সকালের কুয়াশা ভেদ করে মাঠে ছুটছে একঝাঁক তরুণ পায়ে বল। গোলপোস্টের জালে জড়িয়ে পড়ার শব্দ, দলগত কৌশলের নির্দেশনা, আর উৎসাহী কণ্ঠের করতালি—এই দৃশ্য বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শহুরে মাঠ পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। কিন্তু এই উচ্ছ্বাসের পেছনে লুকিয়ে আছে একটি জাতীয় প্রশ্ন: ফুটবলে কিশোর প্রতিভাদের খোঁজ কি যথাযথভাবে হচ্ছে? ভবিষ্যতের লাল-সবুজ জার্সি গায়ে দেবার যোগ্য খেলোয়াড় তৈরির এই যাত্রায় বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়িয়ে?
ফুটবলে কিশোর প্রতিভাদের খোঁজ: বাংলাদেশের বর্তমান পরিকাঠামো ও বাস্তবতা
খুলনার ফুলতলায় ১৪ বছরের সাকিবের দিন শুরু হয় ভোর ৫টায়। স্কুলের ভারী ব্যাগ আর ফুটবলের মধ্যে সমন্বয় করতে হয় তাকে। তার মতো হাজারো কিশোর প্রতিদিন লড়াই করছে অপর্যাপ্ত মাঠ, প্রশিক্ষণের সুযোগের অভাব আর আর্থিক সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (BFF) এর তথ্য অনুসারে, দেশে নিয়মিত যুব লীগে অংশ নেয়া কিশোর খেলোয়াড়ের সংখ্যা মাত্র ৩,২০০ জন—যেখানে প্রতিবেশী ভারতে এই সংখ্যা ১.৫ লাখেরও বেশি!
কিশোর প্রতিভা বিকাশের মূল চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা: ঢাকার বাইরে ৭০% উপজেলায় প্রমাণ সাইজের ফুটবল মাঠ নেই (জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, ২০২৩ রিপোর্ট)
- পদ্ধতিগত স্কাউটিংয়ের অভাব: গ্রামীণ এলাকায় ৮৫% প্রতিভা আনুষ্ঠানিক স্কাউটিং নেটওয়ার্কের বাইরে
- আর্থিক বোঝা: গড়ে মাসিক ৫,০০০ টাকা খরচ করতে হয় একটি প্রতিভাবান কিশোরের পরিবারকে (ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সমীক্ষা)
- শিক্ষা ও ক্রীড়ার সমন্বয়হীনতা: ৬০% প্রতিভাবান কিশোর ১৬ বছর বয়সের আগেই পড়াশোনার চাপে ফুটবল ছেড়ে দেয়
তবুও আশার আলো দেখাচ্ছে BFF এর ‘গ্রাসরুটস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম’। ফিফার আর্থিক সহায়তায় চলা এই প্রকল্পে ইতোমধ্যে ৮টি জেলায় স্থাপিত হয়েছে আধুনিক একাডেমি, যেখানে ১,২০০ কিশোর-কিশোরী নিয়মিত প্রশিক্ষণ পাচ্ছে। ফিফা গ্রাসরুটস হ্যান্ডবুক অনুসারে, এই ধরনের ব্যবস্থা দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় দলের ভিত্তি তৈরি করে।
“আমাদের চোখ এখন গ্রামের মাঠেও। গোপালগঞ্জের হরিদাস পাল কিংবা নেত্রকোণার সুমাইয়া আক্তার—এরা প্রমাণ করে প্রতিভা কোনো জেলায় সীমাবদ্ধ নয়,” বলছেন BFF যুব উন্নয়ন প্রধান মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম।
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রতিভা শনাক্তকরণ: বিশ্বের মডেল, বাংলাদেশের প্রয়োগ
