জয়নুল আবেদীন : ফেয়ারলপ ওয়াটার্স কান্ট্রি পার্ক, হেনল ফরেস্ট কান্ট্রি পার্ক ও চ্যাফোর্ড গর্জেস নেচার পার্ক, লন্ডনের ঐতহ্যবাহী তিন বৈশিষ্ট্যের তিনটি পার্ক। একসাথে পার্ক ও পানি দেখার জন্য যেতে হবে ফেয়ারলপ ওয়াটার্স কান্ট্রি পার্ক (Fairlop Waters Country Park)। পানি ও প্রকৃতি দেখার জন্য যেতে হবে হেনল ফরেস্ট কান্ট্রি পার্ক (Hainaul Forest Country park) আর শুধুই প্রকৃতি দেখার জন্য যেতে হবে চ্যাফোর্ড গর্জেস নেচার পার্ক (Chaffrod Gorges Nature park)।
St. Chad’s Park-এর উত্তর-পশ্চিম দিকে ইস্টার্ন এভিনিউ রোড পার হয়ে সামনেই ফেয়ারলপ ওয়াটার্স কান্ট্রি পার্ক। কান্ট্রি পার্কের উত্তর-পূর্ব দিকের সীমানা যেখানে শেষ সেখান থেকে শুরু হেনল ফরেস্ট কান্ট্রি পার্ক। ঘরের পাশের St. Chad’s Park সহ তিনটি পার্কই চ্যাডস উইল হিথ এলাকায়। চ্যাডস উইল হিথ এলাকার বাইরে চ্যাফোর্ড হান্ড্রেডে অবস্থিত চ্যাফোর্ড গর্জেস নেচার পার্ক। ওয়াটার কান্ট্রি পার্ক জুড়ায় নয়ন আর চ্যাফোর্ড গর্জেস নেচার পার্ক জুড়ায় মন।
মনুষ্য প্রত্যঙ্গের ১৪ ইন্দ্রিয়ের অন্যতম ইন্দ্রিয় নয়ন। আর মন হচ্ছে, সত্তা বা জীবনের অস্তিত্ব। নয়নের চেয়ে মনের গুরুত্ব অনেক বেশি। তাই, মন যেখানে জুড়ায় দেহটাকে সেখানেই নিয়ে যাই। দ্বিতীয় কারণ, মনুষ্য সৃষ্ট বিস্ময় আর স্রষ্টার সৃষ্ট বিস্ময়ে আসমান-জমিন তফাৎ। যেমন- মনুষ্য সৃষ্ট মধ্যযুগীয় সপ্তম বিস্ময়ের একটি ছিল আগ্রার তাজমহল। এখন ভারতের পর্যটন তালিকায় তাজমহলের নামই নেই।
২০০২ সালে দেখতে গিয়েছিলাম বিশ্বের সর্বোচ্চ ইমারত পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার (এক হাজার ৪৮৩ ফুট)। কয়েক বছর পরই মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস টাওয়ারকে ছাড়িয়ে যায় বুর্জ খলিফা (দুই হাজার ৭১৭ ফুট)। বুর্জ খলিফাকে অচিরেই ছাড়িয়ে যাবে দুবাইয়ের অপর একটি টাওয়ার ক্রিক হারবার (তিন হাজার ৪৫ ফুট)। মানুষের তৈরি বিস্ময়কে মানুষ খুব সহজেই অতিক্রম করতে পারে। অতিক্রম করতে পারে না স্রষ্টার বিস্ময়কে।
১৭৭৩ সালের দিকে অক্সিজেন আবিষ্কার করেন তিন বিজ্ঞানী। মানব দেহের সাথে অক্সিজেনের হিসাবটা মনে করিয়ে দিয়ে গেছে কোভিড-১৯। ‘প্রতিবার দম নেয়ার সাথে সাথে শরীরের পাঁচ ট্রিলিয়ন লোহিত কণিকা বাতাসের মুখোমুখি হয়। প্রতিটি রক্ত কণিকায় রয়েছে ২৮০ মিলিয়ন হিমোগ্লোবিন অণু। প্রতিটি অণু আটটি করে (১১ অঙ্কটির পর ২১টি শূন্য) অক্সিজেন পরমাণু পরিবহন করতে পারে, (কোয়ান্টাম মেথড পৃষ্ঠা-১৮) মানুষ বর্তমানে জানতে পারলেও, প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে হিসাবটা চলে আসছে বিলিয়ন বিলিয়ন বছর থেকে। এরকমই মহাবিশ্বের একেকটি বিস্ময়ের তুলনায় মানুষের আবিষ্কৃত বিস্ময় খুবই নগণ্য। তাই গর্জেস নেচার পার্ক দেখার পর কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হয়েছিল জীবনানন্দ দাসের কবিতা।
নয়ন জুড়ায় ফেয়ারলপ ওয়াটার্স কান্ট্রি পার্ক
