ডেস্কটপে জমে থাকা পেমেন্ট রিসিপ্টগুলো, ওয়ালেটে জমা হওয়া বিদেশী মুদ্রা, আর মনে জমে থাকা একটাই প্রশ্ন – “এই আয়টার জন্য কর দিতে হবে তো? কিভাবে দেব?” হ্যাঁ, বাংলাদেশের প্রতিটি ফ্রিল্যান্সার, আপনিই হোন আপওয়ার্কের টপ রেটেড ডেভেলপার কিংবা ফাইভারে নতুন জয়েন করা গ্রাফিক্স ডিজাইনার, এই প্রশ্ন আপনাকে স্পর্শ করেছে নিশ্চয়। বিদেশ থেকে আয় করা মানেই গর্বের, কিন্তু সেই আয়ের পাশাপাশি কর দায়িত্ব পালন – এই দুটোর সমন্বয় করতে গিয়েই তৈরি হয় ভয়, দ্বিধা, আর জটিলতার জাল। ভাবছেন, ট্যাক্স ফাইলিং মানেই কি জটিল কাগজপত্র, অফিসে দৌড়াদৌড়ি আর হিসাবের গোলমাল? মোটেই না! এই গাইড আপনাকে নিয়ে যাবে ফ্রিল্যান্সিং ট্যাক্স ফাইলিং এর সেই জটিল পথকে সরল, স্পষ্ট, এবং করমুক্তির আত্মবিশ্বাসে ভরপুর এক যাত্রায়। জানুন, কোন আয়ে কর দিতে হবে, কিভাবে দিতে হবে, কতটা দিতে হবে, আর কিভাবেই বা খরচ বিয়োজনের কৌশলে লাখ টাকা বাঁচাবেন – সবকিছুই সহজ বাংলায়, আপনার জন্য।
ফ্রিল্যান্সিং ট্যাক্স ফাইলিং: কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
- আইনের দৃষ্টিকোণ: বাংলাদেশের আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ অনুযায়ী, বাংলাদেশে বসবাসকারী (আবাসিক) যে কোন ব্যক্তির বিশ্বব্যাপী আয় বাংলাদেশে করযোগ্য। বিদেশ থেকে প্রাপ্ত ফ্রিল্যান্সিং আয়ও এর ব্যতিক্রম নয়। ন্যাশনাল বোর্ড অফ রেভিনিউ (NBR) এর সর্বশেষ নির্দেশনাও (যেমন আয়কর বিধিমালা, ২০২৩ সংশোধনী) এটিই স্পষ্ট করে। এটা শুধু আইনি বাধ্যবাধকতা নয়, দেশের উন্নয়নে আপনার মূল্যবান অবদান।
- আপনার সুবিধার জন্য: নিয়মিত ট্যাক্স রিটার্ন ফাইল করলে আপনি পান:
- আর্থিক সুবিধা: ব্যাংক লোন, ক্রেডিট কার্ড, বাড়ি/গাড়ির লোন পাওয়ার ক্ষেত্রে ITR সার্টিফিকেট অপরিহার্য প্রমাণপত্র।
- ক্যারিয়ার গ্রোথ: অনেক বড় কোম্পানি বা আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্ট তাদের ফ্রিল্যান্সারদের কাছেও ট্যাক্স কমপ্লায়েন্সের প্রমাণ চায়।
- শান্তি: কর ফাঁকি দেওয়ার চিন্তা বা ভবিষ্যত জরিমানা/জেলের ভয় থেকে মুক্তি। নিদ্রাহীন রাতের অবসান।
- দেশপ্রেম ও দায়িত্ব: আপনার করের টাকাতেই গড়ে উঠছে স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, সড়ক। এটা দেশের প্রতি আপনার দায়িত্ব ও ভালোবাসার প্রকাশ।
সতর্কীকরণ: এই নিবন্ধে প্রদত্ত তথ্য সাধারণ নির্দেশনা হিসেবে দেওয়া হয়েছে। কর আইন জটিল এবং পরিবর্তনশীল। আপনার নির্দিষ্ট আর্থিক অবস্থার জন্য সর্বদা একজন রেজিস্টার্ড চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট (CA) বা কর আইনজীবী এর কাছ থেকে সরাসরি পরামর্শ নিন। NBR এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইট (https://incometax.gov.bd/) সর্বশেষ ফরম, বিধি ও নোটিফিকেশনের জন্য সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ।
কে ফ্রিল্যান্সার? আপনার আয় কি করযোগ্য?
