মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে বিশাল এক দৈত্য। চারদিক জ্বালিয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। ধীরে ধীরে সেই আগুন গ্রাস করে ফেলছে জনমানুষ, দোকানপাট, প্রাচীন স্থাপত্য। দৈত্যকে দমন করতে আকাশপথে উড়ে এল সুপারহিরো ‘মিস্টিরিও’। চোখধাঁধানো লড়াইয়ের পর দুষ্টের দমন। করতালিতে ফেটে পড়ল পৃথিবী। কিন্তু কিছু ক্ষণের মধ্যেই জানা গেল, সবই ছিল একটি খেলা। চোখের ভেল্কি। ড্রোন এবং প্রজেক্টরের সাহায্যে হলোগ্রামে তৈরি হয়েছিল পুরোটা। দৈত্যও, এমনকি, সুপারহিরোও। এবং যে মানুষটিকে সকলে সুপারহিরো বলে প্রশংসায় ভরিয়ে দিচ্ছিল, দেখা গেল এগুলি সব তারই কুকীর্তি। সাধারণ মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে সুপারহিরো সাজার শখ হয়েছিল তার!
উপরের ঘটনাটা ‘স্পাইডারম্যান: ফার আওয়ে ফ্রম হোম’-এর দৃশ্য। যেখানে সাধারণ মানুষের চোখে ভাল-খারাপের ফারাক গুলিয়ে যায় আলোর ভেল্কি দেখে। ‘চোখে না দেখলে বিশ্বাস করব না’-র জমানা শেষ। এমন অনেক কিছুই রয়েছে, যা চোখে হয়তো আমরা দেখতে পাই না। কিন্তু তার অস্তিত্ব প্রমাণিত। সেগুলি সবই ‘ইনট্যাঞ্জিব্ল’ ধারণা। যেমন ব্রহ্মাণ্ডের কৃষ্ণগহ্বর, বা শেয়ার বাজারের ধনসম্পদ।
কিন্তু আপনি কোনও জায়গায় দাঁড়িয়ে, চোখের সামনে, সেই মুহূর্তে যদি কাউকে দেখতে পান, তা হলে তার অস্তিত্ব নাকচ করে দেওয়া এত সোজা? চোখে দেখা কোনও ঘটনাও বিশ্বাস না করতে পারলে আর কী ভাবে বিশ্বাস রাখা যায় নিজের উপর!
হঠাৎ কল্পবিজ্ঞানের সিনেমার এক তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে কেন এত হা-হুতাশ! রুপোলি পর্দার ঝলকানি তো সবটাই মিথ্যা! আর কল্পবিজ্ঞানের সঙ্গে বাস্তবের মিল খুঁজতে যাওয়াই তো মূর্খামি! কিন্তু সেই কল্পকথাই যদি এক দিন বাস্তব হয়ে যায়?
হয়তো সেই প্রশ্নই খানিকটা উস্কে দিয়েছিল তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন ধনকুবেরকে। তাই ইন্টারনেটের দুনিয়াকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়ে সম্পূর্ণ নতুন একটি দুনিয়া তৈরি করার দিকে তাঁরা বিনিয়োগ চালিয়ে যাচ্ছেন। সেই দলে রয়েছে ফেসবুক, মাইক্রোসফ্ট এবং মাইনক্রাফ্ট বা রোবোলক্স’-এর মতো কিছু ভিডিয়ো গেম প্রস্তুতকারী সংস্থাও। তারা সকলেই দৌড়চ্ছে ‘মেটাভার্স’ জয় করার জন্য। এমন এক পৃথিবী, যা পুরোটাই নকল। পুরোটাই চোখের ভেল্কি!
আর একটু ভেঙে বলা যাক। ‘মেটাভার্স’ আসলে ইন্টারনেটকেই আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভাবনা। এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে দূরত্ব ঘুচেছে। প্যারিসে কিছু ঘটলে সেই ছবি মুহূর্তে পাটুলিতে বসে দেখা যায় স্মার্টফোনে। শিকাগোয় থাকা নাতি-নাতনির সঙ্গে ভিডিয়ো কল’-এ মাধ্যমে নৈশভোজ সারতে পারেন শ্যামবাজারের দিদিমা-দাদু।
কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়া আরও এগিয়ে যেতে চায়। শুধু পর্দার ওপারে বসা নাতি-নাতনিকে খেতে দেখে আর মন ভরে না। কী করে নাতির পাশের চেয়ারে বসে নিজের খাওয়াটাও সেরে ফেলা যায়, সেই চিন্তা ভাবিয়ে তুলেছে সকলকে। হোক না মিছিমিছি, কিন্তু সম্ভব হলে ক্ষতি কী!