ফেয়ারলপ ওয়াটার্স কান্ট্রি পার্ক আমাদের বাসার কাছাকাছি। আমাকে নিয়ে হেনা গাড়িতে ওঠার ১৫-২০ মিনিটেই চলে আসে। আমরা যখন পার্কে আসি তখন পার্কের কারপার্কিং এলাকাও শূন্য। জনশূন্য পার্কও। প্রবেশ পথেই মোটা মোটা অক্ষরে লেখা নির্দেশাবলি। বিদেশ-বিভুঁইয়ে কোথাও প্রবেশের আগে নির্দেশাবলি পাঠ করে নিতে হয়। নেপাল গিয়ে নির্দেশাবলি পাঠ না করে এক মন্দিরের ছবি তুলে বিপদে পড়েছিলাম। অল্পের জন্য ক্যামেরাটি রক্ষা পেয়েছিল। কলকাতা জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে প্রবেশের আগেও নোটিশ বোর্ড পড়ে জেনে নিতে হয় নিয়ম-কানুন। ফেয়ারলপ ওয়াটার্স কান্ট্রি পার্ক সম্পর্কে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, ফেয়ারলপ ওয়াটার্স কান্ট্রি পার্ক রেডব্রিজের বৃহত্তম কান্ট্রি পার্ক। পার্কটি M 25 and A 12-এর মাধ্যমে সহজেই অ্যাক্সেসযোগ্য। এখানে সারা বছর হাঁটাচলার জন্য অ্যাক্সেসযোগ্য পথ রয়েছে। এখানে বন্যপ্রাণীর কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
বৃহত্তম হ্রদটি পালতোলা, রোয়িং ও উইন্ডসার্ফিংয়ের মতো জলযান পরিচালনার ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে পারিবারিক ও পার্টি অনুষ্ঠানের জন্য ছোট-বড় ফাংশন রুম। সব বয়সের লোকদের জন্য রয়েছে ক্লাইম্বিং সুবিধাও। যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় বোল্ডার পার্কের পাশাপাশি তরুণ দর্শকদের জন্য রয়েছে বড় আকৃতির খেলার জায়গাও। বোল্ডার পার্কে ৯টি স্বতন্ত্র বোল্ডার রয়েছে যা স্প্রে ও ঢালাই করা কংক্রিট দিয়ে তৈরি। জনপ্রিয় এই পার্কে রয়েছে হ্রদ, পুকুর ও সবুজ ঘাসের মাঠ, walking, cycling, golf, climbing, angling, sailing, canoeing etc.
১২০ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট পার্কের মাঝখানে লেক। লেকের মাঝে দু’টি ছোট-বড় দ্বীপ। আমাদের হাতির ঝিলের মতো। পার্থক্য, হাতির ঝিলে লেকের মধ্যে অবস্থিত দ্বীপের সাথে পাড়ের সংযোগ আছে; ওয়াটার্স কান্ট্রি পার্কের দ্বীপের সাথে পাড়ের সংযোগ নেই। হাতির ঝিলের চারপাশ পরিভ্রমণ করার জন্য রয়েছে বিশেষ বাস আর ফেয়ারলপ ওয়াটার্স কান্ট্রি পার্কের লেকের চারপাশ ঘুরতে হয় পায়ে হেঁটে বা সাইকেল চড়ে। এটা ছাড়াও হাতির ঝিলে লেকের পাড় ছাড়া কোনো পার্ক নেই, ফেয়ারলপ ওয়াটার্স কান্ট্রি পার্কের লেকের চারপাশেই পার্ক। যেমন উত্তর-পূর্ব দিকে Woodland Zone. পশ্চিমে-দক্ষিণ দিকের পার্শ্বজুড়ে রয়েছে Clyhall Park, Wanstead Park, Valfntines Park, Seven Kings Park and Havefung Park এ রকম অর্ধ-ডজন পার্ক।
সেখানে বিশাল উন্মুক্ত স্থান ছাড়াও রয়েছে খেলার মাঠ, ক্লাব হাউজ, গলফ ড্রাইভিং রেঞ্জ, গলফ কোর্স ছাড়াও রয়েছে শিশুপার্ক। পার্কে শিশুদের বিনোদনের জন্য রয়েছে আকর্ষণীয় নানা প্রকারের রাইড। আছে Country park office, Cafe. লেকে চালানোর জন্য ভাড়ায় নৌকাও পাওয়া যায়। নৌকা চালনার আগে রয়েছে কঠোর সতর্কতা। সতর্কতা নোটিশে উল্লেখ রয়েছে- Boot hire. Please observe the following rules 12 rules. ১২টি আইনের পরে লেখা রয়েছে, Danger deep and cold water remains in your boat at all times no swimming at any time.
