জাফর আহমদ : ‘পড়াতে চাই’, ‘শিক্ষক দিচ্ছি’, ‘কাজী অফিস’, ‘নার্সিং হোমের’ মতো নানা কিসিমের প্রতিষ্ঠানের জীবন্ত বিল বোর্ডে পরিণত হয়েছে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের পাশে থাকা গাছগুলো। গাছের গায়ে নির্বিচারে পেরেক ও তারকাঁটা ঠুকে স্টিকার ও সাইনবোর্ড লাগানো হচ্ছে। বাঁধা হচ্ছে অ্যালুমিনিয়ামের তার ও প্লাস্টিকের রশি।
রাজধানীর মিরপুরের ১ নম্বর, ২ নম্বর, ১৩ নম্বর, ১৪ নম্বর সেকশনে দেখা যায়, প্রধান প্রধান সড়কের পাশের গাছে গাছে তারকাঁটা ও পেরেক দিয়ে ছোট ছোট সাইনবোর্ড ও স্টিকার লাগানো হয়েছে। এতে গাছগুলো ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পাশাপাশি বেড়ে ওঠায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। ক্ষেত্র বিশেষে মারাও যাচ্ছে। শত শত পেরেক ও তারকাঁটায় বিদ্ধ হয়ে যে গাছগুলো বেঁচে থাকছে, সেগুলোও বয়স ফুরানোর পর কাঠ হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রেও অনুপোযোগী হয়ে পড়ছে।
তবে যারা গাছে গাছে নির্মমভাবে স্টিকার ও সাইনবোর্ড লাগাচ্ছেন তারা বেশ নির্বিকার! তাদের প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড যে পেরেক বা তারকাটা দিয়ে লাগানো হয়েছে, সেই খবরও বুঝি জানেন না। জানলেও এতে কী বা যায় আসে—এমন ভাব তাদের।
গাছে তারকাঁটা দিয়ে লাগানো স্টিকার থেকে নম্বর নিয়ে কথা হয় স্বপ্ন নার্সিংয়ের সঙ্গে। ওপার থেকে ফোন রিসিভ করেন অভি নামে প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা। তারকাঁটা দিয়ে স্টিকার লাগানোর খবর জানেন না, রশি দিয়ে লাগানোর কথা বলে দাবি করেন তিনি।
তারকাঁটা দিয়েই স্টিকার লাগানো হয়েছে, ছবি আছে, দেখতে চান—এমন প্রশ্নের জবাবে অভি বলেন, ‘এতে আমার কিছু করার নেই। যে লাগিয়েছে দায় তার। ’ স্টিকারে তো আপনার নম্বর আছে। দোষী এখন আপনি—এমন প্রশ্ন করা হলে অভি বলেন, ‘এখন দেখবো। মালিককে জানাবো। ’
‘টিচার দিচ্ছি’ স্টিকারে থাকা ফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে ‘টিউটর প্রভাইড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের যিনি ফোন রিসিভ করেন তার নাম জান্নাতুল। তিনি গাছে তারকাঁটা দিয়ে স্টিকার লাগানোর ব্যাপারে কিছুই বলতে পারবেন না। তিনি শুধু কথা বলতে পারবেন টিউটর দেওয়া সম্পর্কিত বিষয়ে। তারকাঁটা দিয়ে সাঁটানো স্টিকারে থাকা নম্বরে আপনি রিসিভ করেছেন, প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য তো আপনিই যথার্থ ব্যক্তি। এরপর তিনি বলেন, এটা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের ব্যাপার।
তারকাঁটা দিয়ে যে স্টিকার লাগানো হয়েছে, সেখানে নম্বর আছে দেওয়া আছে সেটা আপনার। কেউ আইনের আশ্রয় নিলে আপনার সঙ্গেই কথা বলতে চাইবে—এমন কথার পর তিনি বলেন, মালিককে বিষয়টি বলবো।
টিউটর দেওয়ার আরেক প্রতিষ্ঠানের নম্বরে ফোন করা হলে আব্দুর রাজ্জাক নামে একজন বলেন, গাছে তারকাঁটা দিয়ে স্টিকার লাগানো কোনো ব্যাপারই না! দেশে বড় বড় কত কিছু হচ্ছে, আর আপনি এলেন গাছের তারকাঁটা নিয়ে? বলেই তিনি ফোনটা কেটে দেন।
গাছকে তারকাঁটা ও পেরেকে বিদ্ধ করে রাজধানীতে যারা স্টিকার লাগাচ্ছেন তারা যেমন নিরুদ্বেগ ও নিসংকোচে আছেন। তেমনি যারা গাছগুলো থাকার সুবিধাভোগী এলাকাবাসী তারাও নির্বিকার।
সাজ্জাদ হোসেন নামে মিরপুরের এক বাসিন্দা হাঁটছিলেন মিরপুরের ১৪ নম্বর থেকে কাফরুল থানা সড়ক ধরে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরের দিকে। তখন সকাল ৯টা পার হয়েছে। চৈত্রের সূর্য তখন তার তেজ ছড়ানো শুরু করেছে। সাজ্জাদ হোসেন হাঁটছিলেন পরিচ্ছন্ন ফুটপাতে থাকা সারি সারি গাছের ছায়া ধরে।
গাছগুলোতে পেরেক ও তারকাঁটা ঢুকিয়ে স্টিকার লাগানো হয়—এ বিষয়ে মন্তব্য চাওয়া হলে তিনি বলেন, এ ব্যাপরে আমি অনুভূতিহীন।
—কেন ?
