আতাউর রহমান রাইহান : পাসপোর্ট র্যাঙ্কিংয়ে তলানিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। লন্ডনভিত্তিক নাগরিকত্ব ও পরিকল্পনা বিষয়ক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স বলছে, পাসপোর্ট র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ এখন সারা বিশ্বের মধ্যে ৯৭তম। মার্কিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত উত্তর কোরিয়াও পাসপোর্ট র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে।
তবে সান্ত্বনার বিষয় হলো, যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, পাকিস্তান, সোমালিয়া, নেপাল, লিবিয়া ও ফিলিস্তিনি পাসপোর্টের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ।
পাসপোর্ট র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান ও স্পেনের মতো দেশগুলো রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ কেন এতটা পিছিয়ে? এমন প্রশ্ন এখন সবার।
যেভাবে হয় পাসপোর্ট র্যাঙ্কিং
লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স প্রকাশিত সূচকে বিশ্বের পাসপোর্টগুলোর মান জানা যায়। গত ১৯ বছরের নথির ভিত্তিতে প্রতি বছর ‘হেনলি পাসপোর্ট সূচক’ প্রকাশিত হয়। আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন সংগঠনের (ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন) নথির ভিত্তিতে ১৯৯টি দেশের পাসপোর্ট নিয়ে এই সূচক তৈরি করা হয়।
এক্ষেত্রে পৃথিবীর ২২৭টি গন্তব্যে যেতে পারার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হয়। যেই দেশের পাসপোর্টধারীরা বিনা ভিসায় সবচেয়ে বেশি দেশে যাতায়াত করতে পারে, সেই দেশের পাসপোর্ট তত শক্তিশালী।
অন-অ্যারাইভাল ভিসায় নিরূপণ হয় পাসপোর্টের র্যাঙ্কিং
কতটি দেশের সঙ্গে অন-অ্যারাইভাল ভিসা আছে, তার ওপর নির্ভর করছে একটি দেশ পাসপোর্ট র্যাঙ্কিংয়ে কতটা উপরে থাকবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অনুবিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কতটা দেশে অন-অ্যারাইভাল ভিসা পাওয়া যাচ্ছে, সেটার ওপর নির্ভর করে পাসপোর্ট র্যাঙ্কিং হয়।
সবশেষ তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীরা ৪০টি দেশে অন-অ্যারাইভাল ভিসা পায়। আর র্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বরে থাকা সিঙ্গাপুর ১৯৫টি দেশে অন-অ্যারাইভাল ভিসা পায়। এ তালিকায় সিঙ্গাপুরের চেয়েও পিছিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অনুবিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, আমেরিকাতো আমাদের অন-অ্যারাইভাল ভিসা দেবে না। এই ভিসার জন্য একটি দেশের সঙ্গে আরেকটি দেশের চুক্তি হয়। আমরা ৩৩টি দেশের সঙ্গে চুক্তি করেছি। তবে অন্য দেশগুলোর সঙ্গেও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। কাজেই এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আমেরিকার কেউ অন্য দেশে গেলে তার পাসপোর্ট এতটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় না। কিন্তু আমাদের দেশের কেউ গেলে তাকে অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়।
