রঞ্জু খন্দকার, গাইবান্ধা থেকে: বিয়ে উপলক্ষে ঝালরওয়ালা ৫০-১০০ রিকশার বহর যাচ্ছে কনের বাড়ি, এমন দৃশ্য এখন আর নেই। অথবা চারদিক কাপড়ঘেড়া রিকশায় নতুন বৌ নায়র যাচ্ছে বাপের বাড়ি– এ তো আরও কষ্টকল্পনা। অথচ একসময় উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এমন চিত্র ছিল স্বাভাবিক।
এসব দৃশ্য তো বটেই এখন খোলনলচে পালটে গেছে খোদ রিকশা-ই। সেই প্যাডেলওয়ালা পায়ে টানা রিকশা আর তেমন চোখেই পড়ে না গ্রামে, মফস্বল শহরে। এর স্থলে এখন সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিকশা। বর্তমানে রাজধানী ঢাকা ছাড়া দেশের বেশির ভাগ শহর চলে গেছে বিদ্যুচ্চালিত এসব বাহনের দখলে।
বিজ্ঞান যত উন্নত হচ্ছে, পৃথিবী তত ক্রমশ এগিয়ে চলেছে, আর সেই সাথে পিছিয়ে পড়ছে পুরনো অনেক ঐতিহ্য। একসময় রাস্তাঘাটে বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে চলতো তিনচাকার পায়ে টানা রিকশা। বর্তমানে ব্যাটারিচালিত তিনচাকার রিকশা ও ভ্যানের দাপটে অনেকেটাই হারিয়ে যেতে বসেছে পায়ে টানা বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী রিকশা।
ঐতিহ্যসচেতন লোকজন বলছেন, প্যাডেলওয়ালা পায়ে টানা রিকশাই বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। এর স্থলে ব্যাটারিচালিত রিকশায় গতি বেড়েছে ঠিক, কিন্তু রিকশার সেই আবেদনটা কোথায় যেন একটু হলেও কমেছে।
গাইবান্ধা জেলা শহরের সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী শাহাবুল শাহীন বলেন, পায়ে টানা রিকশা শুধু ঐতিহ্যবাহী-ই নয়, এটা মূল্যসাশ্রয়ীও ছিল। ব্যাটারিচালিত রিকশায় বিদ্যুৎ খরচ হয়। তা বাংলাদেশের মতো লোডশেডিংপ্রবণ দেশে কিছুটা সমস্যাই তৈরি করেছে।
তবে আরেক পক্ষের মতও উপেক্ষা করার মতো নয়। তাঁদের ভাষ্য, পায়ে টানা রিকশার ইতিহাস মানুষের দাসত্বের ইতিহাস। এটা মানুষকে ভারবাহী পশুর সমতুল্য করে তোলে। বিদ্যুচ্চালিত রিকশা মানুষকে সেই দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছে। এই আধুনিক কালেও মানুষ কেন মানুষকে টানবে? প্রযুক্তির কল্যাণে এগিয়ে যাওয়াই কালের নিয়ম।
পলাশবাড়ী উপজেলার সুলতানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শাহওয়াজ কবির বলেন, আগে রিকশা চালাতে মানুষের যে কষ্ট হতো, তা দেখার মতো নয়। অনেক গরিব মানুষ শারীরিক শক্তির অভাবে রিকশা চালাতে পারতেন না। প্রযুক্তি সেই পরিস্থিতি রাতারাতি পালটে দিয়েছে। এখন অনেক বৃদ্ধ ব্যক্তিও রিকশা চালিয়ে জীবীকা অর্জন করতে পারছেন।
সম্প্রতি সরেজমিনে রংপুর ও গাইবান্ধা শহরে দেখা যায়, শহরে প্রচুর রিকশা। তবে এর প্রায় সবগুলোই ব্যাটারিচালিত। গাইবান্ধা শহরে দুয়েকটা পায়ে টানা রিকশা রয়েছে। এ ছাড়া অটোরিকশায় সয়লাব দুটি শহরই।
কথা হয় রংপুর শহরের অটোরিকশার চালক সেলিম মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, মানুষ এখন দ্রুত সব জায়গায় যেতে চায়। সবার ব্যস্ততা খুব বেশি। এ কারণে সবাই অটোরিকশাই পছন্দ করেন, অটোতেই ওঠেন।
গাইবান্ধা শহরের রিকশাচালক হবিবর রহমান বলেন, আগে তিনিও পায়ে টানা রিকশা চালাতেন। কষ্ট হলেও ওটাই চালাতে ভালো লাগত। পরিশ্রম বেশি হওয়ায় এতে শরীরও ভালো থাকত। রাতে ভালো ঘুম হতো। বর্তমানে ব্যাটারিচালিত রিকশায় টাকা রোজগার বাড়লেও শরীরের তেমন পরিশ্রম হয় না। ফলে ঘুমও আগের মতো হয় না।
বর্তমানে রাজধানী ঢাকা ছাড়া দেশের বেশির ভাগ শহর ব্যাটারিচালিত রিকশার দখলে চলে গেছে। রাজধানী শহরের কয়েকজন জানান, দেশে পায়ে টানা রিকশার ঐতিহ্য এখনো টিকিয়ে রেখেছে ঢাকা। যেমন হাতে টানা রিকশা ‘টাঙ্গা’ এখনো টিকে রয়েছে কলকাতায়। ঢাকায় এখনো ঝুমবৃষ্টিতে হুডতোলা রিকশায় ঘুড়ে বেড়ানো যায়। গরমের দাপটে হুডখোলা রিকশায় ঘোরা যায় শহুরে বাতাসে। তবে এ শহরও কখন বিদ্যুচ্চালিত রিকশার দখলে চলে যাবে, কে জানে?
ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসমাউল হুসনা বলেন, গ্রামে গেলে রিকশায় ওঠার ফিলিংসটা এখন আর পাই না। ঢাকায় এখনো এই অনুভূতিটা বেঁচে আছে। কালের বিবর্তনে অনেক কিছুই হারিয়ে যায়, ঠিক আছে। তবু কিছু ঐতিহ্য রেখে দেওয়া দরকার। গুলিস্তান থেকে পুরান ঢাকায় এখনো যেমন ঘোড়ার গাড়ি চলে, তেমনি রাজধানীজুড়ে যেন পায়ে টানা রিকশাও চলে– এমনটাই আশা রাখি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।