জুমবাংলা ডেস্ক: শাবনাজ আক্তারের সঙ্গে ফেসবুকে পরিচয় মাসুম বিল্লাহ ফারদিনের। শাবনাজ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আবু সাঈদ খানের স্ত্রী। ফারদিন নিজেকে গাজীপুরের সাবেক এক এমপির ছেলের পরিচয় দিতেন। ফেসবুকে পরিচয়ের পর শাবনাজকে বড় বোন ও সাঈদ খানকে দুলাভাই ডাকতেন। তাদের মধ্যে তৈরি হয় পারিবারিক সম্পর্ক। প্রায় দুই বছর আগে আবু সাঈদকে কানাডা পাঠানোর প্রলোভন দেখান ফারদিন। শিল্পীদের সঙ্গে তবলা বাদক হিসেবে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিবেন বলে জানান। এতে রাজি হননি সাঈদ। পরে ২০২২ সালে রোজার শুরুতে জাইকা’র একটি সরকারি প্রজেক্টে সাত লাখ টাকার বিনিময়ে ৪৫ দিনের মধ্যে জাপান পাঠানোর প্রস্তাব দেন ফারদিন। সাঈদ জাপানের ভাষা জানতেন।
তাই সেখানে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজের সুপারভাইজার করা হবে বলে জানানো হয় তাকে। এই প্রস্তাবে রাজি হন তিনি। পরে ফারদিনকে ব্যাংকের মাধ্যমে ৭ লাখ টাকা দেয়া হয়। টাকা পাওয়ার পর ফারদিন জানান এই টাকায় জাপান পাঠানো সম্ভব না। তাকে আরও সাড়ে ৪ লাখ টাকা দিতে হবে। পরে বাধ্য হয়ে সেই টাকাও দেন সাঈদ। এ ছাড়া জাপানি ভাষার সার্টিফিকেট, ডলার এনডোর্স ও অন্যান্য খরচসহ আরও ৫ লাখ টাকার বেশি দাবি করেন ফারদিন। উপায় না পেয়ে সাঈদ বিভিন্নজনের কাছ থেকে ধার করে টাকা আনেন। জাপান যাওয়ার জন্য কয়েক ধাপে ফারদিনকে মোট সাড়ে ১৮ লাখ টাকা দেন। কিন্তু এরপর নানা অজুহাতে তাকে আর বিদেশে পাঠানো হয় না। তখন বুঝতে পারেন সাঈদ প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তিনি বলেন, পারিবারিক সম্পর্ক হওয়ায় তাকে বিশ্বাস করে টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু সে প্রতারণা করবে সেটা কোনোভাবেই বুঝতে পারিনি। বিশ্বাস যোগাতে সে আমাকে বলেছিল ফ্লাইটের আগে দেশেও ট্রেনিং করানো হবে। কিন্তু টাকা দেয়ার পর নানা টালবাহানা শুরু করে আমার সঙ্গে। এরপর আমাকে বিদেশে পাঠানো হয়নি। কোনো টাকাও ফেরত দেয়নি। দেশে সাঈদের মতো অসংখ্য মানুষ এভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। প্রতারকদের কৌশলে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন অনেকে।
গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম সূত্র বলছে, বর্তমানে প্রতারক চক্র নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে মানুষকে ধোঁকা দিচ্ছে। তবে প্রতারণাগুলো বেশির ভাগই হচ্ছে অনলাইনের মাধ্যমে। দেশে এলাকাভিত্তিক প্রতারণা কাজের গ্রুপ তৈরি হয়েছে। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় তারা সক্রিয়। বিভিন্ন কায়দায় মানুষের কাছ থেকে অর্থ আত্মসাৎ করছে এই চক্রগুলো। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে প্রতারণা করা অপরাধীদের বড় একটা চক্র দেশের দক্ষিণাঞ্চলে রয়েছে। বিশেষ করে ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা ও মধুখালী উপজেলা, মাগুরা জেলার কয়েকটি এলাকা, মাদারীপুরের রাজৈরসহ বেশ কিছু এলাকায় এই ধরনের প্রতারক রয়েছে। তারা বিকাশ, নগদ কিংবা বিভিন্ন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ পরিচয় দিয়ে মানুষকে বোকা বানিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করছে। তারা গ্রাহকদের মোবাইলে কল দিয়ে বিভিন্ন প্রলোভন ও কৌশলে ওটিপি হাতিয়ে নিচ্ছে। একপর্যায়ে তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে যায় চক্রগুলো।
