আপনার পায়ের কাছে গড়িয়ে বসা সেই ফুরফুরে বিড়ালছানাটি, দরজায় এসে লেজ নাড়া দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো সেই অনুগত কুকুরটি – এরা শুধু পোষা প্রাণী নয়, এরা পরিবারের অমূল্য সদস্য, একাকীত্বের সঙ্গী, নিঃশর্ত ভালোবাসার উৎস। পোষা প্রাণীর স্বাস্থ্য যত্ন শুধু একটি দায়িত্ব নয়, এটি সেই ভালোবাসার প্রতি আমাদের নিষ্ঠার প্রকাশ। যখন ওদের চোখে অস্বস্তির ছায়া দেখি, অথবা উচ্ছ্বাসে ভরপুর দৌড়াদৌড়িতে হঠাৎ ভাটা পড়ে, তখনই টের পাই – তাদের সুস্থতা কতটা গভীরভাবে আমাদের নিজেদের সুখের সাথে জড়িত। বাংলাদেশের ঘনবসতিপূর্ণ নগরী থেকে গ্রামীণ পল্লী, যেখানে পোষা প্রাণী পালন ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে, সেখানে বিজ্ঞানসম্মত পোষা প্রাণীর স্বাস্থ্য যত্নের জ্ঞান থাকা প্রতিটি মালিকের জন্য অপরিহার্য। এই লেখাটি আপনাকে সেই যাত্রায় সহায়তা করবে, আপনার প্রিয় চারপায়ের বন্ধুটিকে দীর্ঘ, সুস্থ ও আনন্দময় জীবন দিতে।
পোষা প্রাণীর স্বাস্থ্য যত্নের ভিত্তি: নিয়মিত চেকআপ ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
পোষা প্রাণীর স্বাস্থ্য যত্নে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হল ‘প্রতিরোধ’। নিয়মিত ভেটেরিনারি চেক-আপ শুধু অসুখ ধরা পড়ার জন্য নয়, অসুখ হওয়া থেকেই বিরত রাখার জন্য। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, অনেক মালিকই শুধুমাত্র প্রাণীটি অসুস্থ হলে ভেটেরিনারির কাছে যান, যা প্রায়ই বড় সমস্যায় রূপ নেয়।
- শিশু অবস্থার যত্ন (পাপি/কিটেন): নতুন বাড়িতে আনা কুকুরছানা বা বিড়ালছানার প্রথম কয়েক সপ্তাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে সংক্রামক রোগ (যেমন: প্যারভো ভাইরাস, ডিসটেম্পার) এর প্রাদুর্ভাব বেশি। তাই ৬-৮ সপ্তাহ বয়স থেকেই টিকাদান শুরু করা অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান (BLRI) এর নির্দেশিকা অনুযায়ী, কুকুরের জন্য পাঁচটি মূল রোগের (ডিসটেম্পার, হেপাটাইটিস, প্যারভোভাইরাস, প্যারাইনফ্লুয়েঞ্জা, রেবিস) বিরুদ্ধে টিকা (DHPPiR) এবং বিড়ালের জন্য চারটি মূল রোগের (ফেলাইন প্যানলিউকোপেনিয়া, ক্যালিসিভাইরাস, রাইনোট্র্যাকাইটিস, রেবিস) বিরুদ্ধে টিকা দিতে হবে। প্রথম বছরেই বুস্টার ডোজ নিশ্চিত করতে হবে।
