আন্তর্জাতিক ডেস্ক : পাঠাওয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা তরুণ উদ্যোক্তা ফাহিম সালেহ (৩৩) হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া টাইরেস ডেভোঁ হ্যাসপিলকে (২১) নিউইয়র্ক সময় শুক্রবার মধ্যরাতের মধ্যেই আদালতে হাজির করা হবে। তাঁর বিরুদ্ধে সেকেন্ড ডিগ্রি মার্ডারের অভিযোগ আনা হয়েছে।
মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যে নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অপরাধী গ্রেফতার হয়েছেন। ফাহিম সালেহর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন টাইরেস ডেভোঁ হ্যাসপিল। ফাহিমের বিপুল পরিমাণ অর্থ টেরেস ডেভোন চুরি করেছেন বলে আপাতত জানানো হয়েছে। যদিও হত্যাকাণ্ডের জন্য এটাই একমাত্র কারণ কি না, তা তদন্তকারীদের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি। শুক্রবার মধ্যরাতের মধ্যেই হ্যাসপিলকে আদালতে হাজির করার কথা। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত (নিউ ইয়র্ক সময় শুক্রবার রাত ১১টা) আদালতের সামনে প্রধান প্রধান সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হ্যাসপিলের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। গ্রেপ্তারের পর তাঁকে স্বাভাবিকভাবে পুলিশের সঙ্গে হেঁটে যেতে দেখা গেছে। তাঁর পক্ষে আদালতে ভিডিও শুনানিতে একজন আইনজীবীর উপস্থিত থাকার কথা জানিয়েছে নিউ ইয়র্কের আই উইটনেস নিউজ।
পুলিশ জানায়, গ্রেফতার টাইরেস ডেভোঁ হ্যাসপিল ব্রুকলিনে বড় হয়েছেন। নিউ ইয়র্কের হাফস্ট্রা ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করেছেন। নিজেও প্রযুক্তি জগতের লোক। লং আইল্যান্ডের ভেলিস্ট্রিম হাইস্কুলে পড়ার সময়ই ওয়েব ডিজাইন–সংক্রান্ত একটি জাতীয় প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন। ১৬ বছর বয়স থেকেই ফাহিম সালেহর সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন। তাঁর নিজেরও একটি কোম্পানি আছে। পুলিশ ফাহিম সালেহর ফোনের খুদে বার্তার সূত্র ধরেই এসব জানতে পেরেছে। কোম্পানি থেকে অর্থ হাতিয়ে নিলেও ফাহিম সালেহ টাইরেস ডেভোঁ হ্যাসপিলের নামে কোনো মামলা করেননি। টাইরেস ডেভোঁ হ্যাসপিলকে কিস্তিতে অর্থ পরিশোধের সুযোগ দিয়েছেন এমন প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। হত্যার সময় ঘাতক শুধু দামি স্যুট পরেছেন এমন নয়, লুইস ভুশন থেকে বেশ কিছু কেনাকাটারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। ক্রেডিট কার্ডের লেনদেনের সূত্রে টাইরেস ডেভোঁ হ্যাসপিল শনাক্ত করা পুলিশের জন্য সহজ হয়েছে।
ফাহিম সালেহ একা থাকতেন। ম্যানহাটনের এমন অভিজাত এলাকায় তাঁর মতো মিলিয়নাররাই থাকেন। ৩৩ বছর বয়সে আকাশচুম্বী সাফল্য ছিল তাঁর। ১৬ বছর বয়স থেকে ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করা টাইরেস ডেভোঁ হ্যাসপিল ফাহিম সালেহর দৈনন্দিন জীবন ভালো করে জানতেন। তবে তাঁরা কতটা ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
টাইরেস ডেভোঁ হ্যাসপিল সম্প্রতি ম্যানহাটনের হাউস্টন স্ট্রিটের কাছেই আরেকটি অভিজাত অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস শুরু করেন। ফাহিম সালেহর বসবাসের এলাকা থেকে কয়েক ব্লক দূরেই এসব অ্যাপার্টমেন্টে মাসিক ভাড়া ১৫ হাজার ডলার। টাইরেস ডেভোঁ হ্যাসপিলকে ১৫ জুলাই সড়কে হাঁটতে দেখা গেছে। ফাহিম সালেহ হত্যার ঘটনাস্থল থেকে এক মাইলেরও কম দূরত্বের ক্রসবি স্ট্রিট। এ স্ট্রিটের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ১৫ জুলাই দুপুর সাড়ে ১২টায় একজন নারীসহ তাঁকে বেরিয়ে যেতে দেখা গেছে বলে সিসি ক্যামেরার ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে।
১৭ জুলাই সকালে টাইরেস ডেভোঁ হ্যাসপিলকে ওই অ্যাপার্টমেন্ট থেকেই গ্রেপ্তার করা হয়। হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ১৩ জুলাই দুপুরের কিছু পরে। হত্যাকাণ্ডের পর ফাহিম সালেহর ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে হোম ডিপোট নামের দোকানে বাজার করেছেন হ্যাসপিল। সেখানেও সিসিই ক্যামেরায় তাঁকে দোকানে প্রবেশ ও বের হতে দেখা গেছে। যাতায়াতের পরিবহন ব্যয়টাও ফাহিম সালেহর ক্রেডিট কার্ড থেকে দেওয়া হয়েছে। নিউইয়র্ক পুলিশের চিফ ডিটেকটিভ রোডনি হ্যারিসন সংবাদ সম্মেলনে এনওয়াইপিডির সেভেন্থ প্রিসিংক্টকে দ্রুত এ মামলায় জড়িত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হওয়ায় অভিবাদন জানিয়েছেন।