গোয়েন্দা সূত্র আরও জানায়, মোবাইলের ইমু অ্যাপ্সের মাধ্যমে প্রতারণা করা প্রতারকদের বড় একটা ঘাঁটি নাটোর জেলার লালপুর উপজেলায়। পাশাপাশি রাজশাহী জেলাতেও কিছু চক্র সক্রিয় রয়েছে। তারা মূলত প্রবাসীদের টার্গেট করে। প্রবাসীদের থেকে বিভিন্ন ভাবে ইমু আইডির ওটিপি হাতিয়ে নিয়ে প্রতারকরা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যায়। পরে ভুক্তভোগীর আপত্তিকর ছবি, ভিডিও বা ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। এ ছাড়া ই-কমার্সের মাধ্যমেও প্রতারণা করে আসছে অনেকে। এমন কিছু প্রতারক চক্রের ঘাঁটি নড়াইলের কালিয়া উপজেলায়। তারা অনলাইনে পেজ খুলে বিভিন্ন পণ্য কেনাবেচার মাধ্যমে প্রতারণা করে। পণ্য বিক্রির নামে অগ্রিম টাকা নিচ্ছে। কিন্তু পরে আর পণ্য না দিয়ে গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় তারা।
ডিএমপি’র তথ্য বলছে, ২০২০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তিন বছরে মোট ২২৫১টি প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাতের মামলা হয়েছে। এরমধ্যে ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ ও ২০২২ সালে যথাক্রমে ৪৭ শতাংশ ও ৪৩ শতাংশ মামলা বেশি হয়েছে। ২০২০ সালে প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাতের মামলা হয় ৪৭৯টি। ২০২১ সালে ৯১৭টি আর গত বছর হয় ৮৫৫টি মামলা। এ ছাড়া চলতি বছর জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ২৩০টি প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাতের মামলা হয়েছে। ডিবি-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) সূত্র জানায়, ২০২০ সালে তদন্তের জন্য তাদের কাছে আসা মোট মামলার মধ্যে ১৪.২৮ শতাংশই ছিল প্রতারণার মামলা (মোবাইল ব্যাংকিং সংক্রান্ত ব্যতীত)। পর্যায়ক্রমে তা বেড়ে ২০২১ সালে ১৭.৪৭ শতাংশ, ২০২২ সালে ২৯.২৩ শতাংশ এবং ২০২৩ সালে (মার্চ পর্যন্ত) ৩৩.৩৩ শতাংশ প্রতারণার মামলার তদন্ত করে সংস্থাটির উত্তর বিভাগ।
বর্তমানে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মামলার ৪০ শতাংশই অনলাইনভিত্তিক প্রতারণার বলে উল্লেখ করেছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের স্পেশাল ক্রাইমের (উত্তর) উপ-পুলিশ কমিশনার তারেক বিন রশীদ। তিনি বলেন, ডিজিটাল আইনে মামলার বেশির ভাগই এখন অনলাইন ভিত্তিক প্রতারণার। বর্তমানে প্রতারকরা অনেক সক্রিয়। তারা নতুন নতুন প্রতারণার কৌশল বের করে। আমরাও অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়ায় আছি। প্রতারকদের অনেকেই আইনি প্রক্রিয়ায় জামিন পাওয়ার পর ফের একই ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়ায়।
তিনি বলেন, অনলাইনে প্রতারণার বেশির ভাগই ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি) শেয়ারের মাধ্যমে হয়। ওটিপি একান্ত নিজের ব্যক্তিগত বিষয়। সেটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট কিংবা ফেসবুক বা অন্য মাধ্যমের হোক। এটা কারও সঙ্গেই শেয়ার করা উচিত হয়। ভুক্তভোগীরা ভুল করে এটি প্রতারকদের কাছে শেয়ার করে। ওটিপি ছাড়া মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস, ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে টাকা নেয়া বা ফেসবুক হ্যাক করা সম্ভব নয়। ফেসবুকে অন্যের দেয়া লিংকে প্রবেশ করাও উচিত নয়। অনেক সময় খেলা দেখা কিংবা বিভিন্ন সাইটের সাবস্ক্রিপশন ফি ফ্রি করে দেয়ার নামে লিংক চলে আসে। তখন সেখানে আইডি, পাসওয়ার্ড চায়। এসব দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। লটারি জয়ের কথা বলে মোবাইলে এমন মেসেজও পাঠাতে পারে। সেগুলোই প্রতারণার ফাঁদ।
