বিজ্ঞান কল্পগল্পে কিংবা চলচ্চিত্রে অনেক সময় ভিনগ্রহের গল্প থাকে। অনেক সময় গল্পের সেই ভিনগ্রহের আকাশ হয় পৃথিবীর চেয়েও সুন্দর। দুটি সূর্য অস্ত যায় দিন শেষে। অপার্থিব সেই দৃশ্য ভিনগ্রহবাসীদের কাছে স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা দেখে, পড়ে বিস্মিত হই, আনন্দ পাই। কেমন হতো যদি আমাদেরও দুটি সূর্য অস্ত যেত প্রতিদিন? দিনের বেলা আলো ছড়াত দুটি সূর্য?
এমনটা হলে তা আমাদের কাছেও যে স্বাভাবিক মনে হতো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এর প্রভাব কেমন হতো পৃথিবীতে? তাপমাত্রা কি বাড়ত? রাতের অবস্থায় কি কোনো পরিবর্তন হতো? তার চেয়ে বড় কথা, যমজ নক্ষত্র সিস্টেমে আদৌ কি কোনো প্রাণ বাঁচতে পারে?
এসব প্রশ্নের উত্তরই জানার চেষ্টা করব আজকে। কিন্তু চাইলেই তো দুম করে আরেকটা সূর্য হাজির করা সম্ভব নয়। তবে আমাদের কাছে আছে বিজ্ঞান ও কল্পনাশক্তি। বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়েই কল্পনা করার চেষ্টা করব পুরো বিষয়টা।
আমাদের নক্ষত্র সিস্টেমটির নাম সৌরজগৎ। এখানকার একেবারে কেন্দ্রে বসে আছে নক্ষত্র, সূত্র। একাই শাসন করছে তার এই পুরো রাজত্ব। কিন্তু সব নক্ষত্র সিস্টেমের ভাগ্য এক রকম নয়। আসলে সত্যি বলতে কি, একজোড়া বা তার চেয়েও বেশি নক্ষত্র ব্যবস্থাই মহাবিশ্বে স্বাভাবিক বিষয়।
বিজ্ঞানীদের মতে বরং মহাবিশ্বে একক নক্ষত্র ব্যবস্থাটাই একটু অস্বাভাবিক। কিছু বিজ্ঞানী এমন দাবিও করেন যে আমাদের সূর্যেরও এক সহোদর নক্ষত্র ছিল। বহুকাল আগে হারিয়ে গেছে। বামন সে নক্ষত্রের নাম বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন নেমেসিস। ধারণা করা হয়, শত কোটি বছর আগে সূর্যের আকর্ষণ ছিন্ন করে হারিয়ে গেছে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির হাজারো নক্ষত্রের ভিড়ে।
অনেকদিন ধরেই গ্যালাক্সিজুড়ে বাসযোগ্য পৃথিবী খুঁজছেন বিজ্ঞানীরা। পেয়েও গেছেন প্রায় সাড়ে ৫ হাজার এক্সোপ্লানেট বা বহিঃসৌরগ্রহ। ঠিক করে বললে, এ লেখা পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া নক্ষত্রের সংখ্যা ৫ হাজার ৫১৪টি। খোঁজ চলছে এখনো। এই সাড়ে পাঁচ হাজার গ্রহের বেশিরভাগই বাইনারি নক্ষত্র সিস্টেমের। অর্থাৎ বেশির ভাগ গ্রহ থেকেই আকাশে দুটি করে সূর্য দেখা যায়। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর সমান আকারের অনেক গ্রহই ঠাঁই পেয়েছে নক্ষত্র সিস্টেমগুলোর বাসযোগ্য অঞ্চলে!
সব দেখে মনে হচ্ছে, পৃথিবীরও এমন দুটি সূর্য থাকলে খুব একটা সমস্যা হতো না। কথাটা কিছুটা সত্যি। কিন্তু শর্তসাপক্ষে।
দ্বৈতনক্ষত্র ব্যবস্থায় পৃথিবীর ভাগ্য নির্ভর করত বেশকটি বিষয়ের ওপর। যেমন নক্ষত্রের ভর, পৃথিবী থেকে নক্ষত্রদ্বয়ের অবস্থান, নিজেদের মধ্যকার দূরত্ব ইত্যাদি।
দ্বি-নক্ষত্র ব্যবস্থায় পৃথিবীর কক্ষপথ বেশ অস্থিতিশীল হওয়ার আশংকা আছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। একটি নক্ষত্রের ভর ও উজ্জ্বলতা অন্যটির চেয়ে বেশি হলে, তার মহাকর্ষ বা আকর্ষণ শক্তিও হবে বেশি। ফলে, অন্য নক্ষত্রের চেয়ে ভারী নক্ষত্রের প্রতি পৃথিবী বেশি টান অনুভব করত। এর প্রভাব পড়তো পৃথিবীর কক্ষপথে।
অন্যদিকে নক্ষত্র দুটির পৃথিবীকে ধরে রাখার মতো যথেষ্ট মহাকর্ষ বল না থাকলে পৃথিবী হারিয়ে যেত এ নক্ষত্র ব্যবস্থা থেকে। পরিণত হতো শীতল অন্ধকার ভবঘুরে গ্রহে।
আপাতত ধরা যাক পৃথিবীর কক্ষপথ স্থিতিশীল। সেজন্য অবশ্য একটি নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরতে হবে পৃথিবীকে। তবে এক্ষেত্রে পৃথিবীতে জটিল জীবন টিকতে পারত কি না, তা এক বড় প্রশ্ন। কারণ, বছরের কোনো একটা সময় পৃথিবীর সবটুকুই আলোকিত হতো দুই নক্ষত্রের আলোয়।
রাতের অস্তিত্ব তো বিলীন হবেই সে সময়, তাতে সন্দেহ নেই। সমস্যাও বেশি হবে না সেজন্য। সমস্যা হবে অতিরিক্ত অতিবেগুনি বিকিরণ ও সৌরবায়ুর জন্য। একই সময় পৃথিবীর দুইপাশেই সমানতালে পড়বে এসব ক্ষতিকর প্রভাব।
দুটি নক্ষত্রকে কেন্দ্রে রেখেও পৃথিবীর কক্ষপথ স্থিতিশীল হওয়া সম্ভব। সে জন্য নক্ষত্রদ্বয়ের অবস্থান পরস্পরের বেশ কাছাকাছি হতে হবে। পৃথিবীর কক্ষপথ হতে হবে নক্ষত্রদ্বয় থেকে অনেক দূরে। কিন্তু ‘অনেক দূরে’ আসলে কতটা?
