আন্তর্জাতিক ডেস্ক : নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলাকালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে বৈঠক করেছেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহম্মদ ইউনূস।
জো বাইডেনের কার্যালয় থেকে প্রকাশিত এক প্রেস নোটে বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে দুই নেতার মধ্যে সম্পর্কের উষ্ণতার বিষয়টি। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, বাংলাদেশকে পুনর্গঠনে ‘আরো প্রচেষ্টা চালাতে হবে’। খবর বিবিসি বাংলার
তবে ইউনূস ও জো বাইডেনের মধ্যে যে উষ্ণতা দেখা গেছে নিউ ইয়র্কে, তা নরেন্দ্র মোদি সরকারের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নতুন সরকারের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করছে মোদি সরকার। বাংলাদেশ ভারতের অন্যতম প্রতিবেশী দেশ, যেখানে সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের পরিবর্তন হয়েছে। এর ফলে সেই সব দেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক কিছুটা অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে।
গত সপ্তাহে শ্রীলঙ্কায় বামপন্থী আনুরা দিসানায়েক প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। নেপাল আর মালদ্বীপে ২০২৩ সালে এবং মিয়ানমার ও আফগানিস্তানে ২০২১-এ ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে।
অন্য দিকে চীন ও পাকিস্তানের সাথে ভারতের সম্পর্কের টানাপড়েন তো চলছেই।
নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর তার সরকার প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্কোন্নয়নে ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ নীতি চালু করে।
অনেকে মনে করছেন, প্রতিবেশী দেশগুলোতে সরকার পরিবর্তনের পরে ওই নীতি কতটা কার্যকরী, তা এখন বিচার করার সময় হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত তার বেশ কয়েকটি প্রতিবেশী দেশের সাথে সঙ্ঘাতে জড়িয়েছে। কিভাবে ভারতের সাথে প্রতিবেশীদের সঙ্ঘাতগুলো চলেছে, সে দিকে নজর দেয়া যাক।
প্রথমে মালদ্বীপ।
সে দেশের নতুন প্রেসিডেন্ট মুহম্মদ মুইজের নির্বাচনী সেøাগানই ছিল ‘ইন্ডিয়া আউট’। ক্ষমতায় আসার পরেই কয়েক দশক ধরে চলে আসা একটি প্রথা ভেঙেছেন তিনি। প্রথাটা ছিল মালদ্বীপে ক্ষমতায় আসার পর প্রত্যেক প্রেসিডেন্টেরই প্রথম বিদেশ সফরটা হয় ভারতে।
কিন্তু প্রথম সফরের জন্য তুরস্ককে বেছে নেন মি. মুইজ। এ বছরের শুরুর দিকে চীন সফর থেকে ফিরে এসেই তিনি ভারতকে অনুরোধ করেন যে মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার করতে হবে।
ভারত সেই অনুরোধ মেনে নিয়ে সেনা প্রত্যাহার করে নেয়।
নেপালে ২০২০ সালে ক্ষমতায় আসার পরে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি বলেছিলেন যে ভারত নেপালের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে।
তবে ২০২৪ সালে মি. ওলি আবারো নেপালের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন এবং এখন ধীরে ধীরে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।
গত সপ্তাহে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশন চলাকালীন মি. ওলি এবং নরেন্দ্র মোদি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসেন। দুই দেশই এই বৈঠককে ইতিবাচক হিসেবে বর্ণনা করেছে।
আফগানিস্তানের প্রসঙ্গে দেখা যায় যে ভারত এখনো পর্যন্ত তালিবানকে সে দেশের বৈধ সরকার হিসাবে স্বীকৃতি দেয়নি। তবে আফগানিস্তানে কূটনৈতিক উপস্থিতি রয়েছে এমন ১৫টি দেশের তালিকায় ভারতও রয়েছে।
সবশেষে বাংলাদেশ।
মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতায় আসার পর ভারত কিছুটা ব্যাকফুটে চলে আসে। শেখ হাসিনার সরকারের সাথে ভারতের সুসম্পর্ক ছিল।
কিন্তু বাংলাদেশে যখন হাসিনা-বিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয় তখন সেখানকার মানুষ ভারতকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে।
প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং ইউনূস উভয়ই একসাথে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, তবে এর অভিমুখ কী হবে তা এখনো স্থির হয়নি।
‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ নীতি কতটা কার্যকরী?