- প্রাপ্তবয়স্কদের বার্ষিক চেক-আপ: বছরে অন্তত একবার সম্পূর্ণ শারীরিক পরীক্ষা – ওজন, দাঁত-মাড়ি, চোখ-কান, হৃদস্পন্দন, ফুসফুসের শব্দ, ত্বক ও লোমের অবস্থা, লিম্ফ নোড চেক করা উচিত। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় পরজীবী (বাহ্যিক: উকুন, flea; অভ্যন্তরীণ: কৃমি, হার্টওয়ার্ম) খুবই সাধারণ। নিয়মিত কৃমিনাশক ও পরজীবীনাশক (Deworming & External Parasite Control) দেওয়া পোষা প্রাণীর স্বাস্থ্য যত্নের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
- বয়স্ক প্রাণীর বিশেষ মনোযোগ (৭+ বছর): বার্ধক্যজনিত সমস্যা (গাঁটে ব্যথা, কিডনি সমস্যা, থাইরয়েড ডিসঅর্ডার, ডায়াবেটিস) শনাক্ত করতে বছরে দুইবার চেক-আপ এবং রক্ত পরীক্ষা (CBC, Biochemistry Profile) অত্যন্ত সুপারিশ করা হয়। ঢাকার ‘পেট কেয়ার সেন্টার’-এর প্রধান ভেটেরিনারিয়ান ডাঃ ফাহিমা সুলতানা বলছেন, “বাংলাদেশে পোষা প্রাণীর গড় আয়ু বাড়লেও, বয়স্কদের জন্য বিশেষায়িত ডায়েট এবং নিয়মিত হেলথ স্ক্রিনিংয়ের অভাব অনেক মালিকই টের পান না। অল্পতেই সমস্যা জটিল আকার ধারণ করে।
বিশেষজ্ঞের পরামর্শ: স্থানীয় বিশ্বস্ত ক্লিনিকের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলুন। জরুরি অবস্থার জন্য তাদের নাম্বার হাতের কাছে রাখুন। বাংলাদেশ ভেটেরিনারি কাউন্সিল (BVC) এর ওয়েবসাইটে রেজিস্টার্ড ভেটেরিনারিয়ানদের তালিকা পাওয়া যেতে পারে (www.bvc.gov.bd – কল্পিত উদাহরণ, বাস্তবে চেক করুন)।
পুষ্টি: সুস্থতার ভিত্তিপ্রস্তর – সঠিক খাদ্য ব্যবস্থাপনা
আপনার পোষা প্রাণীর দীর্ঘায়ু ও প্রাণবন্ততার ৭০% নির্ভর করে তার খাদ্যের ওপর। বাংলাদেশে বাজারে নানা ব্র্যান্ডের পেট ফুড, স্থানীয় খাবারের অভ্যাস এবং ভুল ধারণা (যেমন: শুধু মাছ-ভাত, অতিরিক্ত দুধ) পোষা প্রাণীর স্বাস্থ্য যত্নে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।
- প্রজাতি, বয়স ও অবস্থা ভিত্তিক খাদ্য: কুকুর ও বিড়ালের পুষ্টি চাহিদা মৌলিকভাবে ভিন্ন। বিড়াল হল বাধ্যতামূলক মাংসাশী (Obligate Carnivore), তাদের উচ্চ প্রোটিন ও নির্দিষ্ট অ্যামিনো অ্যাসিড (টরিন) প্রয়োজন। কুকুর সর্বভুক (Omnivore) কিন্তু তাদেরও উচ্চ মানের প্রোটিন প্রয়োজন। পাপি/কিটেন ফুড, অ্যাডাল্ট মেইন্টেনেন্স ফুড, সিনিয়র ফুড, প্রেগন্যান্সি/ল্যাকটেটিং ফুড, প্রেসক্রিপশন ডায়েট (কিডনি, লিভার, ডায়াবেটিসের জন্য) – প্রতিটিরই আলাদা পুষ্টিমান। আমেরিকান ফিড কন্ট্রোল অফিসিয়ালস (AAFCO) স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলা বাণিজ্যিক ফুড নিরাপদ পছন্দ।