ফ্রিল্যান্সার হিসেবে আপনার সংজ্ঞা: আপনি যদি বাংলাদেশে বসবাস করেন (বছরে ১৮২ দিনের বেশি) এবং স্বাধীনভাবে (কোন নিয়োগকর্তার অধীনে নয়) আপনার দক্ষতা (ওয়েব ডিজাইন, ডেভেলপমেন্ট, ডিজাইন, রাইটিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, ভার্চুয়াল অ্যাসিসট্যান্স ইত্যাদি) ব্যবহার করে বিদেশী ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে আয় করেন (পেপ্যাল, পেয়োনিয়ার, ওয়্যারট্রান্সফার, ব্যাংক ট্রান্সফার, ক্রিপ্টোকারেন্সি – যেকোন মাধ্যমেই হোক), তাহলে আপনি একজন ফ্রিল্যান্সার এবং সাধারণত আপনার এই আয় বাংলাদেশে করযোগ্য।
কোন আয় করমুক্ত? (সাধারণত):
- ট্যাক্স থ্রেশহোল্ড: ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী (চূড়ান্ত আইন প্রকাশের অপেক্ষায়), প্রথম ৪,০০,০০০ (চার লক্ষ) টাকা বার্ষিক আয় করমুক্ত। অর্থাৎ, আপনার মোট বার্ষিক ফ্রিল্যান্সিং আয় ৪ লক্ষ টাকার কম হলে, সাধারণত আপনার আয়কর দায়িত্ব নেই (অন্যান্য আয় বিবেচনা করে ব্যক্তিগত অবস্থা ভিন্ন হতে পারে)। তবে রিটার্ন ফাইল করার বাধ্যবাধকতা থাকতে পারে (নিচে দেখুন)।
- অন্যান্য করমুক্ত সীমা: নারী, প্রতিবন্ধী, মুক্তিযোদ্ধা, গেজেটেড অফিসারদের জন্য আলাদা করমুক্ত সীমা প্রযোজ্য হতে পারে (NBR ওয়েবসাইটে বিস্তারিত)।
বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান (H3): NBR এর দৃষ্টিতে ফ্রিল্যান্সিং আয়
NBR “ফ্রিল্যান্সিং আয়” কে সাধারণত “পেশাদার বা কারিগরি সেবা থেকে আয়” বা “অন্যান্য উৎস থেকে আয়” এর অধীনে শ্রেণীবদ্ধ করে। এটি “বেতন” আয়ের আওতায় পড়ে না, কারণ আপনি কোন নিয়োগকর্তার অধীনে চাকুরী করছেন না। এই পার্থক্যটি ট্যাক্স রেট এবং খরচ বিয়োজনের পদ্ধতিতে গুরুত্বপূর্ণ।
ফ্রিল্যান্সিং আয়ের জন্য ট্যাক্স রেট ও স্ল্যাব: কত টাকা দিতে হবে?