ইউরোপীয় ক্লাবগুলোতে ফুটবলে কিশোর প্রতিভাদের খোঁজ একটি প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞান। বার্সেলোনার লা মাসিয়া বা অ্যাজাক্সের যুব একাডেমিতে প্রতিভা বাছাইয়ে ব্যবহৃত হয়:
- প্রযুক্তিগত মূল্যায়ন: বল নিয়ন্ত্রণ, পাসিং একুরেসি, শটিং টেকনিক
- শারীরিক প্যারামিটার: গতি, সহনশীলতা, সমন্বয় ক্ষমতা (GPS ট্র্যাকিং সহ)
- মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ: দলগত নেতৃত্ব, চাপ সামলানোর ক্ষমতা
- কগনিটিভ টেস্ট: খেলার বুদ্ধিমত্তা, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা
বাংলাদেশে এই পদ্ধতি প্রয়োগে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে ‘বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (BKSP)’। তাদের ফুটবল উইংয়ের প্রধান ড. মোহাম্মদ আলী বলেন, “আমরা প্রতি বছর ৫০০ কিশোরের মোটর স্কিলস, কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট ও টেকনিক্যাল এনালাইসিস করি। সেরা ৩০ জনকে স্কলারশিপ দেই। ২০২২ সালে BKSP থেকে ৬ জন যুব জাতীয় দলে নির্বাচিত হয়েছেন।”
স্থানীয় উদ্ভাবনও কম নয়:
- রাজশাহীর কোচ আব্দুর রহিম তৈরি করেছেন ‘দড়ি ড্রিল’—সীমিত স্থানে বল নিয়ন্ত্রণ শেখার কৌশল
- সিলেটের কোচিং ক্যাম্পে ব্যবহার হয় ‘গোল গেজার’ অ্যাপ—শটের কোণ ও গতি মাপার সরঞ্জাম
- কুমিল্লায় অভিভাবকদের নিয়ে সেশন: খেলোয়াড়ের পুষ্টি ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে ওয়ার্কশপ
সাফল্যের গল্প: যারা পেরেছে আলোর মুখ দেখাতে
ফয়সাল আহমেদের যাত্রা শুরু হয়েছিল বরিশালের উজিরপুরের একটি মাটি মাঠ থেকে। স্থানীয় কোচের চোখে পড়ার পর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় BFF একাডেমিতে। আজ তিনি বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২০ দলের নিয়মিত সদস্য। তার কথায়, “প্রতিদিন ৬ ঘণ্টা প্রশিক্ষণ, বিশেষ ডায়েট চার্ট, মেন্টাল সাপোর্ট সেশন—এগুলো না পেলে আমি এখানে আসতে পারতাম না।”
নারী ফুটবলের তারকা সৃষ্টি হচ্ছে জামালপুরের এডুকেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনে। ১৫ বছরের নুসরাত জাহান গত বছর সাউথ এশিয়ান যুব চ্যাম্পিয়নশিপে ৭ গোল করে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পেয়েছেন। তার প্রশিক্ষক শামীমা আক্তার বলেন, “মেয়েদের জন্য আলাদা হোস্টেল, নিরাপত্তা ও পরিবহন ব্যবস্থা তৈরি করতে হয়েছে। এখন গ্রামের মেয়েরাও স্বপ্ন দেখতে শিখছে।”
উল্লেখযোগ্য প্রোগ্রাম: | প্রতিষ্ঠানের নাম | অবস্থান | সাফল্য |
---|---|---|---|
বাফুফে ফুটবল একাডেমি | ঢাকা | ১২ জন জাতীয় যুব দলে নির্বাচিত | |
চট্টগ্রাম আবাহনী যুব প্রোগ্রাম | চট্টগ্রাম | আই-লিগ জুনিয়র চ্যাম্পিয়ন ২০২৩ | |
সাতক্ষীরা ফুটবল নার্সারি | সাতক্ষীরা | ৮ জন বিভাগীয় দলে জায়গা |
অভিভাবক ও কোচদের জন্য গাইডলাইন: কীভাবে সহায়তা করবেন?