মানুষের জন্য সাঁতার কাটা কঠোর বারণ থাকলেও সাঁতার কাটছে অসংখ্য জলচর পাখি যে পাখি আমাদের বিল-ঝিল থেকে হারিয়ে গেছে কয়েক যুগ আগে যার মধ্যে রাজহাঁসের সংখ্যাই বেশি। ছোট-বড় ও মাঝারি কত প্রকারের হাঁস! শুমার করা সম্ভব নয়। হাঁসের মধ্যে রাজহংসের সংখ্যাই বেশি। কোনোটার ওজন ১৫-২০ কেজির কম হবে না। হাঁসের পেছনে পেছনে সাঁতার কাটছে হাঁসের বাচ্চাও। ঝোপের ভেতর থেকে বাচ্চাসহ উঠে আসছে মা হাঁস। হাঁস পরিবার সবুজ ঘাসের উপর হেলেদুলে হাঁটছে। একটি পাতিহাঁস ঠিক আমাদের গৃহপালিত পাতিহাঁসের মতোই ঘাসের উপর হাঁটছিল। ছবি নেয়ার জন্য কাছে যেতেই দৌড় দেয়। আমিও দৌড় দিই। আমাকে পেছনে পেছনে দৌড়াতে দেখে শাঁ করে উড়ে যায় আকাশে। বাঁক ঘুরে চলে যায় লেকের অপর প্রান্তে।
আমাদের দেশে গৃহপালিত হাঁস কোকিলের মতো ডিমে তা দেয় না। যেখানে সেখানে ডিম পাড়ে। মা-বোনেরা ডিম সংগ্রহ করে বাচ্চার জন্য মুরগি দিয়ে তা দেয়ায়। এখানকার অবস্থা ভিন্ন। মনে হয়, লেকের পাশের ঝোপঝাড়ের ভেতরেই রয়েছে এসব জলচর পাখির বাসা। নিজেরাই নিজেদের ডিমে তা দেয়। এরা উড়ে যেতে পারে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায়।
লেকের পাড়ের সাইকেল রোড দিয়ে হাঁটছি আর জলচর পাখির স্থলে বিচরণ দেখছি। এক জায়গায় দেখি এক মাছ শিকারিকে। পেশাদার আধুনিক মাছশিকারি। পাশেই তাঁবু। শিকারির আচার-আচরণ বেশভূষণ ও তাঁবুর ভেতরের বেডিংপত্র দেখে মনে হয়, শিকারি রাতে এই তাঁবুতেই ছিলেন। তাঁবুর ভেতর চা-কফি বানানোর সরঞ্জামসহ রয়েছে শয়নের ব্যবস্থাও। যারা রাতে মাছ শিকার করে তারা বড়শি ও টোপের সাথে বাতির ব্যবস্থা রাখেন। বড়শির টোপের সাথে তখনো নীল বাতি জ্বলছিল। ধৃত মাছ জালিতে ভরে রেখে দিয়েছিল ঝোপের পাশে পানির তলায়। অনেক উঁকি-ঝুঁকি করেও মাছ দেখা সম্ভব হয়নি। বর্ণিল রাইডসহ সামনেই শিশুপার্ক। শিশুপার্কের আগে রাজহংসের ঘাট। সানবাঁধানো ঘাটে রাজহংসের মেলা। নির্ভয়ে জলকেলি করছে অসংখ্য হাঁস। কাছাকাছি গিয়ে ছবিও নেয়া যায়।