বাংলাদেশে ব্যক্তিগত আয়করের জন্য প্রগতিশীল হার (Progressive Slab System) প্রযোজ্য। অর্থাৎ, আয় যত বাড়ে, করের হারও তত বাড়ে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রযোজ্য হার (২০২৪-২৫ এর প্রস্তাবিত বাজেট অনুরূপ, চূড়ান্ত হলে আপডেট করুন):
বার্ষিক করযোগ্য আয়ের সীমা (টাকায়) | করের হার (%) |
---|---|
প্রথম ৩,৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত | ০% |
পরবর্তী ১,০০,০০০ টাকা (৩,৫০,০০১ – ৪,৫০,০০০) | ৫% |
পরবর্তী ৩,০০,০০০ টাকা (৪,৫০,০০১ – ৭,৫০,০০০) | ১০% |
পরবর্তী ৪,০০,০০০ টাকা (৭,৫০,০০১ – ১১,৫০,০০০) | ১৫% |
পরবর্তী ৫,০০,০০০ টাকা (১১,৫০,০০১ – ১৬,৫০,০০০) | ২০% |
অবশিষ্ট ১৬,৫০,০০১ টাকার উপরে | ২৫% |
গুরুত্বপূর্ণ নোট:
- করযোগ্য আয়: এই স্ল্যাব করযোগ্য আয়ে প্রযোজ্য, মোট আয়ে নয়। করযোগ্য আয় = মোট বার্ষিক আয় – অনুমোদিত খরচ বিয়োজন (Expenses) – করমুক্ত সীমা (যদি প্রযোজ্য হয়)।
- ফ্রিল্যান্সারদের জন্য খরচ বিয়োজন: ফ্রিল্যান্সারদের জন্য একটি বড় সুবিধা হলো, তারা তাদের আয়ের একটি নির্দিষ্ট শতাংশ (সাধারণত ৫০%) সরাসরি ‘পেশাদার খরচ’ হিসেবে বিয়োজন (Deduct) করতে পারেন, কোন রশিদ বা প্রমাণপত্র ছাড়াই। এটি একটি উল্লেখযোগ্য সুবিধা। (বিস্তারিত নিচে)।
- ২০২৪-২৫ প্রস্তাবনা: ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে করমুক্ত সীমা ৩,৫০,০০০ থেকে বাড়িয়ে ৪,০০,০০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্যান্য স্ল্যাবও সামান্য সমন্বয় করা হতে পারে। চূড়ান্ত আইন পাস হলে তা NBR ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে।
হিসাবের উদাহরণ (সরলীকৃত):
ধরা যাক, জনাব রহিমের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ফ্রিল্যান্সিং আয় ১০,০০,০০০ (দশ লক্ষ) টাকা।
- ধাপ ১: পেশাদার খরচ বিয়োজন (৫০%) = ১০,০০,০০০ x ৫০% = ৫,০০,০০০ টাকা।
- ধাপ ২: করযোগ্য আয় = মোট আয় – খরচ বিয়োজন = ১০,০০,০০০ – ৫,০০,০০০ = ৫,০০,০০০ টাকা।
- ধাপ ৩: কর গণনা (স্ল্যাব অনুযায়ী):
- প্রথম ৩,৫০,০০০ টাকায় কর = ০ টাকা
- পরবর্তী ১,০০,০০০ টাকা (৩,৫০,০০১ – ৪,৫০,০০০) @৫% = ৫,০০০ টাকা
- পরবর্তী ৫০,০০০ টাকা (৪,৫০,০০১ – ৫,০০,০০০) @১০% = ৫,০০০ টাকা
- মোট প্রদেয় কর = ০ + ৫,০০০ + ৫,০০০ = ১০,০০০ টাকা।
খেয়াল করুন: খরচ বিয়োজন ছাড়া তার করযোগ্য আয় হতো ১০,০০,০০০ টাকা, এবং কর দিতে হতো প্রায় ৭৭,৫০০ টাকা (প্রথম ৩.৫ লাখ ০%, পরের ১ লাখ ৫% = ৫,০০০, পরের ৩ লাখ ১০% = ৩০,০০০, পরের ২.৫ লাখ ১৫% = ৩৭,৫০০; মোট ৫,০০০+৩০,০০০+৩৭,৫০০=৭২,৫০০ টাকা?)। ৫০% খরচ বিয়োজনের সুবিধা তাকে ৬২,৫০০ টাকা কর সাশ্রয় করিয়েছে! এটাই ফ্রিল্যান্সারদের জন্য সবচেয়ে বড় ট্যাক্স সুবিধা।
ফ্রিল্যান্সারদের জন্য বিশেষ ট্যাক্স সুবিধা: খরচ বিয়োজনের শক্তি
আয়কর অধ্যাদেশের ধারা ৩০(ক) (বা সংশ্লিষ্ট সর্বশেষ বিধি) ফ্রিল্যান্সার বা পেশাদার সেবা প্রদানকারীদের জন্য একটি অতুলনীয় সুবিধা দেয়। আপনি আপনার মোট পেশাগত আয়ের সর্বোচ্চ ৫০% কে “পেশাদার খরচ” (Professional Expenses) হিসেবে দাবি করতে পারেন, এমনকি আপনার প্রকৃত খরচ এর চেয়ে কম হলেও বা তার কোন প্রমাণপত্র (ভাউচার) না থাকলেও!