কিশোর প্রতিভা বিকাশে অভিভাবকদের ভূমিকা অপরিসীম। মনোবিদ ড. তাহমিনা আক্তারের পরামর্শ:
- উচ্চাকাঙ্ক্ষা নয়, আনন্দকে প্রাধান্য দিন: ৭০% কিশোর চাপে ভোগে অতিরিক্ত প্রত্যাশার কারণে
- শিক্ষা-ক্রীড়ার ভারসাম্য: প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় বণ্টন করুন
- মানসিক স্বাস্থ্য নজরদারি: হঠাৎ মেজাজ পরিবর্তন বা আগ্রহ হারালে মনোবিদের পরামর্শ নিন
- পুষ্টির ব্যালেন্স: প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ ডায়েট চার্ট মেনে চলুন
কোচদের জন্য জরুরি নির্দেশনা:
- বয়সভিত্তিক ট্রেনিং মডিউল: ১২-১৪ বছর বয়সীদের জন্য টেকনিক্যাল ড্রিল, ১৫+ বয়সীদের ট্যাকটিক্যাল এডুকেশন
- ইনজুরি প্রতিরোধ: ওয়ার্ম-আপ ও কুল-ডাউন সেশন বাধ্যতামূলক করুন
- নেতৃত্ব বিকাশ: রোটেশন করে ক্যাপ্টেন বানান, সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত করুন
“একজন ভালো কোচ শুধু খেলা শেখান না, সে জীবন শেখায়,” — কাজী সালাউদ্দিন, বাংলাদেশের প্রথম ফিফা স্টার কোচ।
ভবিষ্যতের রোডম্যাপ: সুপারিশ ও করণীয়
ফুটবলে কিশোর প্রতিভাদের খোঁজ প্রক্রিয়াকে বদলাতে হলে জরুরি:
- জাতীয় স্কাউটিং নেটওয়ার্ক: প্রতিটি উপজেলায় প্রশিক্ষিত স্কাউট নিযুক্ত করা
- সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব: কর্পোরেট স্পনসরশিপ বাড়ানো
- ডাটা ড্রিভেন সিলেকশন: খেলোয়াড় পারফরম্যান্স ট্র্যাকিং সফটওয়্যার চালু
- মহিলা ফুটবল একাডেমি: জেলা পর্যায়ে অন্তত ২০টি বিশেষায়িত কেন্দ্র
- মানসিক স্বাস্থ্য ইউনিট: প্রতিটি একাডেমিতে কাউন্সেলিং সেবা
ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শারমিন আক্তারের ভাষ্যে, “২০২৫ সালের মধ্যে আমরা ১০০টি নতুন আধুনিক মাঠ নির্মাণ করব। প্রতিটি বিভাগীয় স্টেডিয়ামে যুব একাডেমি স্থাপনের পরিকল্পনাও চূড়ান্ত পর্যায়ে।”
প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে BFF চালু করেছে ‘ফুটবল ট্যালেন্ট হান্ট’ মোবাইল অ্যাপ। এখানে কিশোররা তাদের ভিডিও আপলোড করতে পারে, যার মূল্যায়ন করবেন জাতীয় কোচিং প্যানেল। প্রথম পর্যায়ে ১২,০০০ রেজিস্ট্রেশনের মধ্যে ৮ জনকে সরাসরি জাতীয় ক্যাম্পে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
ফুটবলে কিশোর প্রতিভাদের খোঁজ শুধু খেলোয়াড় তৈরির প্রক্রিয়া নয়, এটা একটি জাতির ভবিষ্যত নির্মাণের অভিযান। বাংলাদেশের মাঠে-মাঠে যে স্বপ্নের বীজ বপন হচ্ছে, তার ফসল আমরা পাব আগামী বিশ্বকাপের মঞ্চে। আপনার সন্তান, আপনার পাড়ার কিশোর—সবাই পারে এই যাত্রার অংশ হতে। আজই স্থানীয় ফুটবল ক্লাবের সাথে যোগাযোগ করুন, সমর্থন জোগান প্রতিভা বিকাশের এই মহৎ প্রচেষ্টায়। কারণ, আজকের সেই কিশোরই হতে পারে আগামী দিনের জামাল ভূঁইয়া কিংবা সাবিনা খাতুন!
