জুমবাংলা ডেস্ক : মো. নবীরুল ইসলাম। ছিলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব। চলতি বছর ৬ মার্চ পদোন্নতির পর সেখান থেকে ১১ মার্চ যোগ দেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে। আর পূর্ত সচিবের দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই সরকারি প্লটের ওপর নজর পড়ে নবীরুলের।
জাতীয় দৈনিক দেশ রুপান্তরের আজকের সংখ্যায় প্রকাশিত দুলাল হোসেনের করা প্রতিবেদনে বলা হয়, এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার দুই মাস হতে না হতেই তাকে সরকারি প্লট দিতে রাজধানী উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যানকে চিঠি দেন। গত ৭ মে পাঠানো হয় ওই চিঠি। আর চিঠিটি পাওয়ার পর অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে তার নামে রাজধানীর উত্তরা আবাসিক প্রকল্পে পাঁচ কাঠা আয়তনের একটি প্লট বরাদ্দের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে রাজউক।
রাজধানী উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষের (ভূমি, প্লট, স্পেস ও ফ্ল্যাট বরাদ্দ) বিধিমালা-২০২৪ এর ৭ (৩) (ঘ) ধারায় নবীরুল ইসলামকে প্লট দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ হয়। চলতি বছর ২৮ এপ্রিল এই বিধিমালার গেজেট জারি হয়। সচিবদের মধ্যে তিনিই প্রথম নতুন বিধিামলায় প্লট নিয়েছেন। এর আগে সরকারি কর্মকর্তাদের রাজধানী উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষ (অ্যালটমেন্ট অব রুলস ১৯৬৯) এর ১৩-এ ধারায় প্লট দেওয়া হয়।
জানা গেছে, সাবেক গণপূর্ত সচিব মো. নবীরুল ইসলামকে সম্প্রতি বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। গত ২২ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। তিনি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে ছয় মাসেরও কম সময় দায়িত্ব পালন করেন। এ স্বল্প সময়েই কয়েক কোটি টাকা মূল্যের সরকারি প্লট বাগিয়ে নিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গণপূর্ত সচিব থাকাকালে নবীরুল ইসলামকে রাজউকের উত্তরা আবাসিক বা পূর্বাচল নতুন শহর আবাসিক প্রকল্পে একটি প্লট দিতে চলতি বছর ৭ মে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে রাজউক চেয়ারম্যানকে একটি চিঠি (স্মারক নং-২৫.০০.০০০০.০১৯.৩১.০২৬.১৩-২৩৯) দেওয়া হয়। ওই চিঠি পাওয়ার পর নবীরুলকে জরুরি ভিত্তিতে প্লট প্রদান করতে নথিপত্র চালু করা হয়। এরপর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য গত ১৫ মে রাজউকের ৯/২৪তম বোর্ডসভায় নথি উপস্থাপন করা হয়।
সংস্থাটির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. সিদ্দিকুর রহমানের সভাপতিত্বে সভায় রাজউকের সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, সদস্য (পরিকল্পনা) মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন, সদস্য (উন্নয়ন) মেজর (অব.) ইঞ্জিনিয়ার সামসুদ্দীন আহমেদ চৌধুরী, সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম এবং গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মো. হাফিজুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। সভায় আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে তৎকালীন গণপূর্ত সচিব মো. নবীরুল ইসলামকে রাজউকের উত্তরা আবাসিক প্রকল্পে খালি থাকা সাপেক্ষে পাঁচ কাঠা আয়তনের একটি প্লট দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। বিষয়টি বাস্তবায়নে রাজউকের পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি) কামরুল ইসলামকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
রাজউকের পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি) কামরুল ইসলাম বলেন, ‘তার (নবীরুল) প্লট দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত আগের অবস্থায় রয়েছে। প্লট দেওয়ার জন্য সার্চ করা (খোঁজা) হয়েছে। এখন পর্যন্ত খালি প্লট পাওয়া যায়নি। এ কারণে তাকে প্লট বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। প্লট পাওয়ার পরই বুঝিয়ে দেওয়া হবে।’
রাজউকের এস্টেট ও ভূমি শাখার একজন সহকারী পরিচালক বলেছেন, সংস্থাটির প্রতিটি প্রকল্পের প্লটের জন্য মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। একেকটি প্রকল্পে প্লটের ভিত্তিমূল্য বা বেজমূল্যের (রাজউক কর্র্তৃক নির্ধারিত মূল্য) ভিন্নতা রয়েছে। এর মধ্যে উত্তরা প্রকল্পে বাণিজ্যিক প্লটের মূল্য প্রতি কাঠা সর্বনিম্ন দেড় কোটি টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত। আর আবাসিক প্লটের মূল্য সেক্টরভেদে আলাদা।
