মুসা আহমেদ : বহুল আলোচিত বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ডের নবম বছর অনেকটা নীরবেই চলে গেল। এ নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা-সমালোচনা নেই। এদিকে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন হত্যাকাণ্ডে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কয়েকজন আসামি। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত একজনকে সম্প্রতি ফেসবুকেও সক্রিয় দেখা গেছে। যদিও পুলিশের খাতায় ‘পলাতক’ রয়েছেন দণ্ডপ্রাপ্তরা।
২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর পথচারী বিশ্বজিৎ দাসকে বাহাদুর শাহ পার্কের (ভিক্টোরিয়া পার্ক) সামনে নৃশংসভাবে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। শাঁখারীবাজারে দর্জির দোকান ছিল বিশ্বজিতের। তার গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর। রাজধানীর লক্ষ্মীবাজারে থাকতেন তিনি।
দেশব্যাপী আলোড়ন তোলা বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪ রায় দেন। বিচারিক আদালতের রায়ে ২১ আসামির মধ্যে আটজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। তখন এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন আসামিরা।
নিম্ন আদালতের আদেশে মৃতুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- রফিকুল ইসলাম শাকিল, মাহফুজুর রহমান নাহিদ, এমদাদুল হক এমদাদ, জিএম রাশেদুজ্জামান শাওন, সাইফুল ইসলাম, কাইয়ুম মিঞা টিপু, রাজন তালুকদার ও মীর মো. নূরে আলম লিমন।
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- এ এইচ এম কিবরিয়া, খন্দকার ইউনুস আলী, তারিক বিন জোহর তমাল, গোলাম মোস্তফা, আলাউদ্দিন, ওবায়দুল কাদের তাহসিন, ইমরান হোসেন, আজিজুর রহমান, আল-আমিন শেখ, রফিকুল ইসলাম, মনিরুল হক পাভেল, মোশাররফ হোসেন ও কামরুল হাসান। তাদের প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত করা হয়।
পরে রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ৬ আগস্ট নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আট আসামির মধ্যে দুজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল, চারজনের মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন এবং অন্য দুজনকে খালাস দেন হাইকোর্ট। এছাড়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া ১৩ আসামির মধ্যে যে দুজন আপিল করেন, তারা খালাস পেয়েছিলেন। বাকি ১১ আসামির সবাই পলাতক। এরা হলেন- খন্দকার ইউনুস আলী, তারেক বিন জোহর, আলাউদ্দিন, ওবায়দুল কাদের, ইমরান হোসেন, আজিজুর রহমান, আল-আমিন শেখ, রফিকুল ইসলাম, মনিরুল হক পাভেল, কামরুল হাসান ও মোশাররফ হোসেন।
তখন তাদের ব্যাপারে রায়ে কোনো মন্তব্য করেননি আদালত। আসামিদের সবাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক একাধিক নেতা জানান, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া কয়েকজনকে প্রায়ই বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) টিএসসি এলাকায় আড্ডা দিতে দেখা যায়। এর মধ্যে গত অক্টোবরে সন্ধ্যায় ঢাবির টিএসসিসিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া কামরুলকে আড্ডা দিতে দেখা গেছে। আরেক আসামি ইমরান হোসেন তিন বছর আগে বিয়ে করেছেন। এখন তিনি ফরিদপুরে নিজ বাড়িতে অবস্থান করছেন বলেও জানা গেছে। এছাড়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া খন্দকার ইউনুস আলীও নারায়ণগঞ্জ শহরে দিব্যি ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন।
বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রাজন তালুকদারও পলাতক। তবে ফেসবুকে সক্রিয় তিনি। তার ফেসবুকে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজিৎ হত্যার সাত মাস পর দেশ ছেড়েছেন রাজন। ২০১৭ সালের নভেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে তাকে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দেখা গেছে। তখন রাজন দাবি করেছিলেন, ‘বিশ্বজিৎকে হত্যার সময় তিনি ঘটনাস্থলে থাকলেও আক্রমণে ছিলেন না। ছাত্রলীগের একটি পক্ষ তাকে মামলায় ফাঁসিয়েছে।’
রাজন তালুকদার এখন নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে নিয়মিত স্ট্যাটাস ও ছবি দেন। সর্বশেষ গত ৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার প্রতিবাদ এবং হেফাজতে ইসলামের সমালোচনা করে ফেসবুকে স্টাটাস দিয়েছেন তিনি। স্ট্যাটাসে রাজন লেখেন, ‘স্বাভাবিকভাবে এটাই তো হওয়ার কথা ছিল: যাদের ২০১৩ সালে ঢাকা শহর থেকে … লাথি মেরে বের করে দেয়া হয়েছিল, তাদের সাম্প্রতিক অতীতে দাওয়াত দিয়ে এনে ঢাকা শহরে ভূরিভোজ করালে, এই রকম হাজারো ঘটনা ঘটা একদম স্বাভাবিক। জয় তেঁতুল হুজুরের জয়।’
এর আগে ২ নভেম্বর এক ভিডিওতে রাজন তালুকদারকে নেপালের কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে যেতে দেখা গেছে। ফেসবুকে এই ভিডিওর ক্যাপশনে তিনি লেখেন, ‘সবাই যখন ঢাকায় বসেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখছে, আমি আর বাকি থাকবো কেন, সামনাসামনি দেখে আসি।’
এদিকে পলাতক আসামিদের গ্রেফতার না করায় হতাশা প্রকাশ করেছে বিশ্বজিতের পরিবার। বিশ্বজিতের বড় ভাই উত্তম কুমার দাসের অভিযোগ, রায় ঘোষণার পর তারা পলাতক আসামিদের গ্রেফতার করতে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু পুলিশ বলছে, আসামিরা কেউ দেশে নেই। অথচ তার জানামতে অনেক আসামি দেশেই রয়েছেন। কয়েকজন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় থাকেন।
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় এসব আসামিকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন উত্তম কুমার দাস।
বিশ্বজিৎ হত্যা মামলাটি তদন্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, আইন অনুযায়ী আদালত থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা আসামিদের স্থায়ী ঠিকানায় যায়। সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। ডিবিও আসামি ধরতে তৎপর থাকে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে আসামিদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না।
বিশ্বজিৎ হত্যা মামলাটির তদন্তের তদারক কর্মকর্তা ছিলেন ডিবি পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ছানোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী আদালত থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা আসামিদের স্থায়ী ঠিকানায় যায়। সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। তারপরও সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে ডিবি, র্যাবসহ অন্যান্য সংস্থা আসামিদের গ্রেফতার করতে পারে। এ বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর। সূত্র : জাগো নিউজ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।