শিশুপার্কের পরই woodland zone. শত বছরের পুরনো গাছ, গাছের গুঁড়ি, গাছ দিয়ে বানানো রাইডসহ বিস্ময়কর স্থাপনা। সেখানেও একজন মাছশিকারি। এই শিকারি বড়শি ফেলার আয়োজন করছিলেন। পেশাদার মাছশিকারি। আস্তে আস্তে এগিয়ে যাই শিকারির কাছে। তিনটি ছিপ। এক এক করে ফেলতে শুরু করেছেন। বাস্কেট ভর্তি খাবার। এত খাবার ৫০ ছিপও শেষ করতে পারবে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশদের মাছ ধরার কৌশল দেখছিলাম। আমার মাছ ধরার নেশা আশৈশব। নদীবেষ্টিত চর এলাকায় জন্ম। বাড়ির চারপাশে কিলবিল করত মাছ। শৈশবে কাপড় পরা শেখার আগে ছিপ হাতে নেয়া শিখেছিলাম। মাঠ-ঘাট উঠান-বাড়ি থেকে বর্ষার পানি নেমে গেলেও ডোবা-নালায় আটকে থাকত প্রচুর মাছ। মাঝে কাদামাটির বাঁধ দিয়ে পানি সেঁচে কৈ শিংসহ অসংখ্য গুঁড়া মাছ। আমার মাছ ধরার হাতেখড়ি বাঁশের কঞ্চির ছিপ দিয়ে। চাকাওয়ালা ছিপসহ আধুনিক কলাকৌশল জানা ছিল না। বছর দশেক আগে বর্তমান বাড়ির পাশের জলাশয়ে টিকিট দিয়ে ছিপশিকারিরা মাছ ধরেছিল।
জলাশয়ের মালিক আগের দিন জলাশয়ে প্রচুর খাবার ছড়িয়েছিল যাতে মাছ শিকারিদের টোপের মাছ না গিলে। পরের দিন দেখলাম, শিকারিরা মাছের খাবার দলা বানিয়ে ঢিল ছুড়ে জলে ফেলছে। এর নাম মাছের চারা। চারা পদ্ধতিতে মাছ ধরে এক দিনেই জলাশয় মৎস্যশূন্য করে ফেলেছিল।
এখানেও ব্রিটিশ মাছশিকারিকে তাই করতে দেখলাম। দেখলাম, বড় কলার আকৃতি প্লাস্টিকের খেলনা রকেট। রকেটের ভেতরে খাবার ভরে বড়শির সুতার মাথায় আটকিয়ে সজোরে নিক্ষেপ করে। খাবারসহ অনেক দূর চলে যায় রকেট। রকেটের খোল খুলে যায়। খাবার ছড়িয়ে পড়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। এক সময় ভাবতাম, ব্রিটিশরা পরের রাজ্য জয় করার ক্লাইভি কৌশল যত ভালো জানে, মাছ ধরার কৌশল তত ভালো জানে না। মাছ ধরার কৌশল জানি আমরা। চায়না ও কারেন্ট জাল দিয়ে নদ-নদী মৎস্যশূন্য করে ফেলেছি। মাছও বোকা। আগের দিন মালিক পেট ভরে খাওয়ানোর পরও কি দরকার ছিল শিকারির টোপ খাওয়া? এখন দেখছি, ব্রিটিশরা মাছ ধরার দিক দিয়েও চৌকস। আমরা যখন ডালে ডালে, ব্রিটিশরা তখন পাতায় পাতায়। আমার মুখে ব্রিটিশদের বুদ্ধির কথা শুনে হেনা, ‘আব্বা, মাছও ব্রিটিশ। চারদিক থেকে যেভাবে ঘ্রাণযুক্ত খাবার ছড়িয়ে ছিপ ফেলছে, জলাশয় দু’দিনেই মৎস্যশূন্য হয়ে পড়ার কথা। মাছেরা নিশ্চয়ই মুখরোচক খাবার এড়িয়ে চলে।’
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
E-mail: [email protected]
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।