আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ইউক্রেনের বন্দরনগরী মারিউপোলে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় জলে-স্থলে হামলা বাড়িয়েছে রাশিয়া। তারা কিয়েভ, খারকিভ, চেরনিহিভসহ বিভিন্ন শহরে টানা বোমাবর্ষণ করছে। গত এক দিনে দেশটিতে প্রায় তিনশ বার বিমান হামলা চালিয়েছে মস্কো। এমন প্রেক্ষাপটে রুশ প্রেসিডেন্ট ভদ্মাদিমির পুতিনের ‘পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে’ বলে মন্তব্য করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। মস্কোর জীবাণু অস্ত্র ব্যবহারের শঙ্কাও বাড়ছে বলে সতর্ক করেন তিনি। এ পরিস্থিতিতে যুদ্ধ বন্ধে পুতিনকে আবারও সরাসরি আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। রুশ প্রেসিডেন্ট এখন রাজি হলে ক্রিমিয়া, দোনবাসসহ ‘সব বিষয়ে’ আলোচনা হতে পারে বলেও জানান তিনি। স্থানীয় সময় সোমবার রাতে সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জেলেনস্কি এসব কথা বলেন। খবর বিবিসি, এএফপি ও রয়টার্সের।
জেলেনস্কি জানান, তার সঙ্গে পুতিনের বৈঠক ছাড়া এ যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে আলোচনা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, রাশিয়ার দখল করা ক্রিমিয়া, দোনবাস অঞ্চল ও ইউক্রেনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তাসহ সব বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য তিনি তৈরি আছেন। তবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট এও বলেন, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তগুলো অবশ্যই একটি গণভোটের মাধ্যমে ইউক্রেনের জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে।
তিনি বলেন, ‘যদি আমার এ সুযোগ থাকে এবং রাশিয়ার এ আকাঙ্ক্ষা থাকে, আমরা সব প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করতে পারি। রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রথম বৈঠকেই এসব বিষয় তুলতে আমি প্রস্তুত।’
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা প্রায় মাস হতে যাচ্ছে। এ হামলায় দেশটির বেশ কয়েকটি শহর রীতিমতো বিধ্বস্ত। তবে জেলেনস্কি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, আত্মসমর্পণের আগে তার দেশ ‘ধ্বংস হয়ে যাবে’।
হামলা শুরুর পর থেকে বেশ কয়েকবার রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিরা শান্তি আলোচনায় বসেছেন। তবে সেগুলো সফলতার মুখ দেখেনি। এরই মধ্যে কয়েকবার সরাসরি পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় বসার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন জেলেনস্কি। ইউক্রেনীয় শীর্ষ নেতার এমন মন্তব্যের পর ক্রেমলিন জানায়, দুই নেতার মধ্যে সরাসরি বৈঠক হওয়ার মতো অগ্রগতি আলোচনা এখনও হয়নি। এ জন্য তাদের আরও সক্রিয় হতে হবে। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেশকভ যোগ করেন, ইউক্রেনের কাছে মস্কোর দাবি প্রকাশ করতে চায় না তার দেশ।
এমন এক সময় জেলেনস্কি এ আহ্বান জানালেন, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, পুতিন হয়তো ইউক্রেনে রাসায়নিক বা জীবাণু অস্ত্র ব্যবহার করতে পারেন। খবরে বলা হয়েছে, সোমবার ওয়াশিংটন ডিসিতে ব্যবসায়িক নেতাদের সম্মেলনে বাইডেন বলেন, তার বিশ্বাস, রাশিয়া নতুন কোনো সাজানো অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা (রাশিয়া) এও বলছে, ইউক্রেনে জীবাণু ও রাসায়নিক অস্ত্র আছে। এ থেকেই পরিস্কার, তিনি (পুতিন) দুই অস্ত্রই ব্যবহারের চিন্তা করছেন।
যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা বরাবরই যুক্তি দেখিয়ে বলে আসছেন, রাশিয়া এসব অস্ত্র ব্যবহারের প্রেক্ষাপট তৈরির জন্য ইউক্রেন এসব অস্ত্র তৈরি করছে বলে মিথ্যা দাবি করতে পারে।
রাশিয়া গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে চতুর্মুখী হামলা শুরু করলেও পশ্চিমা দেশগুলো বলছে, এই বাহিনী এখনও তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। এরই মধ্যে সোমবার রুশ বাহিনীর কাছে মারিউপোলের আত্মসমর্পণের ডাক ইউক্রেনের বাহিনী প্রত্যাখ্যান করায় জলে-স্থলে হামলা বাড়িয়েছে মস্কো। তবে প্রতিরোধও বৃদ্ধি করেছে ইউক্রেনীয়রা। গতকাল মাকারিভের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দাবি করেছে কিয়েভ বাহিনী।