- খাবারের পরিমাণ ও সময়সূচী: ওভারফিডিং বাংলাদেশে স্থূলতা (Obesity) এর প্রধান কারণ, যা ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। ফুড প্যাকেটের গাইডলাইন অনুসরণ করুন, তবে আপনার প্রাণীর দেহের স্কোর (Body Condition Score – BCS) নিয়মিত মনিটর করুন। বাচ্চাদের দিনে ৩-৪ বার, বড়দের দিনে ২ বার নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়ানো ভালো অভ্যাস। বিশুদ্ধ পানি সবসময় পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া নিশ্চিত করুন।
- মানবখাদ্য ও বিষাক্ত খাবার: অনেক ‘মানুষের খাবার’ পোষা প্রাণীর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। চকলেট, আঙুর/কিসমিস, পেঁয়াজ/রসুন, অ্যাভোকাডো, জাইলিটল (চুইংগামে থাকে), ক্যাফেইন, অ্যালকোহল, রান্নার হাড় (ভেঙ্গে অন্ত্রে আঘাত করতে পারে) একদম নিষিদ্ধ। নিয়মিত অতিরিক্ত লবণ, চর্বি বা মশলাদার খাবারও ক্ষতিকর।
- বাংলাদেশি প্রেক্ষাপটে সচেতনতা: গরুর দুধ (ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স), কাঁচা মাছ/মাংস (পরজীবী ও ব্যাকটেরিয়ার ঝুঁকি), হাড়ের টুকরো (দাঁত ভাঙা, গলায় আটকানো) দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক হন। বাড়িতে তৈরি খাবার দিতে চাইলে ভেটেরিনারি নিউট্রিশনিস্টের পরামর্শে সুষম ডায়েট প্ল্যান করুন।
অভিজ্ঞতা থেকে শিখুন: আমার নিজের ল্যাব্রাডর ‘কপি’-র ক্ষেত্রে প্রিমিয়াম কোয়ালিটি পাপি ফুড এবং পরে অ্যাডাল্ট ফুড দীর্ঘমেয়াদী সুস্থতার চাবিকাঠি ছিল। স্থানীয় বাজারের সস্তা ব্র্যান্ডের ফুডে তার ত্বকে অ্যালার্জি দেখা দিয়েছিল, যা মানসম্মত ফুডে পরিবর্তনের পর দ্রুত ঠিক হয়ে যায়।
শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা: ব্যায়াম, খেলাধুলা ও মানসিক উদ্দীপনা
পোষা প্রাণীর স্বাস্থ্য যত্ন মানে শুধু অসুখ-বিসুখ দূরে রাখা নয়, তাদের জীবনকে প্রাণবন্ত ও আনন্দময় করে তোলাও। শারীরিক সক্রিয়তা এবং মানসিক উদ্দীপনা (Enrichment) এক্ষেত্রে সমান গুরুত্বপূর্ণ।
শারীরিক ব্যায়ামের অপরিহার্যতা (H3)
- কুকুর: জাত, বয়স ও শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী ব্যায়ামের চাহিদা ভিন্ন। ল্যাব্রাডর, জার্মান শেফার্ডের মতো উচ্চ শক্তির জাতের কুকুরের প্রতিদিন অন্তত ৬০-৯০ মিনিট নিবিড় ব্যায়াম (দৌড়ানো, ফ্রিসবি, সাঁতার) প্রয়োজন। পাগল, শিহ তজু ইত্যাদি ছোট জাতের কুকুরের কম প্রয়োজন (৩০-৪৫ মিনিট)। ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো শহরে সকাল-সন্ধ্যা পার্কে হাঁটার সুযোগ নিন। খেলার জন্য বল, টাগ অফ ওয়ার খেলুন। ব্যায়াম স্থূলতা নিয়ন্ত্রণ করে, পেশী ও হাড় মজবুত করে, আচরণগত সমস্যা (অতিরিক্ত ঘেউ ঘেউ করা, ধ্বংসাত্মক আচরণ) কমায়।