সেই তাগিদেই তৈরি হচ্ছে মেটাভার্স। একটু একটু করে ‘অগুমেন্টে়ড রিয়্যালিটি’, ‘থ্রি-ডি হলোগ্রাম’ এবং ‘ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি’ মিশিয়ে এমন এক জগৎ বোনা হচ্ছে, যেখানে আপনি কাঁকুড়গাছিতে বসেও চোখে অগুমেন্টেড রিয়্যালিটির চশমা লাগালে সত্যিই কোয়েচেলার কনসার্টে পৌঁছে যেতে পারেন। মনে হবে যেন কোয়েচেলার হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে পা মেলাচ্ছেন। চোখের সামনে দেখবেন মানুষের ভিড়, কিন্তু সেই ভিড় আদপে নকল। নিজের ঘরের ভিতর আপনি একাই ঘুরছেন।
শুনে মনে হতে পারে, বিষয়টা ভারী মজার। কিন্তু তাই কি? ধরুন আপনি নিজের ঘরে নয়, রয়েছেন পার্কে। চোখে জাদুচশমা পরে মনে হচ্ছে কোয়েচেলার ভিড়ের মধ্যে রয়েছেন। ধাক্কা খাওয়ার ভয়ে এক পা এক পা করে সরে কখন যে পার্ক থেকে বেরিয়ে ‘সত্যি’ রাস্তার ভিড়ে এসে পড়েছেন টের পাননি। দুর্ঘটনা ঘটতে পারে যে কোনও মুহূর্তে। ‘পোকেমন’ ভিডিয়ো গেম বাজারে আসার পর যেমন পোকেমন ধরার ঝোঁকে মানুষ মেতে উঠেছিল, তেমনই। দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে মৃত্যু পর্যন্ত গড়িয়েছিল।
তবে এই তুচ্ছ বিপদ-আপদে পিছিয়ে যাবে না মানুষ। মেটাভার্সের দুনিয়া অধিকাংশের কাছেই খুব লোভনীয়। থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স অঙ্ক করে দেখিয়ে দিয়েছে একাধিক ব্রহ্মাণ্ডের অস্তিত্ব থাকা স্বাভাবিক। সেই থেকে কল্পবিজ্ঞানে আমাদের বিকল্প অস্তিত্ব নিয়ে যথেষ্ট মাতামাতি তৈরি হয়েছে। ভিডিয়ো গেমের জগতে অবশ্য অনেক আগে থেকেই থ্রি-ডি অবতার তৈরি ব্যবস্থা ছিল। প্রত্যেকে নিজের বিক্লপ অস্তিত্ব বানাতে পারবে। লাজুক ছেলেও প্লেবয় হয়ে উঠতে পারে, বেঁটে মেয়েও হয়ে ওঠে অ্যাঞ্জেলিনা জোলি। বাস্তব জীবনের খামতিগুলো ঢেকে ফেলা যায় সেই কল্প-দুনিয়ায়।
কিন্তু অনেকে এই ভার্চুয়াল দুনিয়ায় হারিয়ে গিয়ে বাস্তবটাই ভুলে মেরে দিতে চান। হারিয়ে যেতে চান রূপকথার দেশে। তবে তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন, মেটাভার্সে হুল্লোড় করে বড়দিন কাটানো মজাদার হতে পারে, কিন্তু ওমিক্রনের বাড়বাড়ন্তই কঠিন বাস্তব। বাস্তব থেকে পালিয়ে যদি গবেষকরাও মেটাভার্সে সারা ক্ষণ মজে থাকেন, তা হলে জুতসই প্রতিষেধক কি ঠিক সময়ে তৈরি হবে?
মেটাভার্সের অবশ্য ভাল দিকও রয়েছে। ধীরে ধীরে মেটাভার্স যখন মূলধারার ইন্টারনেটে চলে আসবে, তখন বিভিন্ন সংস্থাগুলির প্রশিক্ষণ পর্ব অনলাইনে সারা যাবে। ভার্চুয়াল থ্রি-ডি ক্লাসরুমেও শিক্ষকরা যে কোনও পরীক্ষা হাতে-কলমে শিখাতে পারবেন। এমনকি, বিনোদনের জগতেও সিনেমার সম্পূর্ণ নতুন ব্যাকরণ তৈরি করা সম্ভব হবে।
কিন্তু এত ভালর মধ্যেও মনে পড়ে যায় স্পাইডাম্যান ছবির মিস্টিরিয়োর সংলাপ, ‘‘পিপ্ল নাউআডেজ উইল বিলিভ এনিথিং দে সি।’’ মানুষ ঠকানোর জায়গাটা কি আরও পোক্ত হয়ে যাবে এই মেটাভার্সের সুবাদে?
