নিজস্ব প্রতিবেদক, গাজীপুর: গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভা গঠিত হয়েছে ২০০০ সালে। সেই সময় থেকে টানা মেয়র ছিলেন আনিছুর রহমান। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি চলে গেছেন অজ্ঞাতবাসে। এখন খোঁজ নিয়ে দেখা যাচ্ছে, পৌরসভার রাজস্বের কোটি কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে নিজের পকেটে ভরেছেন তিনি। বার্ষিক অডিট প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
৪৬ দশমিক ৯৭ বর্গকিমির শ্রীপুর পৌরসভা ৯টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত। বর্তমানে এর জনসংখ্যা ৯২ হাজার ৬৮৩ জন। পৌরসভাটি কাগজ-কলমে প্রথম শ্রেণির। শিল্পকারখানাসমৃদ্ধ পৌরসভাটির রাজস্ব আয় গড়ে প্রতিবছর ৫০ কোটি টাকার বেশি। এই পৌরসভার মেয়র ছিলেন আনিছ। জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হওয়ার সুবাদে মেয়র আনিছ পৌরসভায় ছিলেন একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিপতি। দলীয় ক্ষমতার কারণে সরকারি কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেননি। প্রতিবছর পৌরসভার হাট-বাজার ইজারার ভ্যাট, আয়কর ও জামানত বাবদ আদায় করা টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে রাজস্ব আত্মসাৎ করেছেন। বিভিন্ন অর্থবছরের অডিট প্রতিবেদনে এর প্রমাণ পাওয়া যায়।
সর্বশেষ শ্রীপুর পৌরসভার ২০২২-২৩ অর্থবছরের অডিটেও রাজস্ব খাতের প্রায় পৌনে ২ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে আত্মসাতের চিত্র উঠে এসেছে। স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন অধিদপ্তরের অডিটের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, হাট-বাজারে ইজারাসংক্রান্ত নথি, আদায় রেজিস্টার, ক্যাশ বই, রসিদ বই ইত্যাদি পর্যালোচনায় দেখা যায়, হাট-বাজারের ইজারার বিপরীত আদায়কৃত মোট আয় থেকে সরকারি বিধি অনুযায়ী কেটে রাখা আয়কর, ভ্যাট বাবদ প্রায় পৌনে ২ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা করা হয়নি।
এ বিষয়ে শ্রীপুর পৌর সচেতন নাগরিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম বলেন, ‘আমরা বহু বছর ধরে পৌরসভার নানা অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে কথা বলে আসছি। অনিয়মের কারণে পৌরবাসী নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কোথাও উন্নয়ন হচ্ছে না। আমরা প্রত্যাশা করি, যারা এসব অনিয়ম দুর্নীতিতে যুক্ত, তাদের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।’
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের হাট-বাজার ইজারার প্রাপ্ত অর্থ থেকে আদায়কৃত ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা না করায় ৬ লাখ ৭৬ হাজার ২০০ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। একই খাতের মোট মূল্যের বিপরীতে ১০ শতাংশ হারে আদায়কৃত আয়কর সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে সরকারের সাড়ে ৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
অডিট প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, স্থানীয় সরকার বিভাগের ২০১১ সালে জারিকৃত ৮৭০ নম্বর পরিপত্র অনুযায়ী, হাট-বাজার ইজারা থেকে প্রাপ্ত অর্থের ৫ শতাংশ সেলামিস্বরূপ আদায়ের টাকা অদ্যাবধি জমা না করায় সরকারের প্রায় সোয়া ২ লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। একই খাতের বিধান অমান্য করে হাট-বাজার ইজারা থেকে প্রাপ্ত অর্থের ৪ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ তহবিলে জমা না করায় আর্থিক ক্ষতি ৪ লাখ টাকার বেশি। একই অর্থবছরে পৌরসভা কর্তৃক বিভিন্ন বিল প্রদানের সময় ভ্যাট কর্তন করা হয়েছে। তবে তা সরকারি কোষাগারে জমা হয়নি। এতে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে ৫ লাখ টাকার বেশি।
অপর দুটি অডিট আপত্তিতে বলা হয়েছে, পূর্ত কাজের নথি রেজিস্টার, পরিশোধিত বিল, ভাউচার ও অন্যান্য রেকর্ড পর্যালোচনায় দেখা যায়, ঠিকাদারদের বিল থেকে নির্দেশনা মেনে সরকারিভাবে ভ্যাট কর্তন করা হয়েছে। কিন্তু নির্দেশনা মেনে ঠিকাদারদের বিল থেকে কর্তনকৃত মূসক সরকারি কোষাগারে জমা না করায় সরকারের প্রায় ১৮ লাখ টাকা এবং অপর একটি আপত্তিতে প্রদত্ত বিভিন্ন বিলের বিপরীতে কেটে রাখা ভ্যাট জমা না করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৭ লাখ টাকা। এ ছাড়া ২০১৯-২০২০ ও ২০২২-২৩ অর্থবছর মিলিয়ে এমন আরও দুই কোটি টাকা আত্মসাতের তথ্য পাওয়া গেছে অডিটে।
মেয়রের সহযোগী বহাল তবিয়তে
২০১৯-২০ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের টাকা পৌর তহবিলে জমা না দিয়ে ১ কোটি ৬০ লাখ ৪০ হাজার টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটে। মেয়রের যোগসাজশ থাকায় তিনি বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। পরে বাধ্য হয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। সেই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে পৌরসভার কর আদায়কারী শফিউল আলম রায়হান ১ কোটি ৬ লাখ, সহকারী কর আদায়কারী ফাহিমা সানজিদ ৫২ লাখ টাকা এবং জান্নাতুল ফেরদৌস ২ লাখ ৩৬ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়। তদন্ত কমিটি এ ঘটনায় বিভাগীয় মামলার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু মেয়রের কারণে পরে শুধু শফিউল রায়হান বরখাস্ত হলেও অপর দুই সহযোগী ফাহিমা ও জান্নাতুল ফেরদৌস এখনো বহাল তবিয়তে আছেন।
অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে শ্রীপুর পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা রফিকুল হাসান বলেন, ফাহিমা সানজিদ ও জান্নাতুল ফেরদৌস টাকা ফেরত দিয়েছেন। তাঁদের বিষয়টি নিষ্পত্তি হওয়ায় তাঁরা চাকরিতে বহাল আছেন। আর শফিউল আলম রায়হান পলাতক।
এসব দুর্নীতি প্রসঙ্গে শ্রীপুর পৌরসভার প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সজিব আহমেদ বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর পৌরসভার অনিয়ম দূর করা চেষ্টা করছি। সব সেবা ডিজিটাল করার চেষ্টা হচ্ছে। আগের অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে পৌরসভার অনেকে জড়িত। এসব প্রতিকারের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।