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর আনাগোনা তুলনামূলক বেশি। এ ছাড়া এখানে রয়েছে স্থানীয় লতাগুল্ম, বৃক্ষে ঘেরা প্রাকৃতিক পরিবেশ। সব মিলে তৈরি হয়েছে সমৃদ্ধ এক প্রতিবেশ ব্যবস্থা। ফলে এই অঞ্চলগুলোতে খুব সহজেই বিপন্ন বা বিরল প্রজাতির প্রাণীদের দেখা মেলে। তাই সারা বিশ্বে এই আন্তঃদেশীয় সীমানা এলাকাগুলোকে জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়।

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি ছোট দেশ। কিন্তু ছোট হলে কী হবে, দেশটি জীববৈচিত্র্যের প্রাচুর্যে সমৃদ্ধ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ওরিয়েন্টাল নামের প্রাণী ভৌগোলিক অঞ্চলে, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকায় অবস্থিত ছোট্ট একটি দেশ এই বাংলাদেশ। ইন্দোচায়না এবং ইন্দোবার্মার জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ অঞ্চলের মিলন স্থলে অবস্থানের কারণে রয়েছে বন্যপ্রাণীর এক সমৃদ্ধ ভান্ডার, যার মধ্যে রয়েছে ১৪০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৭০০-এর অধিক প্রজাতির পাখি, ১৭০-এর অধিক সরীসৃপ এবং ৬৩ প্রজাতির উভচর। এই পাখিদের মধ্যে ৩৩৭ প্রজাতি আমাদের দেশের আবাসিক পাখি, ২০৮ প্রজাতি শীতকালীন পরিযায়ী, ১২ প্রজাতি গ্রীষ্ম পরিযায়ী, ১৪ প্রজাতি পান্থ পরিযায়ী এবং ১১৯ প্রজাতি ভবঘুরে হিসেবে বিবেচিত।

বাংলাদেশের তিন দিকই পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সীমানাবেষ্টিত। দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে মায়ানমার, আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। বাংলাদেশের স্থল সীমান্তরেখার দৈর্ঘ্য ৪ হাজার ২৪৬ কিলোমিটার, যার ৯৪ শতাংশ (৪ হাজার ৫৩ কিলোমিটার) ভারতের সঙ্গে এবং বাকি ৬ শতাংশ (১৯৩ কিলোমিটার) মিয়ানমারের সঙ্গে। এই সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো ঘিরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরায় রয়েছে অসংখ্য সংরক্ষিত এলাকা। এ ছাড়া মিয়ানমারের সঙ্গে পুরো সীমানাই পাহাড়ি বনে আচ্ছাদিত। ফলে বন্যপ্রাণীরা এই এলাকাগুলোকে কেন্দ্র করে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেও বিচরণ করে।