জুমবাংলা ডেস্ক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পা ছুঁয়ে একবার সালাম করতে চান শেরপুরের আলোচিত সেই ভিক্ষুক নাজিম উদ্দিন। এটাই তার এখন জীবনের শেষ ইচ্ছা। রোববার সকালে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া বিশেষ উপহারের বাড়ি পেয়ে এমন অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন ভিক্ষুক নাজিম।
ভিক্ষা করে জমানো টাকা করোনা দুর্গতদের মাঝে দান করে প্রশংসা পাওয়া ভিক্ষুক নাজিম উদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত জমিসহ পাকা বাড়ির চাবি হস্তান্তর করা হয় রোববার।
নাজিমের বাড়ি জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা ইউপির গান্ধীগাঁও গ্রামে। সে ওই গ্রামের ইয়ার উদ্দিনের ছেলে। করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য গত ২১ এপ্রিল ইউএনও রুবেল মাহমুদের হাতে ভিক্ষা করে জমানো ১০ হাজার টাকা তুলে দেন নাজিম উদ্দিন। নিজের ভাঙা বসতঘর মেরামত করার জন্য ভিক্ষা করে ওই টাকা জমিয়েছিলেন তিনি। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়।
তার এই দান করার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসলে ইউএনওকে ফোন করেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব-(১) সালাহ উদ্দিন। নির্দেশনা অনুযায়ী রাতেই ভিক্ষুক নাজিম উদ্দিনের বাড়িতে যান ইউএনও।
পরে ২২ এপ্রিল দুপুরে ডিসির সম্মেলনকক্ষে নাজিম উদ্দিনকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। এদিন তার হাতে ২০ হাজার টাকা ও প্রধানমন্ত্রীর উপহার সামগ্রী তুলে দেন ডিসি।
এছাড়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নাজিম উদ্দিনকে খাদ্য সামগ্রী দেয়া হয়। খাদ্য সামগ্রীর মধ্যে ছিল চাল, ডাল, তেল ও আলুসহ অন্যান্য সামগ্রী।
সূত্র জানায়, এই দৃষ্টান্তমূলক ও হৃদয়গ্রাহী ঘটনাটি প্রধানমন্ত্রীর নজর কেড়েছিল এবং তাকে ব্যক্তিগত তহবিল থেকে একটি আধুনিক বাড়ি তৈরি করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নিজেই ওই বৃদ্ধ দরিদ্র ব্যক্তির জন্য বাড়ির নকশা চূড়ান্ত করেন।
ডিসির কার্যালয় সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় নাজিম উদ্দিন পেলেন জমি এবং পাকা বাড়ি। এছাড়া জীবিকা নির্বাহের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেয়া হবে একটি মুদি দোকান। নাজিম উদ্দিন যে ঘরটিতে এতদিন ছিলেন সেটি মূলত সরকারের খাস জমি ছিল। এ তথ্যটি ভিক্ষুক নাজিম উদ্দিনও এতদিন জানতেন না। সরকারের এই খাস জমিটি ভিক্ষুক নাজিম উদ্দিনের নামে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যদিও সরকার অন্য একটি উপযুক্ত জায়গায় নতুন বাড়ি তৈরি করতে চেয়েছিল, নাজিম উদ্দিন এখন যে জায়গাটিতে বাস করছেন, সেখান থেকে যেতে চাননি তিনি। তাই, নতুন বাড়িটি তার বর্তমান জায়গায় নির্মিত হয়েছে। নাজিম উদ্দিন যে ঘরে থাকতেন সেই জমি কিছুটা সম্প্রসারণ করে ১৫ শতাংশ জমি তার নামে বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে এ নতুন বাড়ির চাবি তুলে দেন ডিসি আনার কলি মাহবুব।
এ দিন গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে নাজিম উদ্দিন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পা ছুঁয়ে একবার সালাম করতে চাই আমি। এটাই আমার এখন জীবনের শেষ ইচ্ছা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘায়ু কামনা করে তিনি বলেন, এ রকম প্রধানমন্ত্রী আমার ৮২ বছর বয়সে আর কখনো দেখিনি। মনে করন আমি তো করোনার জন্য টাকা দিয়েছি। সেখানে খুশি হয়ে প্রধানমন্ত্রী আমাকে যে উপহার দিয়েছে, আমি খুব খুশি হয়েছি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, ভিক্ষা করতে করতে খাইয়ে-খুইয়ে ১০ হাজার টেহা ডাইনে হইল (জমা হলো)। টেহাডি ঘর-দরজা ঠিক করবার জন্যে থুইছিলাম (রাখা হয়েছিল)। কিন্তু এহন দেশে আইলো করোনা, শুরু হইল দশের অভাব। ভাবলাম বয়স হইয়া গেছে মইরাই যামুগা। এই টেহাগুলান যদি মাইনসের কাজে লাগে, এই চিন্তার থ্যাইক্কা দশের জন্যে টেহাগুইলে ইউএনওরে দিমু। কিন্তু আমি তো ইউএনওরে চিনি না। তাই বকুল মেম্বার আর লতিফা মেম্বারনীরে কইলাম আমারে ইউএনও সাবের কাছে নিয়া যাও। পরে ইউএনওর হাতে দশের জন্যে টেহাগুইলে দিলাম।