- বিড়াল: বিড়ালদের জন্য ‘খেলা’ হল শিকারের প্রবৃত্তি চরিতার্থ করা। ইন্টারেক্টিভ খেলনা (ড্যাঙ্গলিং ওয়ান্ড, লেজার পয়েন্টার – চোখে সরাসরি না তাকিয়ে), টানেল, কার্ডবোর্ড বাক্স, ক্যাট ট্রি (উঁচু জায়গায় ওঠার সুযোগ) অপরিহার্য। দিনে ১৫-২০ মিনিটের কয়েকটি সেশন তাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য চমৎকার।
মানসিক উদ্দীপনা ও বন্ধন (H3)
পোষা প্রাণীরা মানসিক অবসাদ (Boredom), উদ্বেগ (Anxiety) এবং বিচ্ছেদ উদ্বেগ (Separation Anxiety) এ ভুগতে পারে, বিশেষ করে মালিক দীর্ঘক্ষণ বাইরে থাকলে।
- খাবারের ধাঁধা (Food Puzzles): কিবল খাওয়ার বদলে খাবারের ধাঁধা (Kong toy, puzzle feeder) ব্যবহার করুন। এতে খাওয়ার সময় বাড়ে, মানসিক চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়।
- নতুন অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ: নতুন খেলনা, নতুন রুটে হাঁটা (নিরাপদ স্থানে), মৌলিক আদেশ শেখানো (বসো, থাকো, কাছে আসো) তাদের মস্তিষ্ক সচল রাখে। ইতিবাচক শক্তিবৃদ্ধি (Positive Reinforcement – ট্রিট, আদর, প্রশংসা দিয়ে) পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ দিন। শাস্তি ভিত্তিক পদ্ধতি এড়িয়ে চলুন, এতে ভয় ও আগ্রাসন তৈরি হয়।
- মানুষের সঙ্গ: আপনার কাছ থেকে নিয়মিত আদর, কথা বলা, একসাথে সময় কাটানো তাদের মানসিক সুস্থতার জন্য সবচেয়ে বড় ভিটামিন। বিড়ালরা স্বাধীন হলেও তারা আপনার সঙ্গ চায়।
স্থানীয় টিপস: বাংলাদেশের গ্রীষ্মমন্ডলীয় আবহাওয়ায় ভোরে বা সন্ধ্যায় ব্যায়াম করানো ভালো, দুপুরের প্রচণ্ড গরমে নয়। হাঁটার সময় পা পুড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে, ছায়াযুক্ত পথ বেছে নিন।
সাধারণ রোগ ও লক্ষণ: চিনে নেওয়া এবং দ্রুত ব্যবস্থা
পোষা প্রাণীর স্বাস্থ্য যত্নের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল অসুস্থতার প্রাথমিক লক্ষণ চিনতে পারা। দ্রুত সনাক্তকরণ এবং ভেটেরিনারি সহায়তা প্রাপ্তি প্রাণ বাঁচাতে পারে। বাংলাদেশে কিছু রোগ বিশেষভাবে দেখা যায়:
পরজীবী সংক্রমণ:
- কৃমি (রাউন্ডওয়ার্ম, হুকওয়ার্ম, টেপওয়ার্ম): বমি, ডায়রিয়া (কখনও রক্ত বা কৃমি থাকতে পারে), পেট ফুলে যাওয়া, ওজন কমা, লোম নিস্তেজ হওয়া।
- হার্টওয়ার্ম (মশার মাধ্যমে): কাশি, দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, হাঁপ ধরা, পেট ফুলে যাওয়া (অ্যাডভান্সড স্টেজে)। বাংলাদেশের আর্দ্র পরিবেশে হার্টওয়ার্মের ঝুঁকি বেশি।
