মহাকাশযান ছুটছে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে। সড়ক দিয়ে শাঁই শাঁই করে চলছে গাড়ি। ওদিকে চিতা বাঘ শিকার করছে অবিশ্বাস্য দ্রুততায়। ছোট্ট এই পৃথিবীতে দ্রুতগতির জিনিসের আসলে অভাব নেই। কিন্তু এর মধ্যে পৃথিবীতে কোন জিনিসটার গতি সবচেয়ে বেশি? এই প্রশ্নের মধ্যে অবশ্য কিছু ঝামেলা আছে। এখানে ‘পৃথিবীতে’ আর ‘কোন জিনিস’—এই দুটো কথা কীভাবে ব্যাখ্যা করছেন, তার ওপর নির্ভর করবে উত্তর কী হবে।
গতির দিক থেকে এগিয়ে থাকা অতিপারমাণবিক কণা—যেমন নিউট্রন, প্রোটন বা নিউট্রিনো—আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। আবার মহাবিশ্বে আলোর গতি যে সবকিছুর চেয়ে বেশি, এ কথা প্রায় সবাই জানি। শূন্যস্থানে আলো প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩ লাখ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়। এখন পর্যন্ত এর চেয়ে গতিশীল কোনোকিছুর কথা বিজ্ঞানীদের জানা নেই।
কিন্তু আলোকে কি ‘জিনিস’ বলা যায়? এ নিয়ে পদার্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। কেউ বলেন, এটা কোনো ‘জিনিস’ নয়, কারণ এর কোনো স্থির ভর নেই। আবার অনেকে বলেন, কোয়ান্টাম মেকানিকস অনুযায়ী, আলো একই সঙ্গে কণা ও তরঙ্গ। আর অনেক বিজ্ঞানীই কণাকে ‘জিনিস’ হিসেবে স্বীকার করেন।
জিনিস মানে যে বস্তু বা পদার্থ হতে হবে, তা নয়। বলের কণা গ্লুয়ন বা বিভিন্ন ধরনের বোসন বস্তু নয়, শক্তির কণা। তবে ইংরেজিতে যাকে বলে ‘থিং’, আমরা বলতে পারি ‘জিনিস’—অনেক বিজ্ঞানীই এসব কণাকে এর অন্তর্ভূক্ত বলেই মনে করেন। আলোর কণা ফোটনকেও তাঁরা সে দলেই ফেলতে চান।
ভ্যাকুয়াম বা শূন্যস্থানে ফোটন কণাই সবচেয়ে দ্রুতগামী বস্তু। আপেক্ষিকতা তত্ত্ব বলে, শূন্যস্থানে আলোর চেয়ে—বলা উচিত, আলোর কণার চেয়ে দ্রুতগামী কিছু মহাবিশ্বে নেই। লাইভ সায়েন্সকে এ কথা মনে করিয়ে দেন যুক্তরাষ্ট্রের উটাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ জন ম্যাথিউ। তবে তিনি বলেন, ঘটনা কিছুটা জটিল হয়ে যায় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢোকার পর।
বিশেষ করে আপনার কাছে যদি ভ্যাকুয়াম চেম্বার না থাকে। এ ক্ষেত্রে ফোটন যখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে, তখন কিছুটা ধীরগতির হয়ে যায়। তখন, উপযুক্ত পরিবেশে এর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে কিছু কণা। কারণ, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ফোটনের মতো সবকিছুর গতি ধীর করে দেয় না।
উচ্চশক্তির মহাজাগতিক রশ্মি থেকে উৎপন্ন এমন কিছু অতি দ্রুতগতির কণা শনাক্তকারী বিজ্ঞানীদের একটি দলে কাজ করেছেন জন ম্যাথিউ। দলটি মূলত মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে আসা অতি পারমাণবিক কণা শনাক্ত করে। এর একটিকে বলা হয়, ‘ওএমজি’ বা ‘ওহ-মাই-গড’ কণা। ১৯৯১ সালে ম্যাথিউ ও তাঁর সহকর্মীরা এটি শনাক্ত করেন।
এ ধরনের কণাগুলো শূন্যস্থানে আলোর গতির একেবারে কাছাকাছি গতিতে ছুটতে পারে। পদার্থবিদ জন ম্যাথিউ বলেন, এগুলো যখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে আঘাত করে, তখন স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই এরা এগিয়ে যেতে থাকে। বায়ুমণ্ডল এদের গতি কমিয়ে দিতে পারে না। তাই বায়ুমণ্ডলের ভেতরে এদের গতি কখনো কখনো আলোর গতিকেও ছাড়িয়ে যায়।
এদিক থেকে পৃথিবীতে ‘ওহ-মাই-গড’ কণা অন্যতম দ্রুতগামী জিনিস। আলোকে ছাড়িয়ে যাওয়া তো আর সহজ কথা নয়! প্রশ্ন হলো, এই কণা আসলে কী? আগে যেমন বলেছি, এটি মূলত পাওয়া গেছে মহাজাগতিক রশ্মি থেকে। অর্থাৎ এ কণা আসলে অতি উচ্চশক্তির মহাজাগতিক রশ্মি। তবে এটি ঠিক কী ধরনের কণা, সে বিষয়ে নিশ্চিত নন বিজ্ঞানীরা। এটি হতে পারে প্রোটন, বা প্রোটনের মতো প্রায় ভরশূন্য কোনো অতিপারমাণবিক কণা।
