জুমবাংলা ডেস্ক : হারমান আর পলিন আইনস্টাইনের ছেলে আলবার্ট আইনস্টাইন। ভীষণ মেধাবী, কিন্তু পরিস্থিতির বিবেচনায় ভীষণ অযোগ্যও। আইনস্টাইন দম্পতির ইলেকট্রিকের ব্যবসা ছিল রমরমা।
কিন্তু একসময় ধস নামে, ব্যবসা টিকিয়ে রাখা দায় হয়ে ওঠে। তখন সব বিক্রিবাট্টা করে তাঁরা পাড়ি জমান ইতালিতে। ভীষণ মেধাবী কিন্তু অযোগ্য পুত্রধনটিকে অনেক চেষ্টা করেও ইতালিয়ান ভাষা শেখাতে পারেননি। এ কারণে ইতালিতে তাঁর কোনো ভবিষ্যৎ নেইইতালিয়ান ভাষা না জানলে সেখানকার স্কুলে ভর্তি করানো অসম্ভব।
সেখানে হোমারাচোমরা কোনো স্বজনও নেই যে এক-আধটু স্বজনপ্রীতি করে ছেলেকে ভর্তি করাবেন। সুতরাং বাধ্য হয়ে আলবার্টকে জার্মানিতে রেখেই অন্য সন্তানদের নিয়ে ইতালিতে পাড়ি জমালেন বাবা-মা। ভীষণ মেধাবী ছেলেটা দেশেই রয়ে গেলেন এক আত্মীয়ের জিম্মায়। আলবার্ট ছোটবেলা থেকেই স্বাধীনচেতা।
স্কুলের বাধাধরা নিয়ম তাঁর ভালো লাগে না। তা ছাড়া ইহুদি বলে নাক উঁচু বন্ধুদের টিপ্পনী হজম করতে হয়। সেসব আর সহ্য করতে পারছিলেন না কিশোর আইনস্টাইন। তাই স্কুল ছেড়ে পালিয়ে একদিন ইতালি পাড়ি জমান মা-বাবার কাছে। কিন্তু পলিন বিষয়টাকে ভালোভাবে নেননি।
তাঁর স্বপ্ন অনেক বড়–ছেলেকে পড়াতে চান সুইজারল্যান্ডের ফেডারেল ইনস্টিটিউটে, যার লৌকিক নাম জুরিখ পলিটেকনিক্যাল কলেজে। তখন সেটা বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার জন্য ইউরোপসেরা। কিন্তু সেখানে ভর্তি হতে হলে স্কুল পাস হতে হয়। আইনস্টাইন সেই পাট তখনো চুকিয়ে উঠতে পারেননি। পলিন চেষ্টা করলেন এক প্রভাবশালী আত্মীয়কে ধরে আইনস্টাইনকে সেখানে ভর্তি করানোর। কিন্তু সেটাও হলো না। কারণ, কমপক্ষে ১৮ বছর বয়স না হলে জুরিখের সেই বিখ্যাত পলিটেকনিক কলেজে কোনো ছাত্র ভর্তি হতে পারে না। একসঙ্গে দু-দুটি আইনকে কাঁচকলা দেখিয়ে ছেলেকে ভর্তি করাবেন, ততখানি খুঁটির জোর পলিনের ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে ষোলো বছরের আইনস্টাইনকে ভর্তি করালেন সুইজারল্যান্ডের আরাউ স্কুলে। আর তখনই আইনস্টাইনের সামনে প্রথমবারের মতো খুলে গেল অবাধ প্রেমের দুয়ার।
আরাউ স্কুলে কিশোর আইনস্টাইন ভর্তি তো হলেন, কিন্তু থাকবেন কোথায়? সুইজারল্যান্ডে তো আইনস্টাইনের কেউ নেই! সে ব্যবস্থাও হলো। সেই স্কুলেরই শিক্ষক ইয়োস্ট উইন্টেলারের বাড়িতে বন্দোবস্ত হলো থাকা-খাওয়ার। ইয়োস্টের সংসার কিন্তু ছোট নয়। চার ছেলেমেয়ে ও স্ত্রী পলিন উয়েন্টেলার। এখানেও পলিন! মায়ের সঙ্গে নামের মিল আছে, তাই আলবার্ট আইনস্টাইন তাঁকে মা বলে ডাকা শুরু করলেন। তা ছাড়া মিসেস উইন্টেলার আলবার্টকে ভীষণ স্নেহ করেন। রীতিমতো পুত্রস্নেহে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিলেন আইনস্টাইনকে।
উইন্টেলার দম্পতির রূপসী কন্যা মেরি উইন্টেলার। ১৮ বছরের তরুণী! বয়সে আইনস্টাইনের দুই বছরের বড়। তাতে কী! প্রেম কবে স্থান-বয়স-পাত্র মেনে চলেছে। চোখ-ধাঁধানো সুন্দরি, সঙ্গে অসাধারণ পিয়ানো বাজানোর হাত। আইনস্টাইন শিগগিরই ঘায়েল হলেন তরুণীর রূপে-গুণে। কিন্তু এক হাতে তো তালি বাজে না। মেরিও আইনস্টাইনকে প্রথম প্রথম স্নেহের দৃষ্টিতেই দেখতে চেয়েছিলেন। বয়সে ছোট বলেই হয়তো। কিন্তু খুব শিগগিরই মনে প্রেমের গুঞ্জরণ শুনে বুঝতে পারেন বসন্ত এসে গেছে। আইনস্টাইন মেধাবী, বেহালা বাজাতে জানেন বেশ ভালো। পিয়ানো আর বেহালার ঐকতান কেন নয়? দুজন খুব কাছাকাছি এসে পড়েন এক সময় নিজেদের অজান্তেই। স্নেহ, বন্ধুত্ব, ভালো লাগা, অবশেষে রূপ নেয় ভালোবাসায়।
