আন্তর্জাতিক ডেস্ক : মানুষের জীবনে ভালোবাসা আসে নানা রূপে, নানা সময়ে। কেউ পায় পরিপূর্ণতা, কেউ আবার থেকে যায় অপূর্ণতায়। আর সেই অপূর্ণতাই কখনো কখনো গড়ে দেয় নতুন এক পথ, নতুন এক পরিচয়। পোপ ফ্রান্সিস—একজন ধর্মগুরু, একজন বিশ্বনন্দিত নেতা—তার জীবনের শুরুটা হয়েছিল এক তরুণ প্রেমিক হিসেবে, যে একদিন তার ভালোবাসায় ব্যর্থ হয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল জীবনের সবটুকু উৎসর্গ করবেন ঈশ্বরের উদ্দেশে। হ্যাঁ, পোপ ফ্রান্সিস—এই নামেই এখন তিনি পরিচিত বিশ্বজুড়ে। কিন্তু তার যাত্রার শুরুতে ছিল এক ব্যর্থ প্রেমের গল্প, যা তার জীবনকে চিরতরে বদলে দিয়েছিল।
Table of Contents
প্রেম, প্রত্যাখ্যান আর সাধনার গল্প
পোপ ফ্রান্সিস, যার প্রকৃত নাম হোর্হে মারিও বেরগোগলিও, জন্মেছিলেন আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেস শহরে। কৈশোরে তিনি প্রেমে পড়েন এক সমবয়সী মেয়ে এমিলিয়া দামন্তের প্রতি। একদিন সাহস করে তাকে একটি চিঠি লিখে দেন, যাতে ছিল একটি লাল ছাদের ঘরের আঁকা ছবি। সেই ঘরেই একদিন তারা একসঙ্গে বসবাস করবেন—এমনই স্বপ্ন ছিল তরুণ বেরগোগলিওর। চিঠিতে তিনি স্পষ্ট করে লেখেন, “তুমি যদি আমাকে বিয়ে না করো, তবে আমি ধর্মযাজক হয়ে যাব।”
কিন্তু জীবনের নির্মম বাস্তবতা তাদের ভালোবাসার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এমিলিয়ার বাবা-মা কখনোই মেনে নিতে পারেননি সেই সম্পর্ক। চিঠিটি বাবার হাতে পড়ে যাওয়ায় মারও খেতে হয় এমিলিয়াকে। এরপর শুরু হয় দূরত্ব, বাড়তে থাকে নৈঃশব্দ্য। ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়ে ফেললেও বেরগোগলিও তার প্রতিজ্ঞায় ছিলেন অটল। নিজের কথা রাখতেই তিনি প্রবেশ করেন ধর্মীয় সাধনায়।
এই ব্যর্থ প্রেমই যেন তাকে এগিয়ে দেয় এক ভিন্নতর জীবনের পথে। একদিন সেই তরুণ হয়ে ওঠেন পৃথিবীর ১২০ কোটিরও বেশি রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টানের আধ্যাত্মিক নেতা। আর এই যাত্রার পেছনে লুকিয়ে থাকে সেই একটিমাত্র চিঠি, একখানা লাল ছাদের ঘরের ছবি, আর এক হৃদয়ভাঙা প্রতিজ্ঞা।
পোপ ফ্রান্সিসের জীবনদর্শন ও ধর্মসাধনার পথ
যে মানুষ একদিন প্রেমে ব্যর্থ হয়ে ধর্মের পথ বেছে নিয়েছিলেন, তিনি কীভাবে হয়ে উঠলেন একজন মানবতাবাদী, ক্ষমাশীল এবং সামাজিক ন্যায়বিচারে বিশ্বাসী ধর্মগুরু? পোপ ফ্রান্সিসের ধর্মদর্শন ছিল সবসময়ই মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল। তার চিন্তাধারা শুধুমাত্র গির্জার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা ছড়িয়ে পড়েছিল সমাজের সব স্তরে—দরিদ্র, নিপীড়িত, প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়ানো ছিল তার অন্যতম লক্ষ্য।
২০১৩ সালে যখন তিনি পোপ নির্বাচিত হন, তখন তার বয়স ছিল ৭৬ বছর। একই বছর ৭৬-এ পৌঁছে সেই এমিলিয়াও প্রকাশ্যে আনেন তাদের গোপন প্রেমের কথা। তিনি বলেন, “আমাদের সম্পর্ক ছিল পবিত্র, কিন্তু আমার বাবা-মায়ের কারণে সেটা পূর্ণতা পায়নি।” এই বক্তব্য যেন নতুন আলোয় আলোকিত করে পোপ ফ্রান্সিসের অতীত।
তার বোন মারিয়া এলেনা বেরগোগলিও ‘দ্য টেলিগ্রাফ’কে জানান, তার ভাই কখনোই চাননি পোপ হতে। তিনি ছিলেন খুবই বিনয়ী ও অন্তর্মুখী স্বভাবের। তিনি আরও বলেন, “আমি চাইনি সে পোপ হোক। এতে করে আমাদের পরিবার আরও দূরে সরে যাবে তার থেকে।”
কিন্তু ভাগ্য অন্য কিছুই লিখে রেখেছিল। হোর্হে মারিও বেরগোগলিও হয়ে ওঠেন পোপ ফ্রান্সিস—প্রথম লাতিন আমেরিকান এবং ইউরোপের বাইরে থেকে নির্বাচিত পোপ। তার ধর্মীয় দর্শন, মানবতাবাদী মনোভাব ও সামাজিক বোধ তাকে করে তোলে বিশ্বজনীন নেতা।