সে হিসেবে এর খানিকটা ভর আছে। তাই বায়ুমণ্ডলে আলোর চেয়ে দ্রুতগামী হলেও সবচেয়ে দ্রুতগামীর স্বীকৃতি হয়তো এর দখলে নাও যেতে পারে। এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে বিজ্ঞানীদের মধ্যে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন-ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয়ের কণাপদার্থবিদ জাস্টিন ভ্যান্ডেনব্রুকের মতে, সবচেয়ে গতিশীল বস্তু হতে পারে নিউট্রিনো।
একটি নিউট্রিনোর ভর প্রোটনের তুলনায় প্রায় ১ হাজার কোটি গুণ কম হতে পারে। পদার্থবিজ্ঞানে ভরবেগের সূত্র অনুযায়ী তাই একে যদি সমপরিমাণ শক্তি দেওয়া হয়, তাহলে প্রোটনের চেয়ে এটি অনেক দ্রুত বেগে ছুটতে পারবে।
উচ্চশক্তির নিউট্রিনো শনাক্ত করার জন্য দক্ষিণ মেরুতে রয়েছে আইসকিউব নিউট্রিনো অবজারভেটরি। ২০০৫ সালে এই মানমন্দির নির্মাণ শুরু হয়। ১৪টি দেশের প্রায় ৩০০ বিজ্ঞানীর আন্তর্জাতিক দল এ মানমন্দির পরিচালনা করেন। এখানে বরফের প্রায় ১ ঘন কিলোমিটার নিচে নিউট্রিনো ডিটেক্টর বা শনাক্তকারী যন্ত্র রাখা আছে। বরফের ভেতর পর্যাপ্ত শক্তি পেলে নিউট্রিনো আলোর চেয়ে বেশি গতিতে ছুটতে পারে।
উচ্চশক্তির এসব নিউট্রিনো বরফের পরমাণুর নিউক্লিয়াসের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে চার্জিত অতিপারমাণবিক কণা তৈরি হয়। এগুলো আলোর চেয়ে বেশি গতিসম্পন্ন হওয়ার কথা। এসব কণা গতিশীল অবস্থায় একধরনের আলোক রশ্মি বিকিরণ করে। একে বলা হয় চেরেনকভ বিকিরণ। এই বিকিরণের মাধ্যমে সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবে নিউট্রিনো শনাক্ত করা যায়।
২০১৬ সালে এই মানমন্দিরের বিজ্ঞানীরা সর্বোচ্চ শক্তির নিউট্রিনো শনাক্ত করেন। তবে এখনও তা পর্যালোচনার মধ্যে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যালামোস ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির পদার্থবিদ বিল লুই বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত যতদূর জানি, তাতে এরা সবচেয়ে দ্রুতগামী কণা। এখানে একটা কথা স্পষ্টভাবে বলা উচিত।
শূন্যস্থানে কোনোভাবেই ভরযুক্ত কোনো কণার পক্ষে আলোর গতিতে ছোটা সম্ভব নয়। তবে কোনো কণার ধর্ম যদি আলোর সঙ্গে খুব বেশি মিলে যায় এবং যথেষ্ট শক্তি সরবরাহ করা হয়, তাহলে তার গতি আলোর কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে।
কত কাছাকাছি? ভেন্ডেনব্রুক গতির এ বিষয়টি ‘৯এস’-এর (9s) সঙ্গে তুলনা করে ভাবতে পছন্দ করেন। জিনিসটা আসলে কঠিন কিছু না। কোনো দশমিক সংখ্যাকে কয়টি ৯ দিয়ে প্রকাশ করা হচ্ছে, তাই ‘৯এস’। যেমন আলোর গতির ৯৯.৯৯% মানে ৪ ‘৯এস’।
ভেন্ডেনব্রুক বলেন, ২০১৬ সালে শনাক্তকৃত অতি দ্রুতগতির নিউট্রিনোর বেগ হতে পারে প্রায় ৩৩ ৯এস। অর্থাৎ ৯৯ দশমিকের পরে আরও ৩১টি ৯ বসালে যে সংখ্যা পাওয়া যাবে, তা। অন্যদিকে তাঁর হিসেব অনুযায়ী ‘ওহ-মাই-গড’ কণার গতি হতে পারে ২০ থেকে ২৪ ৯এস-এর মাঝের কিছু একটা। তুলনার জন্য বলা যায়, এখন পর্যন্ত মানুষের তৈরি সবচেয়ে গতিশীল কণার বেগ ছিল ৮ ৯এস। সার্নের কণাত্বরক যন্ত্র লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারের মাধ্যমে এই কণা তৈরি করা হয়।
আলোর বেগের তুলনায় এসব দ্রুতগতির কণার বেগের পার্থক্য কত সামান্য, তা হয়তো কল্পনা করতে পারছেন। হিসেবে সামান্য গড়মিল বা যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ঘটে যেতে পারে অনেককিছু। এ জন্যই এসব কণার বেগ নানা সময়ে আলোর কাছাকাছি বা বেশি পাওয়া গেলেও তা সঙ্গে সঙ্গে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।