জেনে রাখুন
প্র: ফুটবলে কিশোর প্রতিভা শনাক্তের আদর্শ বয়স কত?
উত্তর: বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুযায়ী ৮-১২ বছর বয়স হলো মৌলিক দক্ষতা শেখার স্বর্ণালি সময়। তবে ১৪-১৬ বছর বয়সে টেকনিক্যাল ও ট্যাকটিক্যাল প্রশিক্ষণ তীব্রতা পায়। বাংলাদেশে BFF স্কাউটিং সাধারণত শুরু হয় ১০ বছর বয়স থেকে।
প্র: গ্রামে থাকা প্রতিভাবান কিশোরেরা কীভাবে জাতীয় পর্যায়ে সুযোগ পেতে পারে?
উত্তর: BFF এর জেলা কমিটির মাধ্যমে সরাসরি আবেদন করা যায়। এছাড়া BKSP ও বাফুফে একাডেমির ওপেন ট্রায়ালে অংশ নেওয়া যায়। সাম্প্রতিক ‘ফুটবল ট্যালেন্ট হান্ট’ অ্যাপও একটি মাধ্যম। স্থানীয় কোচ বা স্কুল শিক্ষকের সুপারিশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
প্র: অভিভাবক হিসেবে খরচ সামলাবো কীভাবে?
উত্তর: BFF একাডেমি, BKSP এবং কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (আবাহনী, মোহামেডান) ফুল স্কলারশিপ দেয়। ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের ‘জাতীয় ক্রীড়া সহায়তা তহবিল’ থেকেও আর্থিক সাহায্য পাওয়া যায়। জেলা ক্রীড়া অফিসে যোগাযোগ করে জেনে নিন আবেদনের প্রক্রিয়া।
প্র: মেয়ে ফুটবলারদের জন্য বিশেষ সুবিধা আছে কি?
উত্তর: বাংলাদেশে নারী ফুটবল উন্নয়নে বিশেষ প্রকল্প চালু হয়েছে। BFF নারী একাডেমি (গাজীপুর), সাতক্ষীরা ফুটবল নার্সারি ও জেলা পর্যায়ে বিশেষ ট্রায়ালের মাধ্যমে মেয়েদের বাছাই করা হয়। আবাসন, নিরাপত্তা ও শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
প্র: ফুটবল প্রশিক্ষণের পাশাপাশি পড়াশোনা কীভাবে চালিয়ে যাবে?
উত্তর: BKSP, BFF একাডেমি এবং প্রধান ক্লাবগুলোর একাডেমিতে অন-ক্যাম্পাস স্কুলিং সিস্টেম আছে। সকালে পাঠদান ও বিকেলে প্রশিক্ষণের রুটিন অনুসরণ করা হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান প্রাইভেট টিউটরও রেখেছে।
প্র: কিশোর ফুটবলারদের জন্য পুষ্টি পরিকল্পনা কী হওয়া উচিত?
উত্তর: জাতীয় পুষ্টি পরিষদ সুপারিশ করে দৈনিক ৩,০০০-৩,৫০০ ক্যালোরি ডায়েট, যেখানে ২০% প্রোটিন, ৫০% কার্বোহাইড্রেট ও ৩০% ফ্যাট থাকবে। প্রচুর পানি, সবুজ শাকসবজি এবং ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার অপরিহার্য। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে পুষ্টিবিদের পরামর্শ বিনামূল্যে দেওয়া হয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।