একটা আবিষ্কার বদলে দিতে পারে গোটা বিশ্ব। সেই আবিষ্কারের ফল মানবজাতির জন্য বয়ে আনতে পারে সুফল বা কুফল দুটোই। কেউ ভালো কাজ করে ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়েছেন, কেউবা খারাপ কাজ করে। তবে অনেকটা আকস্মিকভাবে বড় কিছু আবিষ্কার করে মানবসভ্যতার গতিপথ বদলে দিয়েছেন এমন উদাহরণ ইতিহাসে বিরলই বলা চলে। এই বিরলদেরই একজন আলেকজান্ডার ফ্লেমিং। প্রায় নিজের অজান্তেই তিনি আবিষ্কার করেছিলেন পেনিসিলিন।
১৮৯৪ সালে আবার কিলমার্ন স্কুলে ভর্তি হন ফ্লেমিং। এক বছর পরই স্কুল ছেড়ে চলে যান লন্ডনে, বড় ভাই টমাস ফ্লেমিংয়ের কাছে। টমাস সবে পলিটেকনিকের পড়া শেষ করেছেন। কাজের সন্ধানে লন্ডনে কিছুদিন ঘোরাঘুরি করেন আলেকজান্ডার ফ্লেমিং। কিন্তু কাজ মেলেনি। অনেক কষ্টে পার করেন কিছুদিন। তারপর ১৬ বছর বয়সে জাহাজ কোম্পানিতে ছোটখাটো একটা চাকরি পান।
ফ্লেমিংয়ের বিত্তশালী নিঃসন্তান এক চাচা ছিলেন। হঠাৎ তাঁর মৃত্যুতে ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায় তাঁর। সব সম্পত্তির মালিক হন ফ্লেমিং-ভাইয়েরা। ১৯০১ সালে বড় ভাইয়ের পরামর্শে জাহাজের চাকরিটা ছেড়ে দেন। ভর্তি হন সেন্ট মায়ার্স মেডিকেল স্কুলে।
লেখাপড়া শেষে সেন্ট মেরি হাসপাতালে ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গবেষণা শুরু করেন ফ্লেমিং। কিছুদিন পর আইরিশ নার্স সারা ম্যারিয়ন ম্যাকর্লয়কে বিয়ে করে সংসার শুরু করেন। এরপর চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন সামরিক বাহিনীতে। কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। প্রতিদিন অসংখ্য আহত সৈনিক হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।
ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে ক্ষতবিক্ষত হয়ে উঠেছে তাঁদের আঘাতের চিহ্ন। প্রচলিত জীবাণুনাশক ওষুধগুলোতে কোনো কাজ হচ্ছে না। মারাত্মক ক্ষত সারাতে অক্ষম সেগুলো। তাই চোখের সামনে এসব দেখে চিকিৎসক ফ্লেমিং অনুভব করলেন শক্তিশালী কোনো ব্যাকটেরিয়ানাশকের প্রয়োজনীয়তা।
১৯১৮ সালে শেষ হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। দুই মাস পর ইংল্যান্ডে ফেরেন ফ্লেমিং। ব্যাকটেরিওলজির প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন লন্ডনের সেন্ট মেরি মেডিকেল স্কুলে। এবার সত্যিকার অর্থে শক্তিশালী জীবাণুনাশক তৈরিতে মনোযোগ দেন তিনি।
১৯২১ সালের ঘটনা। কিছুদিন ধরেই ফ্লেমিংয়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। সর্দি-কাশিতে ভুগছিলেন। একদিন প্লেটে জীবাণু নিয়ে কাজ করছেন। হঠাৎ হাঁচি দিলেন। প্লেটটা সরানোর আগেই নাক থেকে খানিকটা সর্দি গিয়ে পড়ল প্লেটের ওপর। পুরো প্লেট গেল নষ্ট হয়ে। রাগে প্লেটসহ টেবিল থেকে দূরে ফেলে রাখলেন। নতুন প্লেট নিয়ে আবার কাজ শুরু করলেন।
পরের দিন ল্যাবরেটরিতে এসেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। আগের দিনের প্লেটভর্তি জীবাণুগুলো নেই। ব্যাপার কী! তখনই আগের দিনের সর্দির কথা মনে পড়ল। তিনি ভাবলেন, হয়তো সর্দির কারণেই মারা গেছে জীবাণুগুলো। এরপর কয়েক দফায় প্লেটে সর্দি ফেলে পরীক্ষা করলেন। প্রতিবারই জীবাণুগুলো মারা যেতে দেখা গেল। তিনি জানতেন, মানুষের লালারস জীবাণুনাশক হিসেবে কাজ করে। কিন্তু সর্দিও যে একই কাজ করতে পারে, তা জানা ছিল না তাঁর।