ধর্মীয় দায়িত্বে মানবিক ছোঁয়া
পোপ ফ্রান্সিস ছিলেন অত্যন্ত মাটির কাছের মানুষ। ভ্যাটিকানে বিলাসবহুল বাসভবন ছেড়ে ছোট একটি অতিথিশালায় থাকতেন। নিজেই রান্না করতেন, নিজেই বাসন মাজতেন। এসবই ছিল তার বিনয়ী চরিত্রের প্রতিফলন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ধর্মের মূল চেতনাই হলো বিনয়, ভালোবাসা ও সেবাব্রত।
তিনি বারবার বলেছেন, “গির্জা যেন একটি হাসপাতালের মতো হয় যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝখানে—যেখানে সবাই এসে প্রশান্তি পাবে, আরাম পাবে।” এই দর্শনের প্রতিফলন দেখা গেছে তার পোপ পদে থাকাকালীন সময়জুড়েই। তিনি সমলিঙ্গ বিবাহ, অভিবাসী সংকট, পরিবেশ সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের মতো বিষয়েও সাহসী অবস্থান নিয়েছেন।
প্রেমের ব্যথা থেকে আধ্যাত্মিক শক্তিতে রূপান্তর
অনেকেই বলেন, পোপ ফ্রান্সিস প্রেমে ব্যর্থ হয়েছিলেন বলেই এতটা সাধনার পথে নিজেকে নিবেদিত করতে পেরেছিলেন। এটি কেবল তার ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, বরং তা হয়ে ওঠে এক প্রেরণার গল্প। যেখানে প্রত্যাখ্যান থেকে উঠে আসা এক তরুণ বদলে দেন নিজের ভাগ্য, হয়ে ওঠেন ইতিহাসে অমর এক চরিত্র।
প্রেম ও পবিত্রতার অদ্ভুত সহাবস্থান
এমিলিয়ার সঙ্গে সেই ব্যর্থ প্রেমের গল্পকে কখনোই অস্বীকার করেননি পোপ ফ্রান্সিস। বরং সেটি তার জীবনের অংশ হিসেবেই স্বীকার করে নিয়েছেন। ধর্মীয় জীবন বেছে নেওয়ার পরেও তিনি ছিলেন একজন ‘পুরো মানুষ’, যিনি অনুভব করেছেন প্রেম, প্রত্যাখ্যান, কষ্ট ও বেদনার মতো মানবিক অনুভূতি।
এটি প্রমাণ করে যে, ধর্মগুরুরাও একসময় আমাদের মতো সাধারণ মানুষ ছিলেন—ভালোবাসতেন, স্বপ্ন দেখতেন, কষ্ট পেতেন। পোপ ফ্রান্সিস যেন সেই মানবিকতারই এক জীবন্ত উদাহরণ।
পোপ ফ্রান্সিসকে ঘিরে কিছু বিরল তথ্য
- তিনি পেশায় প্রথমে ছিলেন রসায়নবিদ।
- আর্জেন্টিনার ফুটবল ক্লাব সান লোরেনজোর আজীবন সমর্থক ছিলেন।
- তার প্রিয় খাবার ছিল ইতালিয়ান পাস্তা ও মাংসবল।
- বিশাল লাইব্রেরি থাকা সত্ত্বেও তিনি সহজ ও সাধারণ জীবন পছন্দ করতেন।
পোপ ফ্রান্সিস একজন ব্যর্থ প্রেমিক ছিলেন—এটা শুনতে অবাক লাগলেও, সেই প্রেমই তাকে পরিণত করেছিল একজন মহামানব হিসেবে। ধর্মের পথে তার অসামান্য অবদান এবং মানবিক মূল্যবোধ তাকে করে তোলে একজন অনন্য নেতা। আজ তিনি না থাকলেও, তার জীবন থেকে আমরা শিখতে পারি—প্রত্যাখ্যানও কখনো কখনো হতে পারে নবজীবনের সূচনা।
❓FAQs
১. পোপ ফ্রান্সিস কে ছিলেন? পোপ ফ্রান্সিস রোমান ক্যাথলিক চার্চের ২৬৬তম পোপ ছিলেন। তার প্রকৃত নাম হোর্হে মারিও বেরগোগলিও। তিনি ২০১৩ সালে পোপ নির্বাচিত হন।
২. পোপ ফ্রান্সিস প্রেমে ব্যর্থ হয়েছিলেন কি? হ্যাঁ, কৈশোরে এমিলিয়া দামন্তে নামের এক মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন তিনি। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর তিনি ধর্মজীবন বেছে নেন।
৩. পোপ ফ্রান্সিস কীভাবে পোপ নির্বাচিত হন? ২০১৩ সালে ইউরোপের বাইরে থেকে প্রথমবারের মতো একজন পোপ নির্বাচিত হন, যিনি ছিলেন আর্জেন্টিনার নাগরিক। ভ্যাটিকান সিটির কনক্লেভে তাকে পোপ নির্বাচিত করা হয়।
৪. তার জীবনদর্শন কী ছিল? তিনি বিশ্বাস করতেন বিনয়, ভালোবাসা ও মানবিক সহানুভূতিই ধর্মের মূল। দরিদ্র, নিপীড়িত, অভিবাসী ও প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়ানোটাই ছিল তার মূল দর্শন।
৫. এমিলিয়ার সঙ্গে তার প্রেমের গল্প কবে প্রকাশ্যে আসে? ২০১৩ সালে, যখন তারা দুজনেই ৭৬ বছর বয়সে পৌঁছান, তখন এমিলিয়া প্রথমবারের মতো তাদের গোপন প্রেমের কথা প্রকাশ করেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।