মোঃ মাহামুদুল হাসান : উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী (Green Belt) দুর্যোগ থেকে বাঁচাতে প্রাকৃতিক দেয়ালের মতো কাজ করে। বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলের দৈর্ঘ্য ৭১৫ কিলোমিটার। কিন্তু এর খুব কম অংশেই এখন সবুজ বেষ্টনী দৃশ্যমান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যেটুকু দৃশ্যমান ছিল তা দখল, ইজারা, একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বিলীন হওয়ার পথে। ফলে হুমকির মধ্যে পড়েছে উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবন।
আমরা লক্ষ্য করেছি যখনই কোনো ঝড় বা জলোচ্ছ্বাস হয় তখনই সুন্দরবন বুক পেতে দাঁড়িয়ে যায় সামনে। সুন্দরবন, তার সবুজ বেষ্টনীর মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উপকূলীয় অঞ্চলকে রক্ষা করে। এটি কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে কাজ করে না, বরং জীববৈচিত্র্য ও স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকার জন্যও অপরিহার্য। কিন্তু সুন্দরবন তো বাংলাদেশের উপকূলের একটা ছোট অংশে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে উপকূলের বাকি অংশেও এরকম সবুজ বেষ্টনী দরকার। যত মজবুত করে বেষ্টনী গড়ে তোলা হবে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করা তত সহজ হবে। বিশেষজ্ঞরাও বরাবর এর উপরই জোর দিয়েছেন।
উপকূলে সবুজায়নের দায়িত্ব পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের হলেও দেখা যাচ্ছে, এ কাজটি তারা যথাযথভাবে করতে পারছে না। মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা এবং দায়িত্বহীনতার কারণে উপকূলজুড়ে যতটুকু সবুজ বেষ্টনী রয়েছে, তা বনখোকো ও ভূমিদস্যুরা সাবাড় করে দিচ্ছে। বনবিভাগ, পুলিশ, জনপ্রতিনিধিদের ম্যানেজ করে নির্বিচারে ধ্বংস করা হচ্ছে। বলা যায়, রক্ষকই ভক্ষকে পরিণত হয়েছে। গত চার দশকে দেশের উপকূলভাগে ৬০ ভাগেরও বেশি সুশোভিত কেওড়া-বাইন-ঝাউবন, প্যারাবন ও ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল উজাড় হয়ে গেছে। এর ফলে সমুদ্রের ভাঙ্গন বৃদ্ধি এবং ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে উপকূলের মানচিত্র বদলে যাচ্ছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়ে ফসলি জমি ধ্বংস হচ্ছে। ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে। ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে দীর্ঘ উপকূল অঞ্চলকে।
উপমহাদেশের প্রাচীন ম্যানগ্রোভ বা শ্বাসমূলীয় বনের একটি ছিল কক্সবাজারের চকরিয়া সুন্দরবন। সবুজ বেষ্টনী হিসেবে এটি কক্সবাজার উপকূলের একটি বৃহৎ এলাকাকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করত। কিন্তু সেই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চকরিয়ার সুন্দরবন এখন বিলুপ্ত। চকরিয়া সুন্দরবনকে ১৯০৩ সালে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। পরবর্তীতে বনটি নানাভাবে মানব হস্তক্ষেপের শিকার হয়ে হারিয়ে যায়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ আল-আমিন একটি জাতীয় দৈনিককে বলেন, ‘বন উজাড় করে চিংড়ির ঘের, তারপর সেই চিংড়ি চাষে ধস, অতঃপর লবণের ঘের—এই হলো চকরিয়া সুন্দরবনের ইতিহাস।’