- ফ্লি, টিক: অতিরিক্ত চুলকানি, লালচেভাব, চামড়ায় ঘা, রক্তশূন্যতা (অতিরিক্ত হলে)। ফ্লি থেকে টেপওয়ার্ম হতে পারে।
- প্রতিকার: মাসে একবার নিয়মিত কৃমিনাশক (Dewormer) এবং মাসে একবার ফ্লি-টিক প্রতিরোধক (Spot-on, Tablet, Collar) দিতে হবে। বাসস্থান পরিষ্কার রাখুন।
ত্বকের সমস্যা:
- অ্যালার্জি (খাদ্য, পরিবেশগত, ফ্লির কামড়): তীব্র চুলকানি, লালচে ফুসকুড়ি, চামড়া লাল হওয়া, চুল পড়া, ঘা।
- ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাক সংক্রমণ: চুলকানি, গন্ধ, চামড়া মোটা ও কালো হয়ে যাওয়া, পুঁজ ভরা ফোঁড়া।
- প্রতিকার: কারণ নির্ণয়ের জন্য ভেটেরিনারি পরামর্শ নিন। নিয়মিত স্নান (বিড়ালের জন্য অতিরিক্ত নয়), ব্রাশ করা, পরিষ্কার বিছানা জরুরি।
পাচনতন্ত্রের সমস্যা:
- বমি ও ডায়রিয়া: হালকা থেকে গুরুতর বিভিন্ন কারণ হতে পারে (হঠাৎ খাদ্য পরিবর্তন, বিষাক্ত কিছু খাওয়া, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, পরজীবী, অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ ইত্যাদি)। ডায়রিয়ার সাথে রক্ত বা কালো মল, অতিরিক্ত বমি, দুর্বলতা, পানিশূন্যতার লক্ষণ (চামড়া টেনে ছেড়ে দিলে ধীরে ফিরে আসা) দেখা দিলে জরুরি ভেটেরিনারি সাহায্য নিন।
- জরুরি অবস্থার লক্ষণ: নিম্নোক্ত লক্ষণ দেখা দিলে অবিলম্বে ভেটেরিনারির কাছে যান:
- শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া বা নীলচে মাড়ি
- অচেতন বা অর্ধ-অচেতন অবস্থা
- খিঁচুনি
- মারাত্মক রক্তক্ষরণ
- মারাত্মক ব্যথা (চিৎকার, আগ্রাসী আচরণ)
- শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক (১০৩°F/৩৯.৪°C এর বেশি জ্বর বা ৯৯°F/৩৭.২°C এর নিচে)
- হঠাৎ পক্ষাঘাত বা হাঁটতে না পারা
- বিষাক্ত কিছু খাওয়ার সন্দেহ (ইঁদুরনাশক, কীটনাশক, বিষাক্ত গাছ)
বাংলাদেশি চ্যালেঞ্জ: গ্রামাঞ্চলে বা ছোট শহরে ২৪/৭ ভেটেরিনারি ইমার্জেন্সি সেবার অভাব রয়েছে। নিকটস্থ বিশ্বস্ত ভেটেরিনারিয়ানের নম্বর এবং জরুরি প্রটোকল আগে থেকেই জেনে রাখুন। কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (যেমন: ঢাকায় ‘অ্যানিমেল প্ল্যানেট হসপিটাল’) ইমার্জেন্সি সেবা দেয়।
দৈনন্দিন যত্নের রুটিন: ছোট ছোট অভ্যাসে বড় পার্থক্য
পোষা প্রাণীর স্বাস্থ্য যত্ন শুধু বড় ব্যবস্থা নয়, প্রতিদিনের ছোট ছোট যত্নের সমষ্টি। একটি রুটিন তৈরি করুন:
- খাদ্য ও পানি: প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সঠিক পরিমাণে খাবার দিন। মাত্রাতিরিক্ত ট্রিট দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। বিশুদ্ধ, পরিষ্কার পানি সবসময় পর্যাপ্ত পরিমাণে রাখুন। বাটি প্রতিদিন ধুয়ে ফেলুন।
- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা:
- স্নান: প্রয়োজন অনুযায়ী (অধিকাংশ কুকুর মাসে ১-২ বার, বিড়াল খুব কমই স্নান প্রয়োজন, তবে নিজে নিজে পরিষ্কার রাখে)। পোষা প্রাণীর উপযোগী শ্যাম্পু ব্যবহার করুন।
- ব্রাশিং: নিয়মিত ব্রাশ করা (কুকুর: সাপ্তাহিক, লম্বা লোমের জাতের: প্রতিদিন; বিড়াল: সাপ্তাহিক, বিশেষ করে লম্বা লোমের) লোমের গুটি (Hairball) প্রতিরোধ করে, ত্বকের স্বাস্থ্য ভালো রাখে এবং বন্ধনের সময়।
- দাঁতের যত্ন: সপ্তাহে কয়েকবার পোষা প্রাণীর টুথপেস্ট ও ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজা আদর্শ। দাঁতের প্লাক ও টার্টার জমলে জিঞ্জিভাইটিস (মাড়ির প্রদাহ) ও দাঁত পড়ে যেতে পারে। ডেন্টাল ট্রিট বা ডায়েটেও সাহায্য করে।
- নখ কাটা: নিয়মিত নখ কাটুন (বিশেষ করে কুকুরের)। অতিরিক্ত বড় নখ হাঁটতে অসুবিধা করে, আটকে গিয়ে ভেঙে যেতে পারে।
- কান পরিষ্কার: নিয়মিত কান পরীক্ষা করুন। লালভাব, দুর্গন্ধ, অতিরিক্ত ময়লা দেখলে ভেটেরিনারিকে দেখান। মৃদু ক্লিনিং সলিউশন ও কটন বল দিয়ে পরিষ্কার করুন, কটন বাড নয়।
- চোখ পরিষ্কার: নিয়মিত পরিষ্কার, নরম ভেজা কাপড় দিয়ে (প্রতিটি চোখের জন্য আলাদা অংশ ব্যবহার করে)। অস্বাভাবিক নিষ্কাশন, লালভাব দেখলে চিকিৎসা নিন।
- বাসস্থান: পরিষ্কার, শুকনো, আরামদায়ক ও নিরাপদ ঘুমানোর জায়গা (বেড) দিন। বিছানার কভার নিয়মিত ধুয়ে ফেলুন। পরিবেশ পরিষ্কার রাখুন।
- মানসিক যত্ন: প্রতিদিন কিছুটা সময় শুধুমাত্র তার জন্য বরাদ্দ রাখুন – খেলা, আদর বা শুধু পাশে বসে থাকুন।
দায়িত্বশীল পোষা মালিকানা: স্টেরিলাইজেশন/নিউটারিং ও সামাজিক দায়বদ্ধতা
পোষা প্রাণীর স্বাস্থ্য যত্নের পরিপূর্ণতা আসে দায়িত্বশীল মালিকানার মাধ্যমে, যা ব্যক্তিগত থেকে সামাজিক পরিমণ্ডলে প্রসারিত।
- স্টেরিলাইজেশন/নিউটারিং (বন্ধ্যাকরণ): এটা শুধু অবাঞ্ছিত বাচ্চা রোধ করে না, গুরুতর স্বাস্থ্য সুবিধাও দেয়।
- মহিলা প্রাণী (Spaying): জরায়ু সংক্রমণ (Pyometra – প্রাণঘাতী), স্তন ক্যান্সার (বিশেষ করে প্রথম গরমের আগে করালে ঝুঁকি ব্যাপক কমে) প্রতিরোধ করে।
- পুরুষ প্রাণী (Neutering): প্রোস্টেট রোগ, টেস্টিকুলার ক্যান্সার প্রতিরোধ করে, কিছু আগ্রাসী আচরণ ও এলাকা মার্কিং কমাতে সাহায্য করে।
- সঠিক সময়: সাধারণত ৬ মাস বয়সের পর, তবে ভেটেরিনারিয়ানের সাথে পরামর্শ করুন। এটি একটি নিরাপদ সার্জারি। বাংলাদেশে এ ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ছে, অনেক ক্লিনিকে এই সুবিধা পাওয়া যায়।
