মো. মুস্তাকিম মাহমুদ রিপন : শিক্ষার মূলভিত্তি হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। একটি জাতি কিভাবে গঠিত হবে তা নির্ভর করে প্রাথমিক শিক্ষার উপর। সুশিক্ষিত ও সুনাগরিক গঠনে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব অনেক। তাই কোমলমতি শিশুদের উপযুক্ত প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা খুবই জরুরি। কারণ আজকের শিশু আগামী দিনে রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে অংশ গ্রহণ করবে। তবে বর্তমান করোনা পরিস্থিতি ও শিক্ষক সংকটে প্রাথমিক শিক্ষা ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন। প্রতিবছর সরকার এ খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা ও নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করেও যথাযথ উন্নয়ন সাধিত না হওয়ার পিছনে শিক্ষক সংকট অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শিক্ষক সংকটের বর্তমান অবস্থা
মানসস্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে শিক্ষক সংকট একটি অন্যতম বাঁধা। প্রতিবছর যে পরিমাণ শিক্ষক অবসরে যাচ্ছেন, সে পরিমাণ শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রাথমিকে ২০১৮ সালের মধ্যে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৩০ অর্জনের যে লক্ষ্য স্থির করা হয়েছিল তা পূরণ করা হয়নি। বরং এর বিপরীতে আমরা দেখছি কোনো কোনো বিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৬০।
আবার কিছু বিদ্যালয়ে একজন মাত্র শিক্ষক দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে যেমন বরিশাল জেলার উজিরপুর উপজেলার শিবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে একজন মাত্র শিক্ষক আছেন। আবার কয়েকটি বিদ্যালয়ে একজনও শিক্ষক নেই, মসজিদের ইমাম ক্লাস নিচ্ছেন।
তাছাড়া অনেক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই, অন্য যে দুই-তিন জন শিক্ষক আছেন তাদের থেকে একজন ভারপ্রাপ্ত হিসেবে প্রধান শিক্ষক এর দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রশাসনিক কাজের চাপে নিয়মিত ক্লাস নিতে পারছেন না। যার ফলে অন্য শিক্ষকরা প্রতিনিয়ত প্রক্সি ক্লাস নিতে গিয়ে হাপিয়ে উঠছেন। আর এজন্য শিক্ষার গুনগত মান হ্রাস পাচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষিকা বলেন, আমাদের একেকটা ক্লাসে মনে করেন ৫০ জন ৬০ জন ছাত্র ছাত্রী। এতোজন শিক্ষার্থীদের ধরে ধরে বোঝানো তো সম্ভব না।
২০১৯ সালে ১৭ সেপ্টেম্বর বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৬৫% শিক্ষার্থীরা বাংলা রিডিং পড়তে পারে না, এর অন্যতম কারণ শিক্ষক সংকট।
২০১৯ সালে ইউনেস্কোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, একে তো শিক্ষার্থীদের অনুপাতে প্রয়োজনীয় দক্ষ শিক্ষকের অভাব। তার মধ্যে যে কয়জন আছেন তারাও তাদের পুরো সময় দিতে পারেন না (প্রধান শিক্ষকের প্রশাসনিক কাজের চাপ, মাতৃকালিন ছুটি, প্রশিক্ষণ জনিত ছুটি ইত্যাদি)। এছাড়া শিক্ষক সংকটের জন্য দূর্বল শিক্ষার্থীর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেয়া যাচ্ছে না।
এদেশের প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া লাল ফিতার দৌরাত্বের কারণে কচ্ছপ গতিতে চলে, একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন করতে যে সময় ব্যয় হয়, সে সময়ে তার চেয়ে বেশি সংখ্যক শিক্ষক অবসরে চলে যান, যার ফলে ১০০% শিক্ষকের পদ কখনোই পূরণ হয় না।