—এটা বদলাতে হলে পুরো দেশটাকে বদলাতে হবে।
চোখ সরিয়ে পাশেই ফুটপাতে শুয়ে থাকা ছিন্নমূল একজনের দিকে ইশারা করে দেখান সাজ্জাদ হোসেন। যেখানে মানুষটির গায়ে কম্বল জড়িয়ে শুয়ে আছেন, ঘুমাচ্ছেন। দ্বিতীয়বার না দেখলে বোঝা যাবে না, সেখানে মানুষ শুয়ে আছে!
—কিন্তু আপনি তো পরিষ্কার ফুটপাতের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। এই ফুটপাত নষ্ট হয়ে গেলে, ছায়া না থাকলে, ফুটপাতের ওপর দিয়ে হাঁটার পরিস্থিতি না থাকলে তখন কী করবেন?
—এর মধ্যে দিয়েই হেঁটে যাবো। নিরুদ্বেগ সাজ্জাদ হোসেন জবাব দেন।
—তারপরও আপনার কিছু বলার নেই।
—আমার শরীরে পেরেক ঠুকলেও কিছু করার নেই! পারলে দৌড়ে পালাবো। সাজ্জাদ হোসেনের ভাবলেশহীন জবাব।
শুধু প্রাইভেট টিউটর, কাজী অফিস, নার্সিং হোম বা স্কুল ব্যবসায়ীরাই পেরেক, তারকাঁটা ও অ্যালুমানিয়ামের তার দিয়ে গাছগুলোকে ক্ষতবিক্ষত করছে না। সিটি কর্পোরেশনের অপরিণামদর্শী ফুটপাত সংস্কার কার্যক্রমেও গাছের ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হয় না। ফুটপাত নির্মাণের সময় গাছের নিচে প্লাস্টার করে দিলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে গাছের নিচের অংশের বেড়ে ওঠার জন্য জায়গা রাখা হয় না।
মিরপুরে ১৩ নম্বর সেকশনের এক পাশে সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসিক এলাকা ‘ন্যাম’ আবাসন। অন্যপাশে স্কলাস্টিকা স্কুল। তার পাশেই ফুটপাতের গাছে তারকাঁটা লাগিয়ে ‘পড়াইতে চাই’ লেমেনেটিং করা কাগজ ও টিনের পাতের স্টিকার। যে দোকানের সামনের গাছে তারকাঁটা লাগানো হয়েছে, সেই দোকানের মালিক কামাল হোসেন। তিনি বলেন, রাতের আঁধারে এগুলো লাগিয়ে দিয়ে যায়। একবার নিষেধ করলে রাতে এসে আবার লাগিয়ে দেয়।
বিআরটিএ-এর সামনে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কলেজ বনফুল আদিবাসী গ্রিনহার্ট কলেজ। কলেজটির সামনের গাছের অবস্থা আরও নাজুক। একটি গাছে ৫৩ বার পেরেক-তারকাঁটা এবং ১৩ বার অ্যালুমানিয়াম ও প্লাস্টিকের রশি দিয়ে স্টিকার ও সাইনবোর্ড ঝোলানো হয়েছে। পুরনো স্টিকার ও সাইনবোর্ড সরিয়ে ফেলা হলেও পেরেক, তারকাঁটা ও প্লাস্টিকের রশিগুলো গাছেই রয়ে গেছে। পেরেক ও তারকাঁটা গাছের শরীরের আরও ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। বাইরে থেকে ক্ষতটা বোঝা যাচ্ছে। তার বা প্লাস্টিকের রশিগুলো গাছগুলোকে অক্টোপাসের মতো জাপটে ধরে আছে। আর এত এত ক্ষত নিয়েও গাছগুলো অবিরাম অক্সিজেন সরবরাহ করেই যাচ্ছে।
একইভাবে স্টিকার লাগানো থেকে বাদ পড়েনি কাফরুল থানার সামনের গাছগুলোও। এ বিষয়ে কথা হয় কাফরুল থানার ডিউটি অফিসার এসআই পরিমলের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের সামনে কেউ গাছে সাইনবোর্ড লাগাতে আসে না। ডিউটি অবস্থায় এমন কাউকে পেলে তাড়া করি। কিন্তু ঠিকই রাতের আঁধারে দুই-একটা স্টিকার লাগিয়ে যায়।
মানুষ প্রতিদিন থানায় কত কত অভিযোগ নিয়ে আসে। থানার সামনের গাছে তারকাঁটা লাগিয়ে গাছগুলোতে ক্ষত সৃষ্টি করছে, গাছকে হত্যা করছে—এমন অভিযোগ নিয়ে কেউ কখনো থানায় আসেনি? এমন প্রশ্নের জবাবে এসআই পরিমল বলেন, এমন সচেতন মানুষ কেউ নেই, যিনি গাছে তারকাঁটা লাগানো নিয়ে থানায় অভিযোগ করবেন। সূত্র : বাংলানিউজ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।