এরপর তিনি চোখের পানি, থুতু ইত্যাদি নিয়েও পরীক্ষা করলেন। নিশ্চিত হলেন, এগুলোরও জীবাণুনাশী ক্ষমতা আছে। ফ্লেমিং নিশ্চিত হলেন এগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধের উপাদান। তিনি এর নাম দিলেন লাইসোজাইম। গ্রিক শব্দ লাইস অর্থ ধ্বংস করা। জীবণুকে ধ্বংস করে বলেই এমন নাম। কিন্তু শুধু এগুলো ব্যবহার করে শক্তিশালী কোনো জীবাণুনাশক তৈরি করতে পারেননি ফ্লেমিং।
এরপর বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। ১৯২৭ সালে ফ্লেমিং স্টেফাইলোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে লাইসোজাইম আবিষ্কারের জন্য পরিচিতি বেড়েছে তাঁর। ১৯২৮ সাল। আগস্ট মাসে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে কাজ করছেন। হঠাৎ মনে হলো ছুটি নিয়ে বাইরে ঘুরে আসা দরকার। যাওয়ার আগে একটি ভুল করে গেলেন। তাঁর সেই ভুলই বিশ্বকে বদলে দিয়েছিল।
ল্যাবরেটরিতে রেখে গিয়েছিলেন স্টেফাইলোকক্কাস ব্যাকটেরিয়ার প্লেট। কিন্তু ল্যাবরেটরির জানালাটা বন্ধ করতে ভুলে যান। দুই সপ্তাহ ছুটি কাটিয়ে ফিরে আসেন গবেষণাগারে। ল্যাবরেটরিতে ঢুকেই অবাক ফ্লেমিং। ঝোড়ো বাতাসে ল্যাবরেটরির ভেতরটা এলোমেলো হয়ে গেছে। বাইরে দমকা বাতাস উড়িয়ে এনেছে ঘাস, লতাপাতা ইত্যাদি। কিছু ঘাস এসে পড়েছে ব্যাকটেরিয়ার প্লেটেও। ফ্লেমিং লক্ষ করেন, ঘাসভর্তি একটি প্লেটে বেশ বড়সড় পরিবর্তন। ঘাসের প্রভাবে মারা গেছে প্লেটের সব ব্যাকটেরিয়া। কিন্তু কীভাবে মারা গেল?
পরীক্ষা করে দেখা গেল, সেগুলোর মধ্যে ঘাসের গায়ে একধরনের ছত্রাক আছে। নোটেটাম পেনিসিলিয়াম ছত্রাক। সেই ছত্রাকগুলো মেরে ফেলেছে জীবাণুগুলোকে। রোমাঞ্চিত হলেন ফ্লেমিং। তবে কি বহুদিনের স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে? পেয়ে গেছেন শক্তিশালী ব্যাকটেরিয়ানাশক?
এটা নিয়ে একটা গবেষণাপত্র লিখলেন ব্রিটিশ জার্নাল অব এক্সপেরিমেন্টাল প্যাথোলজিতে। সেটা বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। কিন্তু জীবাণুনাশক আবিষ্কার করলেও মানবশরীরে ব্যবহারের উপযোগী করতে পারেননি, পর্যাপ্ত রসায়নজ্ঞানের অভাবে। বহুদিন এটা নিয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য হলো না।
১৯৩৯ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো। তখন আবার প্রয়োজন হলো শক্তিশালী জীবাণুনাশকের। পেনিসিলিয়াম নিয়ে আগ্রহী হলেন জার্মান বিজ্ঞানী হাওয়ার্ড ফ্লোরি ও অস্ট্রেলিয়ান বিজ্ঞানী আর্নস্ট চেইন। নিরলস গবেষণার পর তাঁরা তৈরি করে ফেললেন ব্যাকটেরিয়ানাশক। তাঁরা এর নাম দিলেন পেনিসিলিন।
ইঁদুরের ওপর এই পেনিসিলন প্রথম প্রয়োগ করা হলো। সফলও হলো। এরপর অপেক্ষা, কবে মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা হবে। ১৯৪১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি আসে সেই সুযোগ। অক্সফোর্ডের একজন পুলিশ মারাত্মক ক্ষত নিয়ে ভর্তি হন হাসপাতালে। বাঁচার আশা নেই বললেই চলে। তাঁর শরীরেই প্রথম পেনিসিলিন প্রয়োগ করা হয়। কয়েক ঘণ্টার বিরতিতে চারবার পেনিসিলিন দিয়ে তাঁকে প্রায় সুস্থ করে তুলেছিলেন ফ্লোরি আর চেইন।
কিন্তু পর্যাপ্ত পেনিসিলিনের অভাবে তিনি মারা যান। পরে অবশ্য পেনিসিলিন ঠিকই জীবনদায়ী হয়ে ওঠে। তৈরি হয় বিশ্বের প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক। ১৯৪৩ সালে রয়েল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন ফ্লেমিং। পরের বছর পান নাইট উপাধি। ১৯৪৫ সালে হাওয়ার্ড ফ্লোরি ও আর্নস্ট চেইনের সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পান ফ্লেমিং।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।