বিজ্ঞানীদের মতে, দূরত্বটা জমজ নক্ষত্র সিস্টেমের বাসযোগ্য অঞ্চলে বাইরে। অর্থাৎ, পানি তরল অবস্থায় থাকার মতো সেখানে পর্যাপ্ত আলো ও তাপ পৌঁছাবে না। ফলাফল, পৃথিবী পরিণত হতো শীতল, প্রাণহীন পাথুরে গ্রহে।
এখনই হতাশ হবেন না। ভালো খবরও আছে কিছু। দ্বি-নক্ষত্র ব্যবস্থাতেও বাসযোগ্য অঞ্চলে পৃথিবীর কক্ষপথ স্থিতিশীল হওয়া সম্ভব। সেক্ষেত্রে নক্ষত্রদ্বয়ের সম্মিলিত ভর ও উজ্জ্বলতা আমাদের বর্তমান সূর্যের সমান হতে হতো। এ ছাড়া এদের মধ্যকার দূরত্ব হওয়া লাগতো বেশ কম। বিজ্ঞানীদের মতে দূরত্বটা ১ কোটি ৫০ লাখ কিলোমিটারের কম হলে, পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহের কক্ষপথ স্থির হতো।
দ্বৈত নক্ষত্রের সম্মিলিত মহাকর্ষ বল বেশ শক্তিশালী হওয়ার কারণে, পৃথিবীতে বছর হতো ছোট। বিজ্ঞানীদের মতে, এরকম পরিস্থিতিতে ৩৬৫ দিনের পরিবর্তে সূর্যদ্বয়ের চারপাশে পৃথিবীর সময় লাগতো মাত্র ২৮০ দিন।
আরেকটু নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ধরা যাক, নক্ষত্র দুটির মধ্যবর্তী দূরত্ব ৫০ লাখ কিলোমিটার। এ ক্ষেত্রে প্রতি ৫ দিনে একবার করে একটি নক্ষত্র অন্যটিকে প্রদক্ষিণ করতো। পৃথিবী থেকে এই ঘটনাটি দেখাতো সূর্য গ্রহণের মতো। শুধু এখানে চাঁদের জায়গায় আরেকটি সূর্য।
অন্যরকম এ সূর্যগ্রহণের সময় পৃথিবীতে অবশ্য পুরোপুরি অন্ধকার হতো না। আলোটা অর্ধেক কমে যেত। কিন্তু গ্রহণের সময়টা বেড়ে যেত অনেক বেশি। প্রায় ৬ ঘন্টা ধরে চলতো আধো আলো অবস্থা। এখন সাধারণ পূর্ণ সূর্যগ্রহণ হয় গড়ে সাড়ে ৭ মিনিটের মতো। দ্বি-নক্ষত্রের সেই জগতে প্রতি ৫ দিনে ছয় ঘন্টার জন্য চলত এ অবস্থা।
এসব শর্ত সাপেক্ষেই কেবল পৃথিবী দুটি নক্ষত্রের চারপাশে বাসযোগ্যভাবে থাকতে পারত। এখন প্রশ্ন হলো, বাইনারি নক্ষত্র ব্যবস্থায় কি পৃথিবীর মতো গ্রহের জন্ম হওয়া সম্ভব? বিজ্ঞানীরা বলছেন, সে সম্ভাবনা খুবই কম। এখন পর্যন্ত একাধিক নক্ষত্র সিস্টেমে বাসযোগ্য অঞ্চলে পাওয়া সবচেয়ে ছোট গ্রহটিও গ্যাস দানব ধরনের গ্রহ। আকারে পৃথিবীর চেয়ে অনেক বড়।
হয়তো পৃথিবীর মতো পাথুরে গ্রহ মহাবিশ্বের কোথায় ঘুরছে দুটি নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে। কিন্তু বাসযোগ্য সে গ্রহের সন্ধান আমরা এখনও পাননি। বিজ্ঞানীরা খুঁজে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতে একদিন হয়ত পাওয়া যাবে সন্ধান। তবে, শুধু সন্ধান পেলেই তো চলবে না, সেখানে যাওয়ার উপায়ও বের করতে হবে। এজন্য কিন্তু কাজ করতে পারেন আপনিও। বিজ্ঞানের দরজাটা খোলাই আছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।