খবরে বলা হয়েছে, গতকাল দেশজুড়ে বিমান হামলার সতর্কতা বেজেছে। এদিন বোমাবর্ষণ ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে আজভ সাগরের সঙ্গে ইউক্রেনের প্রবেশপথ আটকে দিয়েছে রুশ সেনারা। গোলাবর্ষণ বৃদ্ধি পাওয়ায় রাজধানী কিয়েভের শহরতলি থেকে বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। কিয়েভ বিমানবন্দরেও হামলার ঝুঁকি বেড়েছে। এরই মধ্যে মারিউপোল থেকে তিন ইসরায়েলিকে অপহরণের অভিযোগ করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা গতকাল দাবি করেছেন, রাশিয়ার বিমান হামলা বাড়ানোর পর গত চব্বিশ ঘণ্টায় ৩০০ বার এ হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে শুধু খারকিভে সোমবার রাতে ৮৪ বার বিমান হামলা হয়েছে।
এ পর্যন্ত অন্তত ৬২টি স্বাস্থ্যসেবা স্থাপনায় হামলা হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির জরুরি সেবা বিভাগ। সেগুলোর মধ্যে ১০টি হাসপাতাল সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। রুশ হামলায় অন্তত সাড়ে চার হাজার আবাসিক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৬৫১টি ভবন একেবারে বিধ্বস্ত হয়েছে।
রুশ হামলার কারণে এ পর্যন্ত ৩৫ লাখের বেশি মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। এর বেশিরভাগই সীমান্তবর্তী পোল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, এ যুদ্ধের কারণে পোল্যান্ডে আশ্রয় নেওয়াদের মধ্যে ৩০ হাজারের বেশি শরণার্থী মানসিক সমস্যায় ভুগছে।
রাশিয়ার হামলা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত দেশটির ১৫ হাজার ৩০০ সেনা নিহত হয়েছে বলে দাবি করেছে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে এ দাবি নিরপেক্ষ সূত্রে যাচাই করা যায়নি।
দিন যত যাচ্ছে, ততই যুদ্ধের তীব্রতা বাড়ছে। পাশাপাশি কূটনৈতিক সমাধানের চেষ্টাও চলছে। যুদ্ধবিরতির জন্য মধ্যস্থতার চেষ্টা চালাচ্ছে তুরস্ক ও ইসরায়েল। সম্প্রতি মস্কো ও কিয়েভের মধ্যে মধ্যস্থতার জন্য খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে ফোনালাপ করেছেন জেলেনস্কি। তিনি আশা করছেন, দুই দেশের মধ্যে মধ্যস্থতায় পোপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন।
এ যুদ্ধে ইউক্রেনের পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনের জন্য ইতালির পার্লামেন্টের ভাষণ দিয়েছেন জেলেনস্কি। এর আগে ব্রিটিশ পার্লামেন্টেও ভার্চুয়ালি বক্তব্য দেন তিনি। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার জাপানের আইনসভায়ও ভাষণ দেওয়ার কথা রয়েছে।
এদিকে, হামলা শুরুর পর থেকে মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে শুরু করে পশ্চিমারা। এরই মধ্যে মঙ্গলবার রাশিয়াকে জি২০ গ্রুপ থেকে বহিস্কারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রস্তাব দিয়েছে পোল্যান্ড। বিষয়টি ইতিবাচকভাবে বিবেচনার কথা জানিয়েছে ওয়াশিংটন। আর মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় জাপানের সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শান্তিচুক্তির আলোচনা বাতিল করেছে মস্কো। এ ঘটনার জন্য রুশ রাষ্ট্রদূতকে তলব করে প্রতিবাদ জানিয়েছে টোকিও।
যুদ্ধ বন্ধে জাতিসংঘ প্রধানের আহ্বান :ইউক্রেনে অযৌক্তিক যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। গতকাল নিউইয়র্কে সংস্থাটির সদর দপ্তরে তিনি বলেন, ইউক্রেনীয়রা ‘নরকের যন্ত্রণা’র মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে। এ যুদ্ধ চলমান থাকা নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য, রাজনৈতিকভাবে অসমর্থনীয় এবং সামরিকভাবে বোকামিপূর্ণ।’
জনসন-মোদির ফোনালাপ :ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় জানায়, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ফোনালাপে জাতিসংঘ সনদ মেনে চলার ব্যাপারে রাশিয়ার বাধ্যবাধকতার ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন। যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এ দুই নেতা সম্মত হয়েছেন, ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার প্রতি অবশ্যই সম্মান দেখাতে হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।