দীর্ঘ ছয় বছর সারা বিশ্ব তছনছ করে অবশেষে থামল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তারিখটা ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর। এর এক সপ্তাহ পর ব্রিটেনে মুক্তি পেল একটি সিনেমা। সাদা-কালো, হরর মুভি। কিছুটা কমেডি ধাঁচের। নাম ডেড অব নাইট। বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনে হরর মুভি বানানো নিষিদ্ধ ছিল। তাই অনেক দিন পর ব্রিটেনে এমন কোনো সিনেমা মুক্তি পেল। সে কারণেই কি না কে জানে, সে দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেল মুভিটি। যাকে বলে হাউসফুল।
১৯৪৬ সালের এক রাতে সিনেমাটি দেখতে ব্রিটেনের সারে এলাকায় গিল্ডফোর্ড সিনেমা হলে গেলেন তিন বন্ধু। ফ্রেড হয়েল, হারমান বন্ডি ও থমাস গোল্ড। তিনজনই বিজ্ঞানী। মহাবিশ্বের জন্মরহস্য নিয়ে তাঁরা খুব উৎসাহী। বিগ ব্যাং মডেল তিনজনের কেউ মানতে পারছেন না। তাই মহাবিশ্বের নতুন কোনো মডেলের খোঁজ করছিলেন তাঁরা।
ডেড অব নাইট মুভি পাঁচটি ভূতের গল্পের সমাহার। কিন্তু শেষ দৃশ্যে গোটা কাহিনিতে অদ্ভুত একটি মোড় নিতে দেখা গেল। সিনেমার শুরুতে মূল চরিত্রের ঘুম ভেঙে যায়। এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আবির্ভূত হতে থাকে নতুন নতুন চরিত্র। সেই সঙ্গে প্লটও বিকশিত হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সব শেষে দেখা গেল, সিনেমাটি যেখান থেকে শুরু হয়েছিল, শেষ হয়েছে ঠিক সেখানেই।
শেষ দৃশ্যেও মূল চরিত্রের ঘুম ভেঙে যায়, যেন এতক্ষণ সবই স্বপ্নের মধ্যে ঘটল। এরপর আগের সব ঘটনাই ঘটতে থাকে হুবহু। কাজেই সিনেমাটি এক অর্থে বৃত্তাকার একটি চক্রের মতো, যার কোনো শুরুও নেই, শেষও নেই; অর্থাৎ সিনেমাটি একইভাবে চিরকাল চলতেই থাকবে। কথিত আছে, সিনেমাটি শেষ হতেই গোল্ড বলে বসলেন, ‘মহাবিশ্বও যদি এ রকম হতো, তাহলে কী হবে?’
ডেড অব নাইট দেখার কয়েক মাস পর মহাবিশ্বের নতুন মডেল গড়ে তুলতে অনুপ্রাণিত হন গোল্ড। তাঁর মডেলে মহাবিশ্ব প্রসারণশীল, তবু বিগ ব্যাং মডেলের সঙ্গে সব দিক দিয়ে সাংঘর্ষিক। আগেই বলেছি, বিগ ব্যাং মডেলের সমর্থকেরা এমন এক মহাবিশ্বের অনুমান করতেন, যেটি অতীতে অতি ক্ষুদ্র, ঘন ও উত্তপ্ত ছিল।
আর মহাবিশ্বটা সৃষ্টি হয়েছিল কয়েক বিলিয়ন বছর আগে। বিপরীতে গোল্ড, বন্ডি ও হয়েলের প্রস্তাবিত মডেলে মহাবিশ্ব প্রায় অপরিবর্তিত অবস্থায় চিরকাল অস্তিত্বমান। ঠিক যেন ডেড অব নাইট মুভির মতো, যার শুরু বা শেষ বলে কিছু নেই। এই মডেলেও মহাবিশ্বের অংশগুলো আসলে প্রসারিত হয়। কিন্তু একেবারে শূন্য থেকে অনবরত তৈরি হয় নতুন পদার্থ। কাজেই মহাবিশ্বের ঘনত্ব সব সময় একই থাকে। অবশ্য পদার্থ কীভাবে শূন্য থেকে এমন রহস্যজনকভাবে তৈরি হচ্ছে, তার কোনো বিশদ ব্যাখ্যা দিতে পারেননি তাঁরা।
সেকালে যাঁরা মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন, তাঁদের কাছে শিগগিরই আকর্ষণীয় হয়ে উঠল তত্ত্বটি। একটি অগ্নিগর্ভ বিশৃঙ্খলা শূন্য থেকে হাজির হয়ে ছায়াপথগুলোকে সব দিকে ঠেলে পাঠিয়ে দিচ্ছে—এ ভাবনাই হয়েলের কাছে ভীষণ অযৌক্তিক বলে মনে হতো। তার চেয়ে শূন্য থেকে পদার্থের সৃষ্টি পছন্দ করলেন তিনি। অন্য কথায়, এ তত্ত্বমতে, মহাবিশ্ব কালহীন, চিরন্তন। এর কোনো শেষ নেই, শুরুও নেই।
মহাবিশ্ব এভাবেই চিরকাল রয়েছে। এর নাম দেওয়া হলো স্টেডি স্টেট মডেল বা স্থিতিশীল মহাবিশ্ব মডেল। অচিরেই বিগ ব্যাং মডেলের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে মডেলটি। স্থিতিশীল মহাবিশ্ব মডেলের প্রধান মুখপাত্র আর বিগ ব্যাং মডেলের প্রধান শত্রুতে পরিণত হন ফ্রেড হয়েল।