ধরুন বিমানের টিকিট কাটলেন প্যারিস যাবেন বলে। আপনাকে একটি অন্ধকার ঘরে ঢুকিয়ে এমন ভাবে ভেল্কি দেখানো হল, যে আপনি ভাবলেন বিমানে বসে প্যারিসের দিকে উড়ে যাচ্ছেন। যতক্ষণে সত্যিটা ধরতে পারলেন, ততক্ষণ হয়তো আপনার সব টাকা নিয়ে পালিয়েছে প্রতারক আর আপনি ন’ণ্টা ধরে বসে আছেন একটা অন্ধকার ঘরে!
ফেসবুক নিয়ে দুশ্চিন্তা সবচেয়ে বেশি। যত সংখ্যক মানুষ মাইক্রোসফ্ট ব্যবহার করেন বা ভিডিয়ো গেম খেলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করেন। সাধারণ মানুষ থেকে দুনিয়ার শীর্ষনেতা-মহলের উপর ফেসবুকের যে পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল ২০২০ সালের নেটফ্লিক্স তথ্যচিত্র ‘দ্য সোশ্যাল ডিলেমা’।
বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের পতনের পিছনেও যে ফেসবুকের অনেকটা অবদান রয়েছে, তা-ও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে এত দিনে। সংস্থার সিইও মার্ক জাকারবার্গ গত দু’বছর ধরে বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে কোনও অভিযোগেরই যথাযথ উত্তর দিতে পারেননি। আদালতে শুধু আমতা আমতা করে ক্ষমা চেয়ে বলে গিয়েছেন, এমনটা হবে, তা তিনি বুঝতে পারেননি। বিশ্বের বৃহত্তম জনসংযোগের মাধ্যম যাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত, তিনি সেই সংস্থার গতিবিধির কোনও হদিশই রাখেন না, তা বিশ্বাস করা একটু কঠিন। তাই তিনি বহুপরিচিত নাম বদলে যখন রাতারাতি সংস্থার নাম ফেসবুক থেকে ‘মেটা’ করে ফেললেন, তখনই অনেকে টের পেয়েছিলেন, মেটাভার্সের উপর ঠিক কতটা বাজি রাখছেন তিনি।
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ধনকুবেররা এখন দু’জায়গায় বিনিয়োগে মন দিয়েছেন। প্রথম, মহাকাশযান, দ্বিতীয় মেটাভার্স। প্রথম দলে রয়েছেন ‘টেসলা’র ইলন মাস্ক থেকে ‘অ্যামাজন’-এর জেফ বেজোস। তাঁরা বুঝেছেন পৃথিবীর বাইরেই এখন ভবিষ্যৎ। দ্বিতীয় দলে নাম লিখিয়েছেন মার্ক জাকারবার্গের মতো ব্যক্তিত্বেরা। মহাকাশ ছেড়ে যখন এই পৃথিবীর মধ্যেই আর এক পৃথিবী তৈরি করতে তাঁরা মেতে উঠেছেন, তখনই আন্দাজ করা যায় ভবিষ্যতে কতটা ক্ষমতাবান হয়ে উঠবে এই নতুন দুনিয়া। মুশকিল হচ্ছে, গোটা দুনিয়াটাই যে ঝুটো! এক এক জন দেখবেন তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে।
ঠিক এই বৈশিষ্ট্যটাই ব্যবহার করে ফেসবুক ইতিমধ্যে বিশ্ব-রাজনীতি তোলপাড় করে ফেলেছে। যে যা দেখতে চান, শুধু তাই ভেসে ওঠে তাঁর নিউজ ফিডে। যা ভেসে উঠছে, তার সত্যতা যাচাই করার কথা কারও মাথায় আসে না। সেই কারণে ভুয়ো খবরের বাড়বাড়ন্তে তৈরি হচ্ছে একাধিক ‘সত্যি’। আপনার ‘সত্যি’ আর আমার ‘সত্যি’ আলাদা হয়ে গিয়েছে। ‘পোস্ট ট্রুথ’-এর যুগে ‘অবজেক্টিভ ট্রুথ’-এর আর কোনও কদর নেই।
ঠিক এই সময়েই তৈরি হচ্ছে নতুন এক মিথ্যে দুনিয়া। কিন্তু এক বার সেখানে হারিয়ে গেলে মানুষ কি রূপকথা এবং বাস্তবের ফারাকটা আর করতে পারবে?
সৌজন্যে: দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।