এটা কিভাবে কাজ করে?
- ধরা যাক, আপনার মোট আয়
X
টাকা। - আপনি
X
এর ৫০% =0.5X
টাকা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই আপনার খরচ বলে দাবি করতে পারেন। - তাহলে আপনার করযোগ্য আয় হবে
X - 0.5X = 0.5X
টাকা। - উপরন্তু, যদি আপনার প্রকৃত পেশাগত খরচ এই ৫০% (
0.5X
) এর চেয়ে বেশি হয়, তাহলে আপনি প্রমাণপত্র সহ সেই অতিরিক্ত খরচও বিয়োজন করতে পারবেন! (তবে এটি তুলনামূলক জটিল, CA এর পরামর্শ নেওয়া ভাল)।
কোন খরচগুলোকে পেশাগত খরচ হিসেবে বিবেচনা করা যায় (যদি প্রমাণ থাকে):
- ইন্টারনেট বিল: ফ্রিল্যান্সিং এর জন্য অপরিহার্য। (মাসিক বিলের কপি)
- বিদ্যুৎ বিল: হোম অফিসে ব্যবহৃত অংশের হিসাব। (অনুমানভিত্তিক বা মিটার রিডিং)
- বাড়ি ভাড়ার একটি অংশ: যদি নির্দিষ্ট রুম/স্পেস অফিস হিসেবে ব্যবহার করেন। (ভাড়া চুক্তির কপি, স্পেসের পরিমাপ)
- কম্পিউটার/ল্যাপটপ/প্রিন্টার/সফটওয়্যার: ক্রয় মূল্য (সাধারণত ক্যাপিটাল অ্যাসেট, ডিপ্রিসিয়েশন হিসাবে দাবি করা যায় – CA এর সাহায্য নিন)। রিপেয়ার খরচ। সাবস্ক্রিপশন ফি (Adobe, Microsoft 365, Canva Pro ইত্যাদি)।
- অফিস স্টেশনারি, ফার্নিচার: (ক্রয় রশিদ)
- কোর্স ফি/স্কিল ডেভেলপমেন্ট: ফ্রিল্যান্সিং রিলেটেড কোর্সের ফি। (এনরোলমেন্ট/পেমেন্ট প্রুফ)
- ব্রডব্যান্ড/মোবাইল বিল (পেশাগত অংশ): ক্লায়েন্টদের সাথে যোগাযোগের জন্য। (বিলের কপি)
- ব্যাংক চার্জ/পেমেন্ট গেটওয়ে ফি: বিদেশ থেকে টাকা আনতে খরচ। (ব্যানক স্টেটমেন্ট/ট্রানজেকশন স্লিপ)
- বাজারিং/প্রোমোশন খরচ: (প্রমাণ থাকলে)।
কৌশল: ৫০% স্বয়ংক্রিয় বিয়োজনই আপনার প্রধান হাতিয়ার। প্রকৃত খরচ এর চেয়ে বেশি হলে এবং প্রমাণ রাখতে পারলে তবেই অতিরিক্ত দাবির চেষ্টা করুন। বেশিরভাগ ফ্রিল্যান্সারের জন্য ৫০% বিয়োজনই যথেষ্ট এবং সহজ।
ফ্রিল্যান্সিং ট্যাক্স ফাইলিং এর ধাপে ধাপে গাইড: প্রস্তুতি থেকে জমা দেওয়া
ধাপ ১: তথ্য সংগ্রহ ও প্রস্তুতি (জুলাই-সেপ্টেম্বর)
- বার্ষিক আয়ের হিসাব: আপনার সমস্ত ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্ম (Upwork, Fiverr, Freelancer.com), ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ জোগাড় করুন। পেপ্যাল, পেয়োনিয়ার, ওয়্যারট্রান্সফার, Skrill, নগদ, ক্রিপ্টো – সব মাধ্যমের লেনদেন।