স্থানীয়দের মতে, বন ধ্বংসে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। বনের লিজ নেওয়া জমিতে চোখের সামনে সুন্দরবনের কেওড়া, বাইন ও সুন্দরীগাছ কেটে মাছের ঘের করা হয়েছে। চকরিয়ার বন ১৯৭৯ সাল পর্যন্তও অটুট ছিল। ওই সময় বনের আকার ছিল ১৫ হাজার একরের বেশি। ১৯৯৫ সালে প্রায় পুরো বন উধাও হয়ে গিয়ে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৬৬ একরে। বন কেটে চিংড়িঘেরের যাঁরা মালিক হন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন স্থানীয় প্রভাবশালী এবং ঢাকাবাসী সরকারি-বেসরকারি ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা।
চকরিয়া সুন্দরবনের অবস্থানকে একটি ফানেল বা চোঙা বা নলের সঙ্গে তুলনা করেন গবেষকেরা। এখানে ঘূর্ণনবায়ু এসে আঘাত করত। আর বন যখন ছিল, তখন এটি সুরক্ষা দিত। কিন্তু ১৯৯১ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় যখন কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূলে এসে উপস্থিত হলো, তখন চকরিয়া ছিল বিরানভূমি। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে এক রাতেই লক্ষাধিক মানুষ নিহত হন।
অধ্যাপক মোহাম্মদ আল-আমিন বলেন, চকরিয়া সুন্দরবন প্রাকৃতিক ঝড়ঝঞ্ঝায় বর্ম হিসেবে কাজ করত। ১৯৯১ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে কক্সবাজার উপকূলে যে লক্ষাধিক মানুষের প্রাণ ও সম্পদহানি হয়েছে, তা হয়তো রোধ করা যেত, যদি এই বন থাকত।
চকরিয়ার স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, চকরিয়া সুন্দরবন তাদের রক্ষাকবচ ছিল। কিন্তু তার অস্থিত্ব নেই। বন উজাড় করে পুরো কক্সবাজার উপকূলকে মৃত্যুর মুখে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বড় আকারের ঘূর্ণিঝড় এই অঞ্চলে আঘাত করলে অজস্র মানুষের প্রাণ যাবে।
২০১৯ সালে ৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘কক্সবাজার জেলায় সবুজ বেষ্টনী সৃজন, প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার ও ইকো ট্যুরিজম উন্নয়ন’ শিরোনামের একটি প্রকল্প গ্রহণ করে বন বিভাগ। প্রকল্পের আওতায় কক্সবাজার সদর, রামু, উখিয়া, টেকনাফ, চকরিয়া, কুতুবদিয়া, পেকুয়া ও মহেশখালীতে বৃক্ষরোপণ করা হয়। কিন্তু পরিচর্যার অভাবে বেশির ভাগ গাছের চারা মরে যায়। কোথাও চারা মাথা তুলে দাঁড়ালেও গরু-ছাগল তা খেয়ে ফেলে। আবার কোথাও চারার অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি। ফলে এই অঞ্চলে সবুজ বেষ্টনী আর তৈরি হয়নি। একই অবস্থা চট্টগ্রাম উপকূলের বেশিরভাগ অংশেই।
অবৈধভাবে গাছ কর্তন, অগ্নিসংযোগ, দখল, বালু উত্তোলন, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন কারণে উজাড় হচ্ছে পটুয়াখালী ও বরগুনা উপকূলের সবুজ বেষ্টনী। ক্রমাগত বনাঞ্চলের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়ছে। উপকূলের দেয়ালখ্যাত সবুজ বেষ্টনী এখন মানবসৃষ্ট কারণে ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিলীনের পথে।

বরগুনার পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ হরিণঘাটা ম্যানগ্রোভ বনটিকে ধ্বংস করেছে ভূমি ও বনদস্যুরা। পরিকল্পিতভাবে বনের গাছ কেটে জমি দখল করে তৈরি বসতবাড়ি, মাছের ঘেরসহ কৃষি জমি সৃজন করা হয়েছে সেখানে। একরের পর একর জমি দখল করেছে ভূমিদস্যুরা। বরগুনার তালতলী থেকে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সৈকত পর্যন্ত বিস্তৃত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বন টেংরাগিরি বা ফাতরার বন। এ বনের আয়তন ১৩ হাজার ৬৪৪ একর। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউয়ের ছোবল আর দখলের ফলে এ সবুজ বেষ্টনীটিও এখন বিলীনের পথে।