এছাড়া প্রতিবছর সহকারি শিক্ষক নিয়োগের নিয়ম থাকলেও তা দেয়া হচ্ছে না যেমন- ২০১৫, ২০১৬, ২০১৭, ২০১৯ এবং ২০২০ এ হবার কোনো আলামতও দেখতে পাচ্ছি না। আর প্রধান শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে না প্রায় ১০ বছর ধরে।
বাংলাদেশ প্রাইমারি এডুকেশন অ্যানুয়াল সেক্টর পারফরম্যান্স ২০১৯ এর তথ্য মোতাবেক একজন শিক্ষক দ্বারা পরিচালিত বিদ্যালয় ৭৪৯টি, ২ জন শিক্ষক দ্বারা পরিচালিত বিদ্যালয় ১ হাজার ১২৪টি, ৩ জন শিক্ষক দ্বারা পরিচালিত বিদ্যালয় ৪ হাজার ৮টি।
২০১৮ সালের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক ১৮ হাজার শিক্ষক যোগদান করার কথা থাকলেও বহু মেধাবী বেশি বেতনের সুযোগ পেয়ে অন্য পেশায় যোগ দিয়েছেন। নতুন শিক্ষক যোগদানের প্রক্রিয়া শেষ হবার পর গত ১১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রশ্নত্তোর পর্বে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন জানান, আরও ২৯ হাজার শিক্ষকের পদ শূন্য আছে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে যেখানে শূন্য পদে নিয়োগের কথা সুস্পষ্ট লেখা রয়েছে, সেখানে শিক্ষকের শূন্যপদ রাখার যৌক্তিকতা বোধগম্য না।
বর্তমানে করোনা পরবর্তীতে নতুন র্সাকুলার দিয়ে শিক্ষক চুড়ান্ত বাচাই শেষ করতে আরও কম করে হলেও ২ বছর লেগে যাবে, তখন শূন্যপদ গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ৮০-৯০ হাজার। তখন প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষক সংকটের জন্য ভেঙ্গে পড়বে।
সরকার ‘ভিশন-২০২১’ এর আওতায় ২০২১ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণের হার শতভাগে উন্নীত করার অঙ্গীকার করেছে। তার জন্য সরকার উপবৃত্তি,মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম, বিনামূল্যে বই ও মিডডে মিলসহ নানা কর্মসুচি গ্রহণ করছে। প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা অবকাটামো খাতে খরচ করছে কিন্তু তার পরে মানুষ প্রাইমারি বাদ দিয়ে কিন্ডারগার্ডেন এর দিকে ঝুঁকছে, এর অন্যতম কারণ শিক্ষক সংকট।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) সর্বশেষ প্রতিবেদনে প্রাথমিক শিক্ষাচক্রে ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বিভিন্ন কারণে ঝরে পড়ছে।
প্রতিমন্ত্রীর সংসদে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ১ম শ্রেণিতে ২ দশমিক ২ শতাংশ, ২য় শ্রেণিতে ২ দশমিক ৮ শতাংশ, তৃতীয় শ্রেণিতে ২ দশমিক ৯ শতাংশ, চতুর্থ শ্রেণিতে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ এবং পঞ্চম শ্রেণিতে ঝরে পড়ার হার ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। এ ঝড়ে পড়ার জন্য শিক্ষক সংকট অন্যতম দায়ী।
শিক্ষক সংকটের নিরসনের প্রধান উপায়
প্রাথমিকে শিক্ষক সংকট সুশিক্ষিত নাগরিক গঠনে প্রধান বাধা। তাই শিক্ষক সংকট দ্রুত কাটিয়ে উঠতে জরুরি ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। বর্তমানে প্রায় ৪০ হাজারের মত শূন্যপদ রয়েছে। আর বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে মার্চ মাস থেকে ক্লাস বন্ধ রয়েছে বিদ্যালয়গুলোতে এবং সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যদি ক্লাস বন্ধ থাকে তাহলে প্রাথমিক শিক্ষা মহাসংকটে পড়বে। এমন অবস্থায় শিক্ষার্থীরা অনেক পিছিয়ে পড়বে। করোনা পরবর্তীতে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে শূন্যপদ পূরণসহ অতিরিক্ত শিক্ষক দরকার। তাছাড়া যেহেতু সহকারি প্রধান শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে, আরও শূন্য পদ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া ৬৫০০০ রিজার্ভ শিক্ষক নিয়োগের কথাও সরকার বলে আসছে।