- ব্যাংক স্টেটমেন্ট: যে ব্যাংক একাউন্টে বিদেশী টাকা পেয়েছেন, তার পুরো অর্থবছরের (১ জুলাই – ৩০ জুন) স্টেটমেন্ট। ব্যাংক থেকে সার্টিফাইড কপি নিন বা অনলাইন থেকে ডাউনলোড করুন। মুদ্রা রূপান্তর নোট করুন।
- খরচের প্রমাণপত্র: ইন্টারনেট, বিদ্যুৎ, সফটওয়্যার সাবস্ক্রিপশন, নিউ হার্ডওয়্যার ক্রয়, কোর্স ফি ইত্যাদির রশিদ/প্রমাণপত্র সংরক্ষণ করুন। (৫০% বিয়োজনের জন্য আবশ্যিক না হলেও ভালো)।
- ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (TIN): আপনার TIN আছে তো? না থাকলে অবশ্যই তৈরি করুন। NBR ওয়েবসাইটে (https://tin.erb.gov.bd/) অনলাইনেই আবেদন করা যায়। এটা করদাতা শনাক্তকরণের জন্য বাধ্যতামূলক।
- e-TIN সক্রিয়করণ: TIN আছে কিন্তু e-TIN (অনলাইন একসেস) সক্রিয় না থাকলে সক্রিয় করুন। NBR ওয়েবসাইটে গিয়ে “e-TIN Registration” অপশন খুঁজুন।
ধাপ ২: সঠিক ITR ফরম চয়েস (সাধারণত ITR-10)
ফ্রিল্যান্সিং আয় “বেতন আয়” নয়, এটি “পেশাদার আয়” বা “অন্যান্য উৎস থেকে আয়”। তাই অধিকাংশ ফ্রিল্যান্সারদের জন্য প্রযোজ্য ফরম হলো ITR-10 (আয়কর রিটার্ন ফরম ১০) – অকৃষি ও বেতনভিত্তিক নয় এমন আয়ের জন্য রিটার্ন। যদি আপনার অন্য কোন উৎস থেকে আয় (যেমন: বাড়িভাড়া, কৃষি আয়) থাকে, সেক্ষেত্রে ভিন্ন ফরম (ITR-1, ITR-2 ইত্যাদি) প্রযোজ্য হতে পারে। সন্দেহ হলে NBR ওয়েবসাইটের “ফরম” সেকশন চেক করুন বা CA কে জিজ্ঞাসা করুন।
ধাপ ৩: ফরম পূরণ (অক্টোবর-নভেম্বর)
NBR এর অনলাইন পোর্টাল (https://incometax.gov.bd/) এ লগ ইন করে ITR-10 ফরম পূরণ করুন। প্রধান অংশগুলো:
- ব্যক্তিগত তথ্য: নাম, TIN, পিতা/স্বামীর নাম, ঠিকানা, মোবাইল, ইমেইল ইত্যাদি।
- আয়ের বিবরণী (Income Statement):
- ফ্রিল্যান্সিং/পেশাগত আয়: মোট প্রাপ্ত আয়ের পরিমাণ (বছরের ১ জুলাই থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত)।
- খরচ বিয়োজন: “পেশাদার খরচ” হিসেবে মোট আয়ের ৫০% দাবি করার ঘর। যদি প্রকৃত খরচ বেশি থাকে এবং দাবি করতে চান, তার জন্য আলাদা ঘর/শিডিউল থাকতে পারে (ফরম দেখুন)। ৫০% দাবি করাই সহজ এবং নিরাপদ।
- করযোগ্য আয়: স্বয়ংক্রিয়ভাবে (মোট আয় – খরচ বিয়োজন) হিসেব হবে।
- কর গণনা (Tax Computation): সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে করযোগ্য আয়কে স্ল্যাবের সাথে মিলিয়ে আপনার প্রাপ্ত করের পরিমাণ (Tax Liability) দেখাবে।