এর মধ্যে উত্তরা ১ থেকে ৯ নম্বর সেক্টর পর্যন্ত প্রতি কাঠার বেজমূল্য ধরা আছে ১৫ লাখ টাকা। ১০ থেকে ১৪ সেক্টর পর্যন্ত প্রতি কাঠার বেজমূল্য ১০ লাখ এবং ১৫ থেকে ১৭ নম্বর সেক্টরে প্রতি কাঠার বেজমূল্য ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এটা রাজউকের বেজমূল্য হলেও বাস্তবে বাজারমূল্য অনেক বেশি। সেখানে পাঁচ কাঠা আয়তনের একটি প্লট সর্বনিম্ন ১০ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ কোটি টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। সম্প্রতি ৩ নম্বর সেক্টরে পাঁচ কাঠা আয়তনের একটি প্লট সাড়ে ১৫ কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছে।
রাজউকের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, রাজউকের উত্তরা প্রকল্পে যেসব প্লট রয়েছে তার মধ্যে ১০ শতাংশ বিশেষ কোটার জন্য সংরক্ষিত। বিশেষ কোটার প্লটের বরাদ্দ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। প্লট না থাকলেও বিশেষ কোটায় প্লট বরাদ্দ দেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দেওয়া হয়। আর মন্ত্রণালয়ের আদেশ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে প্লট খুঁজে বের করতে হিমশিম খেতে হয় রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। একপর্যায়ে কোনো না কোনো উপায়ে তাদের প্লট বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
রাজউকের কর্মকর্তারা বলেন, রাজধানী উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষ (অ্যালটমেন্ট অব ল্যান্ডস) রুলস, ১৯৬৯ অনুযায়ী প্লট বরাদ্দ দেয় রাজউক। এই বিধিমালা অনুযায়ী রাজউক কোনো আবাসিক প্রকল্প নিলে প্লট বরাদ্দের জন্য গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আবেদন আহ্বান করে। পরে আবেদন যাচাই-বাছাই করে যোগ্যদের প্লট বরাদ্দ দেয়। তবে এই বিধিমালা ১৯৮৬ সালে সংশোধন করে নতুন একটি উপবিধি (১৩-এ) যুক্ত করা হয়, যা সংরক্ষিত কোটা নামে পরিচিত। এ কোটাতেই মূলত মন্ত্রী, এমপি, সরকারি কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নামে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়।
এরপর ২০০৯ সালের ৫ আগস্ট ১৩-এ ধারাটি আবার সংশোধন করে নতুন গেজেট প্রকাশ করা হয়। সেখানে ১৩-এ (১-এ) ধারায় মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের, ১৩-এ (১-বি) ধারায় সংসদ সদস্যদের এবং ১৩-এ (১-সি) ধারায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্লট বরাদ্দ দেওয়ার বিধান রাখা হয়। চলতি বছর বিধিমালা আরেক দফা সংশোধন করে রাজধানী উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষের (ভূমি, প্লট, স্পেস ও ফ্ল্যাট বরাদ্দ) বিধিমালা-২০২৪ প্রণয়ন করা হয়। গত ২৮ এপ্রিল এই বিধিমালার গেজেট প্রকাশিত হয়। গেজেট জারির পর বিধিমালার ৭ (৩) (ঘ) ধারায় গণপূর্ত সচিব নবীরুল ইসলামকে প্লট দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে রাজউক।
সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলেছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ১৮ জন সচিবকে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্লট সংকটের কারণে তিনজনকে যৌথভাবে ১০ কাঠা আয়তনের একটি করে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। যদিও এর আগে সচিবদের ৫ এমনকি ১০ কাঠার প্লটও দেওয়া হয়েছে। তখন যাদের প্লট দেওয়া হয়েছে তার প্রতিটির দাম প্রায় ১০ কোটি টাকা। অর্থাৎ একজন সচিব প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি টাকার সম্পদের বৈধভাবে মালিক হয়েছেন। উত্তরার একটি প্লটের মূল্য ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকা। একজন সচিব তার পুরো কর্মজীবনে যে পরিমাণ আয় করেন, একটি প্লট পেয়ে তার থেকে কয়েকগুণ বেশি টাকার মালিক হয়ে যান।
রাজউকের বিধিমালা অনুযায়ী, কেউ সরকারি চাকরিতে অবদান, জনসেবা ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলে তারা বিশেষ কোটায় প্লট পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হন। তবে সে ক্ষেত্রে প্লট বরাদ্দ পেতে আগ্রহীকে প্রধানমন্ত্রী কিংবা গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করতে হয়। ওই আবেদন অনুমোদন পেলে সেটি রাজউকের বোর্ডসভায় বা সাধারণ সভায় উত্থাপন করতে হয়। বোর্ডসভায় প্লট বরাদ্দের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। প্লট বরাদ্দ দেওয়া সংক্রান্ত রাজউকের নথিতে ‘অবদান’ সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য থাকে না। মূলত এ বিধিমালা হচ্ছে সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী পছন্দের লোককে প্লট উপহার দেওয়ার একটি প্রক্রিয়া মাত্র।
ফেসবুকে ‘বিতর্কিত পোস্ট’ করে আচরণবিধি লঙ্ঘন, ওএসডি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।