এর আগে অন্য কোথাও দান করেছেন কিনা জানতে চাইলে নাজিম উদ্দিন বলেন, অনেক দিন আগে যহন কামাই-টামাই করছি তহন জুম্মাঘর, মাদরাসায় ১০০, ২০০, ৫০০ টেহা দান করছি। কিন্তু যহন বয়স হইল, বুইড়ে হইলাম তহন তো আমার কামাই করবার উপায় নাই। খড়ি-টড়ি (লাকড়ি) কাইটে আর কোদালের আছাড়ি বানায়ইয়া বাজারত বিক্রি কইরা সংসার চালাইতাম। একদিন পাহাড়ের ড্রেনে পুইড়ে গেয়ে (পড়ে গিয়ে) পা ভাঙল, কাম-কাজ করবার পাই না। মানুষ কামলাও নেই না। পরের থ্যাইক্কা ভিক্ষা কইরে খাওয়া শুরু করলাম। তাই আর দান করবের পাই নাই।
গত ২৭ এপ্রিল সকালে করোনাভাইরাস বিষয়ে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে শেরপুর জেলাসহ আরো কয়েকটি জেলার সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে সংযুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী।
এ দিন তিনি বলেন, ভিক্ষুক নাজিম উদ্দিন সারা বিশ্বে একটি মহৎ দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন। এ সময় তিনি সবার উদ্দেশ্যে ভিক্ষুক নাজিম উদ্দিন প্রসঙ্গে আলোচনা করেন। এ আলোচনার সময়কাল ছিল দুই মিনিট পাঁচ সেকেন্ড।
আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, এতবড় মানবিকগুণ অনেক বিত্তশালীর মাঝেও দেখা যায় না। একজন নিঃস্ব মানুষ যার কাছে এই টাকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। ওই টাকা দিয়ে সে দুটো জামা কিনতে পারতো, ঘরের খাবার কিনতে পারতো। এছাড়া করোনাভাইরাস নিয়ে যে অসুবিধা ওই টাকা দিয়ে সে নিজের কাজে ব্যবহার করতে পারতো। আর এ অবস্থায় ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা পাওয়াও মুশকিল। কিন্তু সেসব চিন্তা না করে নাজিম উদ্দিন তার শেষ সম্বলটুকু দান করে গেছেন।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় আরো বলেন, বাংলাদেশের মানুষের মাঝে এখনো সেই মানবিকতা বোধ আছে। সেটা পাই আমরা নিঃস্বদের কাছ থেকেই। দেখা যায় অনেক বিত্তশালীরা হা-হুতাশ করেই বেড়ায় তাদের নাই নাই অভ্যাসটা যায় না। তাদের চাই চাই ভাবটাই সবসময় থেকে যায়।
ডিসি আনারকলি মাহবুব বলেন, নাজিম উদ্দিন ভিক্ষুক হলেও হৃদয়ের দিক দিয়ে অনেক ধনী। মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে থাকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তিনি আবারো প্রমাণ করলেন মানুষ মানুষের জন্য। প্রাণঘাতী করোনা পরিস্থিতিতে তার সেই অবদানে সম্পদশালীরাও আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
তিনি জানান, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় নজিম উদ্দিনকে বয়স্কভাতা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া তিনিসহ তার স্ত্রী আবেদা খাতুন ও সন্তানদের চিকিৎসার দায়-দায়িত্ব নেয়া হয়েছে।
১৯৪০ সালে জন্ম নেয়া নাজিম উদ্দিন দুই ভাই আর দুই বোনের মধ্যে তৃতীয়। ব্যক্তি জীবনে তিনটি বিয়ে করেছেন তিনি। তার প্রথম স্ত্রীর নাম ময়না খাতুন। ওই ঘরে মমেন আলী নামে তার এক ছেলে রয়েছে। দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম হালেমা বেগম। ওই ঘরে নজেদা খাতুন নামে এক মেয়ে সন্তান আছে তার। মেয়েটি মানসিক রোগী। ওই দুই স্ত্রীর সঙ্গে অনেক আগেই তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। আর বর্তমান স্ত্রীর নাম আবেদা খাতুন। আবেদা বিকলাঙ্গ ও মানসিক রোগী। এ ঘরে আসকর আলী, সুন্দরী, তানজিলা ও আব্দুল্লাহ নামে চারজন সন্তান রয়েছে। এরমধ্যে ছেলে আসকর আলী বিয়ে করে আলাদা থাকে। আর মেয়ে সুন্দরীর বিয়ে হয়েছে বেশকিছু দিন আগে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।