- ট্যাক্স ক্রেডিট (যদি থাকে): উৎসে কর (TDS) কাটা গিয়ে থাকলে (বিরল ফ্রিল্যান্সিং এ, তবে বাংলাদেশী ক্লায়েন্ট থাকলে হতে পারে), বা আগাম কর (Advance Tax) জমা দিলে তার পরিমাণ উল্লেখ করুন। এটি আপনার প্রাপ্ত কর থেকে বাদ যাবে।
- নিট প্রদেয় কর: প্রাপ্ত কর – ট্যাক্স ক্রেডিট = নিট কত টাকা দিতে হবে বা রিফান্ড পাবেন।
- ঘোষণা ও স্বাক্ষর: সমস্ত তথ্য সঠিক আছে বলে ডিজিটালি ঘোষণা দিতে হবে (ইলেক্ট্রনিক স্বাক্ষর)।
ধাপ ৪: অনলাইন ভেরিফিকেশন ও জমা (সাবমিশন)
ফরম পূরণ শেষে সাবমিট বাটনে ক্লিক করুন। সিস্টেম একটি সারাংশ দেখাবে। যাচাই করুন। এরপর ডিজিটালি সাইন ইন করে (ই-টিন পাসওয়ার্ড দিয়ে) ফাইনাল সাবমিট করুন। জমা দেওয়ার তারিখ নোট করুন এবং রিটার্নের কপি (Acknowledgement Slip) ডাউনলোড ও প্রিন্ট করে সংরক্ষণ করুন।
ধাপ ৫: কর জমা দেওয়া (যদি দেনা থাকে)
- যদি নিট প্রদেয় কর থাকে, তা অনলাইনেই (NBR পোর্টালের “পেমেন্ট” সেকশন থেকে) ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড, মোবাইল ব্যাংকিং (বিকাশ, নগদ, রকেট), বা নেট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে জমা দিন।
- চূড়ান্ত ডেডলাইন: সাধারণত ৩০ নভেম্বর (অর্থবছর শেষ হওয়ার পরের বছরের)। তবে NBR মাঝে মাঝে এক্সটেন্ডও দিতে পারে (সর্বশেষ নিউজ চেক করুন)।
- রিসিট: কর জমার রিসিট ডাউনলোড ও প্রিন্ট করে সংরক্ষণ করুন।
অতি গুরুত্বপূর্ণ: মুদ্রা রূপান্তর ও ব্যাংক চালান
- বাংলাদেশী টাকায় রূপান্তর: বিদেশী মুদ্রায় প্রাপ্ত সব আয় আয় প্রাপ্তির তারিখে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ঘোষিত বিক্রয় (SELL) রেটে বাংলাদেশী টাকায় রূপান্তর করতে হবে। আপনার ব্যাংক স্টেটমেন্টে এই রূপান্তর দেখানো হয়। আপনার হিসাবের জন্য এই রেট ব্যবহার করুন।
- ব্যাংক চালানের গুরুত্ব: ফ্রিল্যান্সিং আয় আনতে হলে অবশ্যই বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেল (আরবিআই অনুমোদিত) ব্যবহার করতে হবে। পেমেন্ট রিসিপ্টের চেয়েও ব্যাংক স্টেটমেন্টই হচ্ছে আপনার আয়ের প্রাথমিক প্রমাণ। ব্যাংক থেকে বিদেশী মুদ্রা রূপান্তর ও জমার সার্টিফাইড স্টেটমেন্ট সংগ্রহ করুন। NBR কর্তৃপক্ষের জন্য এটি সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য দলিল। “হুণ্ডি” বা অনানুষ্ঠানিক চ্যানেল এড়িয়ে চলুন, এটি অবৈধ এবং ঝুঁকিপূর্ণ।
জেনে রাখুন (FAQs)
H2: জেনে রাখুন
Q1: বার্ষিক আয় ৪ লক্ষ টাকার নিচে হলে কি ট্যাক্স রিটার্ন ফাইল করতে হবে?