উড়ুউড়ু মন থিতু হলেও কি উড়ুক্কু স্বভাবটা যায়! ভালোবাসার মানুষটার কথা সবাইকে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে। বন্ধু, আপনজন, সবাইকে। আইনস্টাইনের ভাবখানাও তেমন, মেরিকে ভালো লাগার কথা জানিয়ে চিঠি লিখলেন মাকে। তবে সেটা ঠিক ভালোবাসার কথা ছিল কি না নিশ্চিত করে বলার উপায় এখন নেই, তবে মেরির সেবা–যত্নের কথা লিখেছিলেন, সেটা নিশ্চিত। মা কি অবুঝ! ছেলের চিঠিতে মেরির প্রতি তাঁর মুগ্ধতার কথা ছিল, হয়তো গোপন ভালোবাসার ইঙ্গিতটা তিনি ধরে ফেলেছিলেন। পলিন আইনস্টাইন ধন্যবাদ দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন মেরিকে। মেরির মনেও বসন্ত, ভালোবাসার মানুষটার মায়ের কাছ থেকে এমন চিঠি যে দুষ্প্রাপ্য! তখন আর তাঁকে পায় কে! উদ্দাম ভালোবাসার জোয়ারে ভেসে যায় দুটি প্রেমিক অন্তর।
পরের গ্রীষ্মে ছুটি কাটাতে ইতালিতে যান আইনস্টাইন। প্রতিদিন ভালোবাসায় টইটম্বুর ভাষায় চিঠি লেখেন মেরিকে। আইনস্টাইন পরিবারও নিশ্চিতভাবে জেনে গেছে আলবার্ট আর মেরির মন দেওয়া-নেওয়ার কথা। খুশিমনেই মেনে নিয়েছিলে সে সম্পর্ক। মেরির পরিবার থেকেও আপত্তি ছিল না। সুতরাং এমন একটি সম্পর্ক পরিণতি না পাওয়ার কোনো কারণই ছিল না।
পরের বছর ভালোয় ভালোয় স্কুলের সার্টিফিকেট বগলদাবা করেন আইনস্টাইন। এবার আর ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব জুরিখের ভর্তি হতে বেগ পেতে হলো না তাঁকে। সুতরাং বাজল বিদায়ের রাগিণী। আইনস্টাইন পাড়ি দিলেন জুরিখে।
ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব জুরিখে ভর্তি হলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। অনেক বন্ধু ছিল। কিন্তু আইনস্টাইন চুপচাপ ছেলে। বন্ধুদের সঙ্গ তাঁর ভালো লাগে না। তা ছাড়া তিনি মেধার চর্চা করেন। গণিত-ফিজিকস নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতে পারলেই তাঁর ভালো লাগত। অন্য বন্ধুদের মতো চটুল-স্থুল আড্ডা তাঁর পছন্দ নয়। তাই বলে যে সব বন্ধুই এক রকম, তা তো হতেই পারে না। কেউ না কেউ তো থাকবেই। তেমনই এক বন্ধু মার্সেল গ্রসম্যান, যাঁর অবদান আইনস্টাইনের জীবনে ভোলার নয়। আরেকজন মিলেভা মেরিক। রূপসী নন, হাঁটেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। সেই মিলেভাকেই ভালো লেগে গেল আইনস্টাইনের। সুন্দরী না হোক, ভীষণ মেধাবী আর চুপচাপ। তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হলেন আইনস্টাইন। ভুলতে বসলেন প্রথম প্রেমিকা মেরিকে। চোখের আড়াল হলে মনের আড়াল হওয়ার প্রবাদটা তো আর মিথ্যে নয়। অবশ্য মিলেভার কথা প্রথমেই জানাননি মেরিকে। তবে নিয়মিত চিঠি লেখা বন্ধ হয়েছে, মেরির চিঠির জবাবও আসে না। কুডাক ডাকে মেরির মনে। কিন্তু আইনস্টাইন খোলাসা করে কিছু জানান না। অথচ আরাউ ছেড়ে আসার সময় মেরিকে কত স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন আইনস্টাইন। কীভাবে ভবিষ্যৎ গড়বেন, তাঁদের সোনার সংসার হবে, সে সব স্বপ্ন এখন ধূসর অতীত।
নিরুপায় মেরি চিঠি লেখন আইনস্টাইনের মাকে। তিনি জানান, তাঁর ছেলের নাকি চিঠি লেখায় অলসতা আছে! সত্যিটা হলো, আইনস্টাইন মিলেভার প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে ভুলে গেছেন মেরির কাছে চিঠি লেখার কথা। শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেন আলবার্ট মেরিকে আর অন্ধকারে রাখবেন না। কিন্তু সরাসরি মেরিকে জানানোর মতো সাহসও তাঁর ছিল না। তাই মেরির মাকে জানালেন, মেরির সঙ্গে সম্পর্ক রাখা আর সম্ভব নয় তাঁর পক্ষে।
এরপরই যবনিকা পড়ে আলবার্ট আইনস্টাইনের প্রথম ভালোবাসার।
সূত্র: দ্য প্রাইভেট লাইফ অব আলবার্ট আইনস্টাইন, রজার হাইফিল্ড এবং পল কাঁর্টার এবং আইনস্টাইন: হিজ লাইফ অ্যান্ড ইউনিভার্স, ওয়াল্টার আইজ্যাকসন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।