বর্তমান করোনা পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ও বর্তমানে যেহেতু কোনো নিয়োগ চলমান নেই, তাই জরুরি মুহূর্তে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হলে সরকারকে প্যানেলই বেছে নিতে হবে। আর এটাই হবে যুগোপযোগী ও শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত। কারণ বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে নতুন সার্কুলার দেয়া সম্ভব না। করোনা পরবর্তীতে নতুন সার্কুলার দিয়ে শিক্ষক বাছাই করা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাতে কম হলেও দেড়-দুই বছর লেগে যেতে পারে।
এছাড়া প্যানেল প্রত্যাশীদের সবাই মেধাবী। তারা তাদের মেধার পরিচয় দিয়েছে। তারা ২৪ লাখ থেকে বাছাই করা ৫৫ হাজার, শতকরা হার ২.৩। এর মধ্যে চূড়ান্তভাবে নিয়োগ পেয়েছে ১৮০০০ ও নিয়োগ বঞ্চিত হয় ৩৭০০০। সরকার প্যানেল প্রত্যাশীদের দাবি মেনে নিলে, ৩৭ হাজারের সবাই যোগদান করবে না, ২০-২৫ হাজার যোগদান করতে পারে, বাকিদের বিভিন্ন জায়গায় চাকরি হয়ে গেছে। আর বাংলাদেশের অন্যান্য সেক্টরে ভাইবা থেকে বাদ পরাদের প্যানেল পদ্ধতির মত করে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। যেমন বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে ২০০০ ডাক্তার ও ৫ হাজার ৫৪ জন নার্স নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আরও ২ হাজার ডাক্তার নিয়োগের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এছাড়া বিসিএস ব্যাংক বীমাসহ নানা সেক্টরে প্যানেল পদ্ধতি চালু আছে।
তাছাড়া প্যানেল প্রত্যাশীদের মধ্যে অনেকের চাকরির বয়স শেষ হয়ে গেছে। আর এটাই ছিল তাদের শেষ নিয়োগ পরীক্ষা। এছাড়া তারা চার বছর সেশন জট ও পাঁচ বছর প্রাইমারি নিয়োগ বন্ধ থাকায় অনেক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ২০১০, ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৪ সালে প্যানেল-পুল এর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ এর নজীর রয়েছে। প্যানেল প্রত্যাশীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিলে অনেক দিক থেকে লাভ হবে। যেমন এক ঢিলে অনেক পাখি মারার মত।
১. প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার পূরণ হবে (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- ‘মুজিববর্ষে কেউ বেকার থাকবে না’ এছাড়া বলেছেন ‘প্রতি ঘরে একজনকে চাকরি দিবেন’।
২. জরুরি পরিস্থিতিতে শিক্ষক সংকট কেটে যাবে।
৩. বেকারত্ব হ্রাস পাবে। অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে।
৪. প্রাথমিক শিক্ষা এগিয়ে যাবে।
৫. বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার যে ক্ষতি হয়েছে, সে ক্ষতি কমার একটা পথ হবে।
৬. ৩৭ হাজার প্যানেল প্রত্যাশী পরিবারের ডাল-ভাতের ব্যবস্থা হবে।
এছাড়াও স্থায়ীভাবে শিক্ষক সংকট কাটাতে প্রতিবছর শূন্যপদের ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ অব্যাহত থাকতে হবে।
মো. মুস্তাকিম মাহমুদ রিপন
হবিগঞ্জ জেলা
প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক নিয়োগ ২০১৮ প্যানেল প্রত্যাশী
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।