ফাহিম সালেহর পরিবারের পক্ষ থেকে সাংবাদিকসহ সব মহলের প্রতি তাঁদের এ কঠিন সময়ে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রতি শ্রদ্ধা রাখার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। ১৬ জুলাই পরিবারের পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে পরিবার, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে বা ফাহিমের বন্ধুর সঙ্গেও যোগাযোগ না করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। পারিবারিক বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ফাহিমের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আসা সংবাদ শিরোনাম এখনো আমাদের অনুধাবনের বাইরে। ফাহিম সম্পর্কে যা বলা হচ্ছে, তিনি তার চেয়েও বেশি ছিলেন। ফাহিমকে মেধাবী এবং সৃষ্টিশীল উল্লেখ করে পারিবারিক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ফাহিম খুব অল্প বয়সেই সাফল্য পেয়েছিলেন এবং অন্যের মঙ্গলের জন্য কাজ করে গেছেন। তিনি যাই করুন না কেন, বৃহত্তর ভালো এবং তাঁর পরিবারের কথা ভেবে তিনি তা করতেন।
টাইরেস ডেভোঁ হ্যাসপিলকে গ্রেপ্তারের পর ফাহিম সালেহর পরিবারের কারও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এর আগে দেওয়া পারিবারিক বিবৃতিতে তদন্তের গভীরে গিয়ে ঘাতকের বিচার নিশ্চিত করার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছিল।
গোয়েন্দারা ধারণা করছেন, ফাহিম সালেহকে স্থানীয় সময় ১৩ জুলাই কোনো এক সময়ে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকারী ওই দিন চলে যাওয়ার পরদিন ১৪ জুলাই আবার ওই অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আসেন। এরপর ইলেকট্রিক করাত দিয়ে মরদেহ কয়েক টুকরা করে বড় আকারের ব্যাগে ভরে ফেলেন। হত্যার আলামত মুছে ফেলারও চেষ্টা করেন।
একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ফাহিম সালেহকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। কোপানোর আগে কোনো কিছু দিয়ে আঘাত করে তাঁকে অচেতন করা হয়েছিল। হত্যাকারী কালো রঙের স্যুট, সাদা শার্ট ও টাই এবং কালো মাস্ক পরে ফাহিম সালেহর পেছন পেছন ওই অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকেছিলেন। এ সময় হত্যাকারীর হাতে একটি ব্যাগও ছিল। লিফটের ভেতর থেকে সংগৃহীত সিকিউরিটি ক্যামেরা থেকে সংগৃহীত ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, হত্যাকারী নিজের উপস্থিতি এড়ানোর জন্য বিশেষ কৌশলে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহার করেন। এর আগে নিউইয়র্ক সিটির সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরা জানান, ফাহিম সালেহর গলা ও ঘাড়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানোর চিহ্ন রয়েছে। এতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন কর্মকর্তা এই হত্যাকাণ্ডকে ‘পেশাদার খুনির মতো কাজ’ বলে উল্লেখ করেছেন।
তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলছেন, হত্যাকারী যখন ফাহিম সালেহর শরীর টুকরা টুকরা করে ব্যাগে ভরছিলেন, তখন তাঁর বোন ওই অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকছিলেন। অ্যাপার্টমেন্টের লবিতে পৌঁছালে হত্যাকারী বিষয়টি টের পান, তখন অ্যাপার্টমেন্টের পেছনের দরজা ও সিঁড়ি দিয়ে হত্যাকারী বেরিয়ে যান।
ফাহিম সালেহর জন্ম ১৯৮৬ সালে। তাঁর বাবা সালেহ উদ্দিন চট্টগ্রামের, আর মা নোয়াখালীর মানুষ। ফাহিম পড়াশোনা করেছেন আমেরিকার বেন্টলি ইউনিভার্সিটিতে ইনফরমেশন সিস্টেম নিয়ে। তিনি রাইড শেয়ারিং অ্যাপ পাঠাওয়ের অন্যতম উদ্যোক্তা। ২০১৪ সালে নিউইয়র্ক থেকে ঢাকায় এসে পাঠাও চালু করে নতুন প্রজন্মের উদ্যোক্তা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন তিনি। ফাহিম নাইজেরিয়া ও কলম্বিয়ায় এমন আরও দুটি রাইড শেয়ারিং অ্যাপ কোম্পানির মালিক। ইন্দোনেশিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশেও তিনি ব্যবসা বিস্তৃত করেছিলেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।