A: হ্যাঁ, ফাইল করতে হতে পারে। করমুক্ত সীমার নিচে আয় হলেও, যদি আপনার ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (TIN) থাকে বা আপনার করযোগ্য আয়ের উৎস (যেমন: ফ্ল্যাট ভাড়া) থাকে, অথবা আপনি যদি করমুক্ত সীমার চেয়ে বেশি মূল্যের গাড়ি/ফ্ল্যাটের মালিক হন, তাহলে রিটার্ন ফাইল করার বাধ্যবাধকতা আছে (আয়কর অধ্যাদেশের ধারা ৭৫ দেখুন)। TIN আছে কিন্তু আয় করমুক্ত সীমার নিচে – এমন ক্ষেত্রেও NBR কে শূন্য (NIL) রিটার্ন ফাইল করার পরামর্শ দেওয়া হয়। সুনির্দিষ্ট জানতে NBR গাইডলাইন বা CA কে জিজ্ঞাসা করুন।
Q2: পেপ্যাল বা পেয়োনিয়ার থেকে টাকা আনলে কি আলাদা কর দিতে হয়?
A: পেপ্যাল, পেয়োনিয়ার, ওয়্যারট্রান্সফার ইত্যাদি শুধু টাকা প্রাপ্তির মাধ্যম। এগুলো থেকে টাকা আনার জন্য আলাদা কোন “উৎস কর” (TDS) বাংলাদেশে প্রযোজ্য হয় না। আপনার মোট আয় (এই মাধ্যমগুলো দিয়ে প্রাপ্ত টাকাসহ) বার্ষিক করযোগ্য আয় ৪ লক্ষ টাকার (প্রস্তাবিত) উপরে গেলেই সাধারণ আয়করের আওতায় কর দিতে হবে। তবে, ব্যাংক চ্যানেল ব্যবহারে ব্যাংক কিছু চার্জ কাটতে পারে, সেটা আয়ের অংশ নয়, ব্যাংকিং খরচ।
Q3: ফ্রিল্যান্সিং আয়ের খরচ বিয়োজনের ৫০% ছাড়াও কি অন্য খরচ দাবি করা যায়?
A: হ্যাঁ, যায়। আয়কর অধ্যাদেশের ধারা ২৯ বিভিন্ন ধরনের খরচ বিয়োজনের অনুমতি দেয়। যদি আপনার প্রকৃত পেশাগত খরচ (ইন্টারনেট, বিদ্যুৎ, অফিস ভাড়ার অংশ, সফটওয়্যার, ডিভাইসের অবচয়, ব্যাংক ফি ইত্যাদি) মোট আয়ের ৫০% এর চেয়ে বেশি হয়, এবং আপনি তার ভাউচার/প্রমাণপত্র রাখতে পারেন, তাহলে আপনি সেই অতিরিক্ত খরচও দাবি করতে পারেন। তবে, এটি হিসাব জটিল করে তুলতে পারে এবং কর পরিদর্শনের সম্ভাবনা বাড়াতে পারে। প্রকৃত খরচ স্পষ্টভাবে বেশি এবং প্রমাণ রাখতে পারলে তবেই এটি বিবেচনা করুন। সাধারণ ফ্রিল্যান্সারদের জন্য ৫০% বিয়োজনই সবচেয়ে সহজ ও নিরাপদ পথ। একজন CA এর সাহায্য নিন।
Q4: ফ্রিল্যান্সিং ট্যাক্স ফাইলিং এর জন্য কি একজন অ্যাকাউন্টেন্ট জরুরি?
A: সরল হিসাবের জন্য হয়ত নয়, তবে অত্যন্ত সুপারিশকৃত। আপনার আয় যদি তুলনামূলক কম এবং একমাত্র উৎস ফ্রিল্যান্সিং হয়, এবং আপনি ৫০% খরচ বিয়োজনের সুবিধাটি ব্যবহার করে অনলাইন ফরম নিজে পূরণ করতে আত্মবিশ্বাসী হন, তাহলে নিজেই করতে পারেন। তবে, যদি:
- আপনার আয় অনেক বেশি হয়,
- একাধিক আয়ের উৎস (ফ্রিল্যান্সিং + বাড়িভাড়া + অন্য ব্যবসা) থাকে,
- প্রকৃত খরচ বিয়োজনের দাবি করতে চান,
- হিসাব জটিল মনে হয়,
- বা আপনি নিশ্চিত হতে চান যে সবকিছু আইনসম্মতভাবে হচ্ছে,
তাহলে একজন রেজিস্টার্ড চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট (CA) এর পরামর্শ ও সাহায্য নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারাই সবচেয়ে ভালো জানেন কিভাবে আইনি সুবিধাগুলো পুরোপুরি কাজে লাগাতে হয় এবং ভুলত্রুটি এড়াতে হয়। ভবিষ্যতের ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্য এই বিনিয়োগ মূল্যবান।
Q5: ট্যাক্স ফাইলিং না করলে বা ভুল করলে কি শাস্তি আছে?