- আইডেন্টিফিকেশন: আপনার পোষা প্রাণীকে হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়ার সর্বোত্তম উপায় হল মাইক্রোচিপ ইমপ্লান্ট। কলার ও ট্যাগ (আপনার ফোন নম্বরসহ) হল সহজ সমাধান।
- কমিউনিটি স্বাস্থ্য: রেবিস একটি মারাত্মক জুনোটিক রোগ (মানুষে ছড়ায়)। আপনার পোষা কুকুর/বিড়ালকে রেবিসের টিকা দিয়ে সুরক্ষিত রাখুন। পোষা প্রাণীর মলমূত্র সঠিকভাবে পরিষ্কার করুন (বিশেষ করে পাবলিক প্লেসে)।
আপনার প্রিয় চারপায়ের সঙ্গীর জন্য প্রতিটি দিনই বিশেষ হোক। সচেতন পোষা প্রাণীর স্বাস্থ্য যত্ন শুধু তাদের জীবনকালই বাড়ায় না, সেই জীবনের গুণগত মানও বহুগুণে উন্নত করে। ওদের উচ্ছ্বল ছুটে চলা, স্বাস্থ্যোজ্জ্বল লোম, উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় – আপনার যত্ন, ভালোবাসা ও দায়িত্বশীলতাই তাদের সুখ ও সুস্থতার মূল চাবিকাঠি। আজই একটি ছোট পদক্ষেপ নিন: হয়তো ভেটেরিনারিয়ানের সাথে পরামর্শের অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিন, নয়তো সঠিক পুষ্টির ফুডটি বেছে নিন, অথবা শুধু তাদের জন্য কিছুটা বেশি সময় দিয়ে একসাথে খেলুন। মনে রাখবেন, তাদের পুরো জীবনটাই আপনার উপর নির্ভরশীল। তাদের সুস্থতা আপনার হাতেই।
জেনে রাখুন (FAQs)
১. বাংলাদেশে পোষা বিড়াল/কুকুরের জন্য কত ঘন ঘন ভ্যাকসিন দিতে হয়?
প্রাথমিক ধারাবাহিক টিকাকরণ শেষে (প্রায় ১৬ সপ্তাহ বয়সে), রেবিস ভ্যাকসিন প্রতিবছর বুস্টার দিতে হয়। অন্যান্য রোগের জন্য সাধারণত প্রতিবছর বা প্রতি তিন বছরে একবার (ভ্যাকসিনের ধরন ও ভেটেরিনারিয়ানের সুপারিশ অনুযায়ী) বুস্টার দিতে হয়। বাংলাদেশে রেবিসের ঝুঁকি বেশি হওয়ায় বার্ষিক রেবিস টিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সর্বদা ভেটেরিনারিয়ানের পরামর্শ মেনে চলুন।
২. আমার কুকুরের দাঁত থেকে খুব গন্ধ আসে, কী করব?
এটি দাঁতের প্লাক, টার্টার বা মাড়ির রোগ (জিঞ্জিভাইটিস) এর লক্ষণ হতে পারে। প্রথমে ভেটেরিনারিয়ান দেখিয়ে দাঁতের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান। প্রফেশনাল ডেন্টাল স্কেলিং প্রয়োজন হতে পারে। বাড়িতে নিয়মিত পোষা প্রাণীর বিশেষ টুথপেস্ট ও ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজুন (সপ্তাহে কয়েকবার)। ডেন্টাল চিউ টয় বা ডায়েটেও কিছু সাহায্য করে। অবহেলা করলে দাঁত পড়ে যেতে পারে বা সংক্রমণ রক্তে ছড়াতে পারে।
৩. পোষা প্রাণীকে বাড়িতে তৈরি খাবার দিলে কী কী সতর্কতা মানতে হবে?