কুয়াকাটার গঙ্গামতি সমুদ্র সৈকতের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে থাকা সুদীর্ঘ বনাঞ্চল আজ বিরল দৃশ্য। সত্তরের দশকের ভয়াবহ বন্যা, ২০০৭ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে সিডর, আইলা, মহাসেন, নার্গিস ও মোরাসহ একাধিক প্রাকৃতি দুর্যোগ পাল্টে দিয়েছে উপকূলের চিত্র। এ ছাড়াও বনদস্যুদের ক্রমাগত উৎপাতে ধ্বংস হচ্ছে এই উপকূলের বনাঞ্চল।
উপকূলের বনাঞ্চলের এমন শোচনীয় অবস্থায় শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আঘাত করলে কি ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি হবে, তা কল্পনাও করা যায় না। বলার অপেক্ষা রাখে না, চট্টগ্রাম, মহেশখালিসহ উপকূলীয় অঞ্চলে বন ধ্বংস করে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে যে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও বড় বড় প্রকল্প গড়ে তোলা হচ্ছে ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলে এগুলো ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে।
আমরা দেখেছি, আইলা, সিডর, নার্গিসের মতো ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ে কিভাবে উপকূল লন্ডভন্ড হয়েছে। ’৭০ ও ’৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহ আঘাতে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু ও সম্পদের অপরিসীম ক্ষতি ইতিহাস হয়ে রয়েছে। এ ধরনের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডব এবং ক্ষতি রুখে দিতে পারে উপকূলজুড়ে সবুজ বনায়ন ও বেষ্টনী। সরকারের পক্ষ থেকে বহু বছর ধরে এ ধরনের উদ্যোগ চলমান এবং বিশ্ব জলবায়ু তহবিল থেকেও ফান্ড পাচ্ছে। তবে এ কার্যক্রম যে যথাযথভাবে করা হচ্ছে না, তা উপকূলের বন উজাড় হওয়ার মধ্য দিয়েই বোঝা যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট বন বিভাগ ও প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় বন ও ভূমিখেকো নির্বাধে বন উজাড় করে চলেছে। পুরো উপকূল ন্যাড়া করে ফেলছে। সাধারণত উপকূলীয় তটরেখা বরাবর শতকরা ৮০ ভাগ সবুজ বেষ্টনী থাকতে হয়। বর্তমানে স্থানভেদে রয়েছে ২০ থেকে ৩০ ভাগ। অন্যদিকে, দেশে মোট আয়তনের ২৫ ভাগ বনাঞ্চল থাকা অপরিহার্য হলেও রয়েছে মাত্র ৮ থেকে ১০ ভাগ। এ এক ভয়াবহ চিত্র।
বন অধিদফতর বলছে, উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা এবং সমুদ্র ও নদীর মোহনা এলাকায় জেগে ওঠা নতুন চর স্থায়ী করার লক্ষ্যে বনায়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন, সমুদ্রের কাছাকাছি নিকট দূরত্বে জেগে ওঠা চরের ভূমি পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে একত্রীকরণ করে সবুজ বেষ্টনী তৈরির জন্য বন অধিদফতর তিনটি প্রকল্প বস্তবায়ন করছে। তবে এখনও উপকূলের অনেক জায়গা বনায়নের বাইরে রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত বাংলাদেশের জন্য এক অনাকাঙ্ক্ষিত কিন্তু অনিবার্য বাস্তবতা। আগামীতে বিভিন্ন দুর্যোগ বিশেষত জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ও তীব্রতা বাড়বে। এজন্য উপকূলরেখাব্যাপী সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলার বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে সরকারকে।
লেখক : সম্পাদক, জুমবাংলা.কম
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।