রঞ্জু খন্দকার, গাইবান্ধা থেকে: কখনো ‘উড়ন্তি বাণে’ ‘পাতা’ যেন উড়ে আসছে এক কোণে অবস্থান নেওয়া তান্ত্রিক-ওঝা দলের কাছে। কখনোবা আরেক দল তান্ত্রিকের ‘মেটে বাণে’ মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে পাতা ছুটছে মাঠের অন্য প্রান্তে। এভাবে বাণ কাটাকাটির একপর্যায়ে পাতা অসাড় পড়ে যাচ্ছে কোনো তান্ত্রিকদলের দাগকাটা ঘরে। হইচই-উচ্ছ্বাসে মেতে উঠছে দর্শক।
গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার মনোহরপুর গ্রামে ‘বাণ কাটাকাটি’র এ খেলা জমে ওঠে আজ সোমবার। স্থানীয়ভাবে এটি ‘পাতা খেলা’ নামে পরিচিত।
মনোহরপুর উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে বিকেল পাঁচটার দিকে এ খেলা শুরু হয়। চলে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত। এতে আশপাশের কয়েক গ্রামের হাজারও মানুষ যোগ দেন।
খেলার একপর্যায়ে মাঠে আসেন পলাশবাড়ী -সাদুল্ল্যাপুর আসনের সংসদ সদস্য ও কৃষকলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক উম্মে কুলসুম স্মৃতি। তিনি উপস্থিত লোকজনের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
আয়োজকদের সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় কৃষক লীগের উদ্যোগে এ খেলার আয়োজন করা হয়েছে। এ খেলায় বিভিন্ন জেলা থেকে তান্ত্রিকেরা এসেছেন। খেলার প্রথম পুরস্কার ৩২ ইঞ্চি এলইডি টেলিভিশন। দ্বিতীয় স্থান অধিকারী দল পাবে ২৪ ইঞ্চি এলইডি টিভি।
বিকেল পাঁচটার দিকে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের মাঠ লোকে লোকারণ্য। মাঠের তিনদিকে পুরুষ দর্শকেরা বসেছেন। উত্তর পাশে বসেছেন নারীরা। অনেকেই জায়গা না পেয়ে বিদ্যালয় ভবনের ছাদেও উঠেছেন।
খেলা দেখতে এসেছিলেন মনোহরপুর গ্রামেরই বাসিন্দা লাইজু আকতার। তিনি বলেন, সাধারণত গ্রামের নারীরা কোনো খেলা বা অনুষ্ঠান দেখতে যান না। তবে পাতা খেলা হলে নারীরা দল বেঁধে দেখতে যান।
স্থানীয় লোকজন জানান, পাতা খেলা এই অঞ্চলের হাজার বছরের ঐতিহ্য। বংশ পরম্পরায় এ খেলা দেখে আসছেন তাঁরা। তবে এর উৎপত্তি কীভাবে, কেউ জানেন না।
খেলায় অংশ নিতে পাশের দিনাজপুর থেকে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের কয়েকজন তান্ত্রিক এসেছিলেন। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কাটা এলাকা থেকে এসেছিলেন একই সম্প্রদায়ের দুই নারী। তাঁরা পরস্পরের ছেলেবৌ-শাশুড়ি। তাঁদের নাম তারামণি ও সাবরিনা।
তারামণি (৭০) বলেন, তিনি ছোটবেলা থেকে পাতা খেলায় তান্ত্রিক হিসেবে অংশ নেন। তাঁর ছেলের বৌও এখন তাঁর সাথে খেলায় অংশগ্রহণ করেন।
কয়েকজন তান্ত্রিক জানান, এই খেলায় মাঝে দুজন থাকেন। একজন ‘পাতা’, আরেকজন ঢোলবাদক। পাতাকে তুলারাশির জাতক হতে হয়। মাঠের বিভিন্ন কোণে তান্ত্রিকদল অবস্থান নেন। যে দল বাণ মেরে পাতাকে নিজেদের সীমানায় নিয়ে এসে অসাড় করে ফেলতে পারবে, তাঁরা পয়েন্ট পাবে। এভাবে নির্ধারিত সময়ে যারা বেশি পয়েন্ট পাবে, তারাই জয়ী হবে।
তান্ত্রিক বঙ্কো মিয়া বলেন, যার মন্ত্রের যত জোর তিনি তত বেশি পাতাকে আকর্ষণ করে নিজেদের সীমানায় ফেলতে পারেন। আবার অন্য প্রান্তের তান্ত্রিকেরা পাতাকে উলটো বাণ মেরে নিজেদের দিকেও নেওয়ার চেষ্টা করেন।
খেলা দেখতে আসা কয়েকজন জানান, এসব তন্ত্রমন্ত্রে তাঁরা অনেকেই বিশ্বাস করেন না। তবে খেলাটি দেখতে মজা পান। এ উপলক্ষে এলাকায় রীতিমতো মেলা বসে। এলাকার মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক সুন্দর হয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।