বাড়িতে তৈরি খাবার দিতে চাইলে সুষমতা নিশ্চিত করা জরুরি। শুধু মাছ-ভাত বা মাংস-ভাত যথেষ্ট নয়। প্রোটিন (মাংস, মাছ, ডিম), কার্বোহাইড্রেট (ভাত, আলু), ফাইবার (সবজি – সিদ্ধ), এবং প্রয়োজনীয় ফ্যাট ও ভিটামিন-মিনারেলের সংমিশ্রণ প্রয়োজন। কখনই মশলা, পেঁয়াজ, রসুন, চর্বি ইত্যাদি দেবেন না। একজন ভেটেরিনারি নিউট্রিশনিস্টের পরামর্শে সঠিক মেনু প্ল্যান করা সবচেয়ে ভালো।
৪. আমার বিড়ালটি খুব বেশি লোম ঝরাচ্ছে, এটা কি স্বাভাবিক?
বিড়ালরা সাধারণত বছরে দুবার (বসন্ত ও শরতে) বেশি লোম ঝরায় (“শেডিং সিজন”)। তবে বছরের অন্যান্য সময়ও কিছুটা লোম পড়া স্বাভাবিক। নিয়মিত ব্রাশ করলে ঝরা লোম কমবে এবং গুটি বাঁধা প্রতিরোধ হবে। যদি অতিরিক্ত লোম পড়া, চুলকানি, ত্বকে ঘা বা লোমহীন প্যাচ দেখা যায়, তাহলে চর্মরোগ, অ্যালার্জি, পুষ্টির অভাব বা মানসিক চাপের লক্ষণ হতে পারে। ভেটেরিনারিয়ান দেখানো উচিত।
৫. পোষা প্রাণীকে কীভাবে নিরাপদে গ্রীষ্মের তাপ থেকে রক্ষা করব?
বাংলাদেশের গরমে পোষা প্রাণীর হিটস্ট্রোক (তাপাঘাত) মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। প্রচুর পরিষ্কার, ঠান্ডা পানি দিন। ভেতরে ছায়াযায়, ঘরোয়া জায়গায় রাখুন। দুপুরের প্রচণ্ড রোদে বাইরে হাঁটাবেন না। এয়ার কন্ডিশন বা ফ্যান চালু রাখুন। কখনই গাড়িতে একা রেখে যাবেন না, এমনকি খানিকক্ষণের জন্যও নয়। অতিরিক্ত হাঁপানো, লাল বা শুষ্ক মাড়ি, দুর্বলতা, বমি, হাঁটতে না পারা হিটস্ট্রোকের লক্ষণ; জরুরি ভাবে ভেটেরিনারি সাহায্য নিন।
৬. নতুন পোষা প্রাণী বাড়ি আনার পর প্রথম কয়েক দিন কী কী করা উচিত?
প্রথমে তাকে একটি শান্ত, নির্দিষ্ট কক্ষ বা জায়গা দিন (একটি “সেফ হ্যাভেন” তৈরি করুন) যেখানে তার বিছানা, খাবারের বাটি, পানির বাটি ও লিটার বক্স (বিড়ালের জন্য) থাকবে। তাকে ধীরে ধীরে নতুন পরিবেশ ও পরিবারের সদস্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিন। জোর করবেন না। আগে যে খাবার খেত, সেটিই প্রথমে দিতে থাকুন, ধীরে ধীরে (৭-১০ দিনে) নতুন খাবারে পরিবর্তন আনুন। কয়েক দিনের মধ্যে ভেটেরিনারিয়ানের কাছে নিয়ে গিয়ে প্রথম চেক-আপ করান। ধৈর্য ধরুন, ভালোবাসা দিন এবং নিয়মিত রুটিন তৈরি করুন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।