যারা পর্যটক হিসেবে বিভিন্ন দেশে যান, তাদের উৎসাহিত করতেই অন-অ্যারাইভাল ভিসা দেয়া হয়। এটির মেয়াদ থাকে ৯০ দিনের মতো। এই সময়ের মধ্যে একজন পর্যটককে ওই দেশ ছাড়তে হয়।
নিয়মনীতি মেনে চললে সহজ হয় অন-অ্যারাইভাল ভিসা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব সাব্বির আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘র্যাঙ্কিংটা মূলত নির্ভর করে বিদেশে যেসব বাংলাদেশি নাগরিক যাচ্ছেন এবং সেখানে তাদের যে আচার-ব্যবহার সেটার ওপর। যেমন র্যাঙ্কিংয়ে প্রথম দিকে থাকা একটি দেশ হচ্ছে জাপান। কারণ দেশটির কোনো নাগরিক যখন জাপানি পাসপোর্ট নিয়ে কোনো দেশে যান, তখন ভিসার নিয়মনীতি তারা ভালোভাবে মেনে চলেন। একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য যখন তাদের কোনো দেশ থেকে ভিসা দেয়া হয় এবং ওই সময়ের মধ্যে তারা দেশত্যাগ করেন।’
‘যদি মাল্টিপল এন্ট্রি থাকে, যেমন আমেরিকা পাঁচ বছরের মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা দেয়। কিন্তু ঢোকার পর তারা একটি সিল মেরে দেন যে প্রথম প্রবেশের পর ছয়মাস কিংবা তিনমাসের মধ্যে তাকে ফেরত যেতে হবে। এখন ওই সময়ের মধ্যে যদি ওই দেশ না ছাড়েন, তখন তিনি ভিসা ডিফল্টার হয়ে যান। এতে একটি দেশের পাসপোর্টের মূল্য কমে যায়,’ যোগ করেন তিনি।
সাব্বির আহমেদ আরও বলেন, পরবর্তীতে যখন তিনি ঢুকতে যাবেন, তখন ভিসা বৈধ থাকলেও দ্বিতীয়বার তাকে ঢুকতে দেয়া হবে না। কারণ তিনি নিয়ম ভঙ্গ করেছেন। তারপরে যেটা দেখা যায়, বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে কেউ একজন সেখানে গেলেন, কিন্তু ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও তিনি সেখানে থাকছেন। অর্থ হচ্ছে তিনি অবৈধ হয়ে গেছেন।
‘এমন ঘটনায় যে দেশ থেকে তিনি গেছেন, সেই দেশের ওপর একটা প্রভাব পড়ে। কারণ কোনো দেশই অবৈধভাবে কাউকে থাকার অনুমতি দেয় না। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশসহ অনেক দেশের নাগরিক বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে থেকে যান। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশসহ দক্ষিণ আফ্রিকায়ও তারা থেকে যান। তখন এসব দেশে ওই পাসপোর্টগুলোতে ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা হয়’, যোগ করেন তিনি।
সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিবের মতে, ‘কোনো কোনো দেশে এই বিষয়টি পর্যবেক্ষণ কিংবা তত্ত্বাবধায়ন করাটা কঠিন। জনসংখ্যার দিক থেকে তৃতীয় বৃহত্তম দেশ আমেরিকা। সেখানে এটা পর্যবেক্ষণ করা অনেক কঠিন। কখনও সন্দেহভাজন কাউকে ধরতে পারলে তারা তাকে জেলে নিয়ে যান। কিন্তু সেখানে জেলে রাখার বিষয়েও একটা নিয়ম আছে যে, একটা নির্দিষ্ট দিনের বেশি তাকে রাখা যাবে না।’
‘হয়তো তাকে নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে হবে। তখন দেখা যায়, তার কোনো নথিপত্র থাকে না। তখন এই বিষয়টির সুরাহা করা কঠিন হয়ে যায়। এতে কোনো কোনো দেশ সম্পর্কে তাদের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে দেখা যায়, সেখানে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও আফ্রিকার কিছু দেশ নিয়ে একটা তালিকা তৈরি হয়ে যায় যে, এসব দেশের নাগরিকরা সেখানে অবৈধভাবে বেশি থাকছেন’, যোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরেও ফেরত না গেলে যে দেশ থেকে এক ব্যক্তি এসেছেন, সেই দেশের পাসপোর্টের মূল্য কমে যায়। এতে যখন তারা ভিসার জন্য আবেদন করেন, তখন সেটা প্রত্যাখ্যান হয়। অথবা ভিসা নিয়ে যেতে হয়।’