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে আমেরিকা ও রাশিয়ার মতো বড় দেশের সাথে সম্পর্কের উন্নতি করার প্রচেষ্টায় নিজের প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ককে প্রাধান্য দেয়নি ভারত।
সিনিয়র সাংবাদিক ও দ্য হিন্দুর কূটনৈতিক সম্পাদক সুহাসিনী হায়দার বলেন, ‘নিজের প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্কের বিষয়টা ভারতের পক্ষে কখনোই সহজ ছিল না। গত ১০ বছরে সরকার নেইবারহুড ফার্স্টের কথা বলেছে ঠিকই, কিন্তু তা নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এই বিষয়ে খুব বেশি মনোযোগ দেয়া হয়নি। সুতরাং ভারতের এটা আশা করা উচিত নয় যে ভারতের ব্যাপারে এই দেশগুলোর সুখানুভূতি হবে।
সুহাসিনী হায়দার বলছেন, ‘প্রতিবেশী দেশগুলোর সরকার সবসময়ে যে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির সাথে একমত হবে, এমন ভাবাটা ভুল। ভারত তার প্রতিবেশীদের ওপর নিজের পররাষ্ট্রনীতি চাপিয়ে দিতে পারে না।
প্রতিবেশী দেশগুলোতে লাগাতার পটপরিবর্তন হওয়ার ঘটনা থেকে সরকার এই শিক্ষাই পাচ্ছে।
তবে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি মনে করেন যে ভারতের ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ নীতি যথেষ্ট গতিশীল।
তার কথায়, ‘এই নীতিটি খুবই নমনীয়। আমরা (ভারত) যেকোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারি। এর সবথেকে ভালো উদাহরণ হলো ভারত যেভাবে মালদ্বীপে মি. মুইজের ‘ইন্ডিয়া আউট’ নীতির মোকাবেলা করল। ধীরে ধীরে বিষয়টা থিতিয়ে গেল।
‘শ্রীলঙ্কা যখন ব্যাপক অর্থনৈতিক সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছিল, তখন ভারত শ্রীলঙ্কাকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছিল। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ভারত বলেছে যে তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাথে হাত মিলিয়ে কাজ করতে চায়,’ বলছিলেন সিক্রি।
তার কথায়, ‘এর থেকেই বোঝা যায় যে নেইবারহুড ফার্স্ট নীতির উন্নতি হচ্ছে এবং এখন তা বেশ শক্তপোক্ত হয়ে উঠেছে। গত কয়েক বছর ধরে এই নীতি পরীক্ষিত হয়েছে এবং এখন সেই পরীক্ষায় নীতিটি সফল হয়েছে।’
বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক নানা কারণে প্রভাবিত হয়। এগুলোর মধ্যে আছে ওইসব দেশের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন ও গণতন্ত্রায়ন।
দিল্লির জওয়াহেরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্বর্ণ সিং বলছেন, কোনো সন্দেহ নেই যে, এসব দেশে ক্ষমতার পালাবদল ভারতের পররাষ্ট্রনীতিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে।
নেপাল, বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের মতো ছোট দেশগুলো চীন ও ভারত থেকে ‘সম-দূরত্ব’ নীতি নিয়ে চলে।
ভারত তার কোনো প্রতিবেশীর অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনকে প্রভাবিত করতে পারে না, কিন্তু বাংলাদেশের মতো কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভারত দূরদর্শিতার অভাব দেখিয়েছে।
সুহাসিনী হায়দার বলছেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিশেষভাবে গুরুতর, কারণ যেখানে ভারতের হাইকমিশন এবং দেশের চারটি উপদূতাবাস আছে, তা সত্ত্বেও সেখানকার পরিস্থিতি সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারেনি ভারত।
‘বাংলাদেশে ভারত কেবল একটি পক্ষের সাথেই যোগাযোগ রেখেছিল এবং সেদেশের বিরোধীদের উপেক্ষা করেছিল। এখন এই ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে ভারতকে,’ বলছিলেন সুহাসিনী হায়দার।
তিনি এও বলছেন যে এর বিপরীতে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভারত অনেক ভালোভাবে সামলিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে ভারতকে অনেক ধৈর্যশীল হতে হবে।
বীণা সিক্রি বলেন, ‘আমি বলব যে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক ইতিবাচক এবং আমাদের বিদেশনীতি যে কোনো পরিস্থিতিই সামলানোর জন্য সক্ষম। বিশ্বজুড়েই সরকার বদলায়, কিন্তু আমাদের প্রতিক্রিয়া এমন হবে, যাতে দেশের সুনাম অক্ষুণœ থাকে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতিকে ওই সব পরিবর্তনগুলোর সাথে মানিয়ে নিতে হবে।
সুহাসিনী হায়দার বলছেন যে ভারতের বোঝা উচিত যে তার অভ্যন্তরীণ নীতিমালাও প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের ওপরে প্রভাব ফেলতে পারে।
‘শুধু ক্ষমতাসীনদের সাথে যোগাযোগ রাখাই যথেষ্ট নয়, এসব দেশের সাধারণ মানুষের মনও জয় করা দরকার,’ বলছিলেন সুহাসিনী হায়দার। অধ্যাপক স্বর্ণ সিংয়ের মতে, ধৈর্যই হলো মূলমন্ত্র।
বাংলাদেশ সফরে আসছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।