কোটি কোটি বছর আগে, পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের আগে, ঘড়ি উদ্ভাবনের আগে, প্রকৃতি নিজে সময় নির্ণয়ের জন্য অত্যন্ত সঠিক ঘড়ি দেয়। সেটা হলো নিজের মেরুদণ্ডে মসৃণ আর নিয়মিতভাবে ঘোরা অতিকায় লাট্টুর মতো আমাদের পৃথিবী, যেটা সঙ্গে সঙ্গে সূর্যকেও প্রদক্ষিণ করে।
পৃথিবীর গতিতে চলা মহাকায় একটা ঘড়ি বানানো সম্ভব হলে তার দুটো কাঁটা থাকত বছর—বছর কাঁটা আর দিন-কাঁটা। প্রথমটা বছরে একবার ঘড়িতে চক্কর দিত, দ্বিতীয়টা দেখাত নিজের মেরুদণ্ডে পাক খেতে পৃথিবীর কতটা সময় লাগে।
সময়ের এই দুটো প্রধান মাপ আমাদের দিয়েছে প্রকৃতি। বাকি সবকিছু মানুষের উদ্ভাবন। সপ্তাহকে পাঁচ বা দশ দিন দীর্ঘ করার ক্ষমতা ধরে মানুষ, দিনকে সে দশ বা চল্লিশ ঘণ্টায় ভাগ করতে পারে, ঘণ্টাগুলো আজকের তুলনায় বড় বা ছোট হবে তাহলে। কিন্তু দিনকে এক সেকেন্ডে বাড়ানো বা কমানো বা পৃথিবীকে সূর্যের চারদিকে আরও তাড়াতাড়ি ছোটানো মানুষের প্রয়োগবিদ্যার বাইরে।
বারো মাসে কেন বছরকে ভাগ করা হয়েছে? তার কারণ চাঁদ। ‘মান’ আর ‘মুন’ কথাটার উৎপত্তি এক শব্দ থেকে। বছরে বারো বারের একটু বেশি পৃথিবীকে চক্কর দেয় চাঁদ। তাই বারো মাসে বছর আমাদের হিসেবে। মাস বিভক্ত হয়েছে সপ্তাহে। প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস, রীতি-আচার আর অনুষ্ঠানের স্মৃতি টিকে আছে সপ্তাহের দিনের নামকরণে। সব ভাষায় এটা ঘটেছে।
দিনকে ভাগ করা হয়েছে চব্বিশ ঘণ্টায়, ঘণ্টাকে ষাট মিনিটে আর মিনিটকে ষাট সেকেন্ডে। আজকাল তো বেশিরভাগ লোক দশমিকে শতকে গণনা করতে অভ্যস্ত, তাহলে দিনকে দশ ঘণ্টার দুটো অংশে, ঘণ্টাকে এক শ মিনিটে আর মিনিটকে এক শ সেকেন্ডে ভাগ করলেই হয়। তাহলে ঘণ্টা আজকের চেয়ে একটু দীর্ঘ আর মিনিট ও সেকেন্ড সংক্ষিপ্ত হবে বটে, কিন্তু মেট্রিক পদ্ধতিতে সময় গণনা করার সুবিধা আছে।
এ পদ্ধতি গ্রহণ করার প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে কিন্তু কখনো কাজে লাগানো হয়নি এটিকে, কেননা তাহলে সারা পৃথিবীতে কোটি কোটি ঘড়ি বরবাদ করে নতুন ঘড়ি বানাতে হবে। কোটি কোটি বই আর পাঠ্যপুস্তক নতুন করে লিখে ছাপাতে হবে। তাই সময়-গণনার অসুবিধাজনক পদ্ধতিটা প্রাচীন ব্যাবিলন থেকে আমাদের সময় পর্যন্ত টিকে রয়েছে: ব্যাবিলনের লোকেরা ডজন আর ষাটে গুণত।
প্রাচীন কাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত লোকে নানা ধরনের ঘড়ি ব্যবহার করে আসছে। আগেকার দিনের একটা ঘড়ি ছিল সূর্যঘড়ি। মাটিতে একটা খুঁটি খাড়াভাবে পোঁতা হতো, সূর্যের সঙ্গে সঙ্গে খুঁটিকে ঘুরত তার ছায়া—সকালে আর সন্ধ্যায় দীর্ঘ ছায়া, মধ্যাহ্নে ছোট। এতে অবশ্য মিনিট ও সেকেন্ড অনুমান করার কোনো উপায় ছিল না, আর মেঘলা সূর্যহীন দিনে এ ঘড়ি ছিল অকেজো।
বালি ও জলঘড়িও প্রচলিত। একটি পাত্র থেকে অন্য পাত্রে কতটা বালি বা জল ঝরল তা থেকে সময়ের মাপ। বড়োলোকের বাড়িতে এ ঘড়ি দেখার জন্য বিশেষ দাস থাকত। সব জল বা বালি উপরের পাত্র থেকে নিচের পাত্রে পড়লে, সে পাত্র বদলে হাঁক দিত- ‘সকালের পর এতটা বেজেছে’ অনেকটা ঘণ্টাওয়ালা ঘড়ির মতো।
হাসপাতাল আর ক্লিনিকে বিভিন্ন চিকিৎসার সময় গণনার জন্য এখনো বালিঘড়ির চল আছে। অনেক পরে উদ্ভব হলো ভার ও পেন্ডুলামওয়ালা ঘড়ি। সবশেষে এল স্প্রিঙে চলা পকেটঘড়ি। বিজ্ঞানের অগ্রগতি যত প্রখর তত সঠিক হয়ে দাঁড়াচ্ছে সময়-গণনা। সারা পৃথিবীতে সঠিক সময়-সঙ্কেত জানায় রেডিও।
এত সঠিক সময় কার দরকার? সমুদ্রে তার জাহাজ ঠিক কোথায় তা জানার জন্য সঠিক সময় দরকার জাহাজের ক্যাপ্টেনের; রাত্রে বা কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় চলার সময় এটার দরকার পড়ে বিমানের দিগনির্ণকের; ইঞ্জিনিয়র ও ক্রীড়াবিদ, শিক্ষক ও ছাত্র—সবায়ের দরকার সঠিক সময়।
কিন্তু যেটাকে সঠিক সময় বলি সেটাও বিজ্ঞানীদের পক্ষে যথেষ্ট সঠিক নয়; তাঁদের আছে নিজস্ব উঁচু জাতের সঠিকতা, কেননা তাঁদের কারবার হলো সেকেন্ডের হাজার ভাগের, এমন কি লাখ লাখ ভাগের একাংশের সঙ্গে। সারা সোভিয়েত ইউনিয়নের সঠিক সময় জানায় মস্কোর স্তের্নবের্গ রাষ্ট্রীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইনস্টিটিউট আর লেনিনগ্রাদের পুল্কোভো মানমন্দির। তারাদের অবস্থিতি হিসেবে সঠিক সময় বিচারের অতি নিখুঁত যন্ত্রপাতির ডিজাইন করেছেন সোভিয়েত ইঞ্জিনিয়ার আর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।