গাজায় হামলার পাশাপাশি অধিকৃত পশ্চিম তীরেও ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর থেকে উৎখাত করার নীতি জোরালো করছে ইসরায়েল, যা আন্তর্জাতিক আইনের সরাসরি লঙ্ঘন।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে জেনিন, নুর শামস ও তুলকারেম—এই তিন শরণার্থী শিবিরে অভিযান চালিয়ে অন্তত ৩২ হাজার ফিলিস্তিনিকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হয়েছে।
১৯৬৭ সালের পর পশ্চিম তীরে এটিই সবচেয়ে বড় মাত্রার উচ্ছেদ। একই সময়ে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সহিংসতা দ্রুত বেড়েছে; গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত সেখানে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে ১,০০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। অবৈধ বসতির ইসরায়েলিরাও নিয়মিত হামলা চালাচ্ছে।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, পশ্চিম তীরের ‘এরিয়া সি’–তে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ বাড়িঘর ভেঙে অন্তত এক হাজার ফিলিস্তিনিকে গৃহহীন করেছে। অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমে আরও ৫০০ জন গৃহহীন হয়েছেন। ইসরায়েল বলছে, এসব নির্মাণে অনুমোদন ছিল না—কিন্তু ওই অঞ্চলে ফিলিস্তিনিদের জন্য অনুমতি পাওয়া প্রায় অসম্ভব।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান ও উচ্ছেদ নীতি তদন্তের দাবি বহুদিন ধরে উঠলেও ইসরায়েল কোনো জবাবদিহির মুখে পড়ছে না। ইসরায়েলি সংগঠন বেতসেলেমের নির্বাহী পরিচালক ইউলি নোভাক বলেন, ‘ফিলিস্তিনি জীবনের মূল্য আজ শূন্যের কোঠায় নেমেছে। গাজায় যে ভয়াবহতা চলছে, পশ্চিম তীরেও পরিস্থিতি প্রতিদিন খারাপ হচ্ছে, কারণ ইসরায়েলকে থামানোর মতো কোনো ব্যবস্থাই নেই।’ তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দায়ীদের জবাবদিহিতে আনার আহ্বান জানান।
ইসরায়েলের প্রকৃত লক্ষ্য কী?
ইসরায়েলের বহু শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা খোলাখুলিভাবে বলছেন, তাদের উদ্দেশ্য পশ্চিম তীর দখল করে সেখানে ইসরায়েলি সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা। গত অক্টোবরে ইসরায়েলি পার্লামেন্ট পশ্চিম তীর দখলের পথ খুলে দিতে একটি বিলের প্রাথমিক অনুমোদন দেয়, যা আন্তর্জাতিক আইনের সরাসরি লঙ্ঘন হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ইসরায়েলের কট্টরপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোত্রিচ, যিনি নিজেই একটি অবৈধ বসতিতে থাকেন, বহুবার বলেছেন যে তিনি পশ্চিম তীরকে ‘ইসরায়েলের অবিচ্ছেদ্য অংশ’ বানাতে চান। তিনি বলেন, তার ‘জীবনের লক্ষ্য’ হলো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা নস্যাৎ করা। বর্তমানে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ৭ লাখের বেশি ইসরায়েলি অবৈধ বসতিতে বাস করছে।
স্মোত্রিচ এই বছর নতুন ‘ই–ওয়ান’ বসতি তৈরির ঘোষণা দেন—যা পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরকে আলাদা করার জন্য ৩,০০০ বাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা। তিনি এটিকে বলেন, ‘ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের ধারণাকে চিরতরে সমাহিত করা’র প্রকল্প।
ইসরায়েল কী যুক্তি দিচ্ছে?
ইসরায়েলের দাবি, পশ্চিম তীরের নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে ‘পরিকল্পনা আইনের’ কারণে বাড়িঘর ভাঙা হচ্ছে, অথবা সেগুলো ‘সামরিক এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত। জাতিসংঘের মতে, এসব এলাকায় ফিলিস্তিনিদের বিল্ডিং পারমিট পাওয়া ‘প্রায় অসম্ভব’।
জেনিন, নুর শামস ও তুলকারেমে উচ্ছেদকে ইসরায়েল বলছে ‘অপারেশন আয়রন ওয়ালের’ অংশ—যার লক্ষ্য শিবিরগুলোতে তাদের দখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ দমন। তবে কয়েক মাস কেটে গেলেও মানুষকে বাড়িতে ফিরতে দেওয়া হয়নি, আর বুলডোজারে অসংখ্য ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বলছে, এগুলো ছিল ‘অপারেশনাল প্রয়োজন’। বাসিন্দারা সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করতে পেরেছিলেন, কিন্তু সব আবেদনই খারিজ হয়েছে।
বসতিস্থাপনকারীদের সহিংসতা উদ্বেগ বাড়াচ্ছে
অবৈধ বসতিতে থাকা ইসরায়েলিদের হামলা পশ্চিম তীরে দ্রুত বাড়ছে। অক্টোবর মাসে এক মাসেই ২৬০টির বেশি হামলা রেকর্ড করেছে জাতিসংঘ—যা প্রতিদিন গড়ে আটটি ঘটনা।
জলপাই সংগ্রহ মৌসুমে সহিংসতা আরও বেড়ে যায়। ফিলিস্তিনিরা বলছেন, এসব হামলা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত—গ্রামীণ জীবনকে ভেঙে দেওয়া এবং মানুষকে বাধ্য করা যেন তারা এলাকা ছেড়ে চলে যায়।
সংক্ষেপে, পশ্চিম তীরে উচ্ছেদ, ঘরবাড়ি ভাঙা, নতুন বসতি নির্মাণ এবং বসতিস্থাপনকারীদের ক্রমবর্ধমান হামলা—সব মিলিয়ে ইসরায়েলের নীতিকে ফিলিস্তিনিদের মতে ভূমি দখল ও জোরপূর্বক জনসংখ্যা হ্রাসের পরিকল্পনা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সূত্র: আল জাজিরা
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।