A: হ্যাঁ, কঠোর শাস্তি আছে। এতে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে:
- জরিমানা: বকেয়া করের উপর অতিরিক্ত জরিমানা (সাধারণত মাসিক বা বাৎসরিক হারে)।
- অতিরিক্ত কর: কর কমিশনার কর নির্ধারণ করতে পারেন, যা আপনার নিজের হিসাবের চেয়ে বেশি হতে পারে।
- সুদ: বকেয়া করের উপর সুদ প্রদান করতে হবে।
- আইনি মামলা: গুরুতর ক্ষেত্রে বা ইচ্ছাকৃত ফাঁকি দিলে ফৌজদারি মামলা ও কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে (বিরল, কিন্তু সম্ভব)।
- বৈধতা হারানো: TIN বাতিল, ব্যাংক লোন/কার্ড বন্ধ, বিদেশ ভ্রমণে সমস্যা হতে পারে। সঠিক সময়ে এবং সঠিকভাবে ট্যাক্স রিটার্ন ফাইল করা সবচেয়ে নিরাপদ ও বুদ্ধিমানের কাজ।
Q6: ফ্রিল্যান্সিং আয়ের জন্য কি আগাম কর (Advance Tax) দিতে হয়?
A: সাধারণত, যদি পূর্ববর্তী বছরের করদায় (Tax Liability) ১০,০০০ টাকার বেশি হয়, তাহলে চলতি বছরে কোয়ার্টারলি ভিত্তিতে আগাম কর দিতে হয়। (আয়কর বিধিমালা সংশোধনী অনুসারে)। আপনার যদি প্রথম বছর ফ্রিল্যান্সিং আয় শুরু হয় এবং পূর্ববর্তী বছরে করদায় না থাকে, তাহলে সাধারণত আগাম কর দিতে হবে না। তবে, আয় অনেক বেশি হলে এবং এ বছরে করদায় ১০,০০০ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে, আগাম কর দিলে বছর শেষে বড় অংকের কর দিতে না হয় এবং সুদ/জরিমানা এড়ানো যায়। CA এর সাথে আলোচনা করুন।
ফ্রিল্যান্সিং ট্যাক্স ফাইলিং শুনতে ভয়ের হলেও, এটি আসলে আপনার পেশাদারিত্ব ও আর্থিক দায়িত্ববোধের চূড়ান্ত প্রকাশ। এই গাইড আপনাকে দেখিয়েছে, কিভাবে NBR এর নিয়ম মেনে, ৫০% খরচ বিয়োজনের সুবিধা কাজে লাগিয়ে, সহজেই অনলাইনে আপনার কর দায়িত্ব পালন করতে পারেন। মনে রাখবেন, কর দেওয়া শুধু আইন নয়, দেশের উন্নয়নে আপনার অংশগ্রহণ। ট্যাক্স ফাইলিং এর এই যাত্রাকে ভয় নয়, আত্মবিশ্বাসে নিন। আপনার আয় যেমন গর্বের, আপনার করদানও তেমনই মাথা উঁচু করে বলার মতো একটি অর্জন। সঠিক সময়ে সঠিকভাবে ট্যাক্স ফাইল করুন, ঝুঁকিমুক্ত থাকুন, এবং আপনার মূল্যবান সময় ও শক্তি ক্যারিয়ার গড়ায় ও স্বপ্ন পূরণে ব্যয় করুন। আপনার সাফল্য কামনা করছি!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।