‘জাপানের পাসপোর্ট নিয়ে কেউ যদি উত্তর আমেরিকায় যান, তাহলে কোনো ভিসা লাগে না। অন-অ্যারাইভাল ভিসা দিয়ে দেয়া হয়। তাদের আগে থেকে কোনো ভিসা লাগে না। আবার বাংলাদেশের অনেকে ভিসা নিয়ে গেলেও তাকে আটকে দেয়া হয়। মূলত ওই দেশের অভিবাসন আইন মেনে না চলার কারণে যে দেশ থেকে যাচ্ছে, সেই দেশের পাসপোর্টের মূল্য কমে যায়’, বলেন সাব্বির আহমেদ চৌধুরী।
মানবপাচারের ঘটনায় পাসপোর্টের মান কমে না
মানবপাচারের সঙ্গে পাসপোর্টের র্যাঙ্কিং কমে যাওয়ার সম্পর্ক আছে কি না- জানতে চাইলে সাব্বির আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘মানবপাচার একটা ভিন্ন বিষয়। কেউ যখন মানবপাচার করেন, তখন সেটা সরকারের সম্মতিতে হয় না। যারা মানবপাচার করেন, তারা নিজ দেশ এবং যেদেশে যাচ্ছে, দুই দেশের সরকারকেই ধোঁকা দিচ্ছেন। এতে সে যে দেশ থেকে যাচ্ছে, সেই দেশের জন্য অবশ্য বদনাম তৈরি হয়।’
‘তবে অনেকের নিয়মকানুন না জানা কিংবা খেয়াল না করার কারণেও সমস্যা হচ্ছে। ভিসা দেয়ার সময় উল্লেখ করা হয়, তাকে এক বছরের মাল্টিপল ভিসা দেয়া হচ্ছে এবং প্রতিবার প্রবেশ করে তিনি ১৫ দিনের বেশি থাকতে পারবেন না। অর্থাৎ এক বছরের মধ্যে তিনি যতবার ইচ্ছা যেতে পারবেন, কিন্তু প্রতিবার ১৫ দিনের বেশি থাকতে পারবেন না। এ বিষয়টি খেয়াল করা উচিত, খেয়াল না করলে ডিফল্টার হয়ে যেতে হয়’, বলেন তিনি।
উদহারণ দিয়ে সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘যেমন মধ্যপ্রাচ্যে অনেক বাংলাদেশি আছেন, আকামা শেষ হওয়ার পরেও তারা সেখানে থেকে যাচ্ছেন। এসব কারণে তারা যে দেশের নাগরিক সেই দেশ সম্পর্কে বিরূপ ধারণা তৈরি হয়। তাদের পারমিটও বন্ধ হয়ে যায়। এটা কেবল পাসপোর্ট না, ওইসব দেশের আচার-ব্যবহারের ওপরও নির্ভর করে।’
জাপান, সিঙ্গাপুর, সুইডেন ও স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলোর পাসপোর্টের অনেক গুরুত্ব থাকে। কারণ তারা নিয়মকানুন মেনে চলেন।
পাসপোর্ট র্যাঙ্কিং বাড়াতে সচেতনতার বিকল্প নেই
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব সাব্বির আহমেদের মতে, একটি দেশের নাগরিকের শৃঙ্খলাবোধের ওপর নির্ভর করে সেই দেশের পাসপোর্টের গুরুত্ব তৈরি হয়। যেমন কোনো জাপানিকে দেখবেন না, সজ্ঞানে কোনো ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও সেই দেশে অবস্থান করেন। এ কারণে তাদের পাসপোর্টের মূল্য বেশি।
এ বিষয়ে সচেতনতার বিকল্প নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, আশার কথা হলো কোনো দেশে অবৈধভাবে অবস্থানের বিষয়ে বর্তমানে বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। আবার আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হচ্ছে। এসব কারণে বড় দেশগুলোতে গিয়েও বাংলাদেশিরা ফিরে আসছেন। যেমন কেউ যখন কানাডা গিয়ে ভালো চাকরি পান না, অথচ বাংলাদেশে তার ভালো চাকরি ছিল, তারা ফেরত আসেন। যে কারণে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ছে বলে মনে করেন তিনি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।