মো. কামরুজ্জামানের (৩৮) জন্ম ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের এক দরিদ্র পরিবারে। তিনি গ্রামে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। এরপর রাজধানী ঢাকায় এসে একটি প্রতিষ্ঠানে গ্রাফিক্স ডিজাইনে লেখাপড়া করে দক্ষ হয়ে উঠেন। এই দক্ষতাই তিনি ব্যবহার করেন প্রতারণার কাজে। খুব নিখুঁতভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠানের হুবহু নিয়োগপত্র তৈরি করতে জানতেন। এর মাধ্যমেই শুরু করেন প্রতারণা। চাকরি খোঁজা বেকারদের সরকারি চাকরির লোভ দেখিয়ে তাদের দেয়া হতো ভুয়া নিয়োগপত্র। বিনিময়ে নিতেন লাখ লাখ টাকা। এক সময় তিনি আরও সহযোগী নিয়ে একটি চক্র গড়ে তোলেন। এই চক্রের মাধ্যমেই অসংখ্য বেকার সর্বস্বান্তও হয়েছেন। অভিযোগের ভিত্তিতে কামরুজ্জামান ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তার করে ডিবি-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগ। এ সময় প্রতারকদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় বিভিন্ন ভুক্তভোগীর নাম ও ছবি সংবলিত সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদের ভুয়া চূড়ান্ত নিয়োগপত্র।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তারা জানান, প্রতারকদের মধ্যে বিদেশি চক্রও রয়েছে। কিছুদিন আগে চাইনিজ, হংকংয়ের অ্যাপসও পাওয়া গেছে। অনলাইনে এসব অ্যাপসের প্রচারণা চালিয়ে লোভনীয় কিছু অফার দেয়। মানুষ সেটা দেখে নিজের ডিভাইসে ওই অ্যাপস ইনস্টল করে। পরে তাদের ওই অ্যাপসে ইনভেস্ট করলে মুনাফা দেয়া হয়। এক সময় গ্রাহক অনেক টাকা ইনভেস্ট করে প্রতারণার শিকার হয়। প্রতারকরা তাদের ফেক ফোন নাম্বার ব্যবহার করে। এসবের কোনো কোনো নাম্বারে রেজিস্ট্রেশন করা থাকে না। বিভিন্ন জনের মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গা থেকে এই সিমগুলো তারা সংগ্রহ করে। এ ছাড়া বিভিন্ন এমএমএস অ্যাকাউন্টগুলোতেও তাদের নিজেদের নাম্বার থাকে না।
সিআইডি’র সাইবার পুলিশ সেন্টারের বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, এখন বিভিন্নভাবে প্রতারণা হচ্ছে। তবে অনলাইনে প্রতারণা দিনে দিনে বেড়ে যাচ্ছে। অনলাইনে যারা প্রতারণা করে তারা অনেক বেশি বুদ্ধিমান। অনলাইনে বিভিন্ন লোভনীয় অফার দিয়ে মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলছে। এর মাধ্যমে ফাইন্যান্সিয়াল স্ক্যামিং হচ্ছে। একজনের তথ্য আরেকজন নিয়ে যাচ্ছে। তথ্যগুলো নিয়ে মানুষকে ব্ল্যাকমেইল করছে। তিনি বলেন, ডিজিটাল মাধ্যমটা নতুন একটা ওয়ার্ল্ড। আমরা এই ওয়ার্ল্ড সম্পর্কে অনেকেই সচেতন না। ভার্চ্যুয়ালি যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি অনেক ক্ষেত্রে তাদের অনেককে আমরা চিনি না। কিন্তু তাদের একটা মেসেজ, ইউটিউব কিংবা ভিডিওর ওপর নির্ভর করে তাকে বিশ্বাস করছি। এটা মোটেই সমীচীন নয়।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজে এখন ঘোষণা দিয়ে প্রতারণা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে প্রতারিত করছে সংঘবদ্ধ চক্র। জাল টাকা বানিয়ে বাজারে ছেড়ে দিয়েও অনেকে প্রতারণা করছে। প্রান্তিক পর্যায়ে এই টাকাগুলো চলে যাওয়ায় নি¤œ আয়ের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। দেশে রাজনৈতিক প্রতারণা, ধর্মীয় উন্মাদনা বা গুজব ছড়িয়েও মানুষকে প্রতারিত করা হচ্ছে বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক। তিনি বলেন, মানুষ যাচাই-বাছাই ছাড়াই বিশ্বাস করে প্রতারিত হচ্ছেন। যখন কোনো দেশে প্রতারণা করে অল্প সময়ের মধ্যে অর্থ বাগিয়ে নেয়া যায় এবং সেখানে প্রতারিত হওয়ার মতো একটা জনগোষ্ঠীকে ফাঁদে ফেলা যায় তখন দেশে নানাকেন্দ্রিক প্রতারক চক্র বেড়ে যায়। প্রতারণার সংখ্যাও বেড়ে যায়।
তিনি বলেন, আমাদের আইনগত জটিলতার বিষয় রয়েছে। প্রতারণা এখনো গৌণ অপরাধ হিসেবে দেখা হয়। এতে সহজেই সে জামিন পেয়ে যায়। এ ছাড়া চক্রগুলো প্রতারণার মাধ্যমে যে অর্থ সংগ্রহ করে তার ভাগ-বাটোয়ারা বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়। অনেকক্ষেত্রে যারা ব্যবস্থা নিবেন তারাই এই ভাগ-বাটোয়ারা পায়। এতে ব্যবস্থা নিতেও বিলম্ব হয়। এসব বিষয়ের কারণে প্রতারণা বাড়ছে। মানুষ অল্পতেই প্রতারিত হচ্ছে।
সূত্র: মানবজমিন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।