বন্ডি ও গোল্ডের বেড়ে ওঠা অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায়। এরপর কেমব্রিজে পড়ালেখা করেছেন তাঁরা। অ্যাডমিরাল্টি রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে কাজ করার সময় একই বাড়িতে থাকতেন দুজন। প্রতি সপ্তাহে বেশ কয়েক রাত এই দুই বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটাতেন হয়েল। রাডার নিয়ে গবেষণার ফাঁকে যেটুকু সময় পাওয়া যেত, সে সময় জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলতেন। বিশেষ করে হাবলের পর্যবেক্ষণে পাওয়া প্রসারণশীল মহাবিশ্ব এবং এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা চলত। এসব আলোচনায় আলাদা আলাদা ভূমিকা ছিল তিনজনের।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে তিনজন আলাদা ক্যারিয়ার বেছে নেন। হয়েল জ্যোতির্বিদ্যা, বন্ডি গণিত ও গোল্ড নিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং। তবে কেমব্রিজেই থাকতেন তিন বিজ্ঞানী। তাই পার্টটাইমে কসমোলজি নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে লাগলেন তাঁরা।
১৯৪০ সালের দিকেও আলোচিত মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব কোনোভাবে আকর্ষণ করতে পারেনি হয়েলকে। এর পেছনে মহাবিশ্বের বয়স নির্ণয়ের ত্রুটিই ছিল মুখ্য। এই প্রেক্ষাপটে সহকর্মী থমাস গোল্ড এবং হারমান বন্ডিকে সঙ্গে নিয়ে একটা নতুন বা প্রতিদ্বন্দ্বী তত্ত্ব গড়ে তোলার প্রস্তুতি নেন ফ্রেড হয়েল।
মহাবিশ্বের উৎপত্তি নিয়ে বিগ ব্যাং মডেল ছাড়াও আরেকটি তত্ত্ব আলোচিত ছিল। সেটা হলো চিরন্তন স্থিতিশীল মডেল। বন্ডির বাড়িতে নিয়মিত বসে এই প্রতিদ্বন্দ্বী দুই তত্ত্বের পক্ষ ও বিপক্ষের যুক্তিগুলোর আলোচনা চলত। স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের আলোচনায় স্থির মহাবিশ্বের প্রতিই পক্ষপাত থাকত। তবে হাবলের পর্যবেক্ষণের কারণে তাঁরা স্বীকার করতে বাধ্য হতেন যে মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে।
কিন্তু হাবল প্রমাণ করেছেন, মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে। এর সঙ্গে তাঁদের মহাবিশ্ব মডেলকে কীভাবে খাপ খাওয়ালেন হয়েল ও তাঁর সহকর্মীরা? মহাবিশ্বের বিকাশ প্রমাণিত। কারণ, দেখা যাচ্ছে, মহাবিশ্ব ক্রমে প্রসারিত হচ্ছে। যদি প্রসারণ ছাড়া আর কিছু না ঘটত, তাহলে মহাবিশ্ব সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেত এবং তার ঘনত্বও কমে যেত।
বিগ ব্যাং মডেল ঠিক এই প্রস্তাব করেছিল। তবে থমাস গোল্ড দ্বিতীয় আরেকটি সম্ভাবনার কথা বললেন। সেটা প্রসারণের কারণে ঘনত্ব কমে যাওয়া ঠেকিয়ে দিল এবং সামগ্রিক কোনো পরিবর্তনও ঘটায় না। তিনি বললেন, মহাবিশ্ব তার প্রসারণের ক্ষতিপূরণ করে নতুন পদার্থের জন্ম দিয়ে, অর্থাৎ পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়া ছায়াপথগুলোর মাঝখানে ক্রমে নতুন পদার্থ সৃষ্টি হচ্ছে।
এ রকম একটা অপরিবর্তিত কিন্তু বিকাশমান মহাবিশ্ব মডেলের নাম হলো স্টেডি স্টেট মডেল বা স্থিতিশীল মহাবিশ্ব মডেল। একদিন সন্ধ্যাবেলায় বন্ডির বাসায় বসে মডেলটি ব্যাখ্যা করলেন থমাস গোল্ড। আইডিয়াটির কথা শুনে একে পাগলাটে থিওরি বললেন হয়েল আর বন্ডি। হয়েল এমন মন্তব্য করলেন যে ডিনারের আগেই মডেলটি ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। কিন্তু রাতের খাবারের আগপর্যন্ত সেটা নিয়ে অনেক রকম হিসাব-নিকাশ করে গেলেন তাঁরা। একে একে বেশ কটি ত্রুটি সারিয়ে তুলতে পারলেন এই ত্রয়ী।
স্টেডি স্টেট মডেলের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, মহাবিশ্বের সব জায়গায় শিশু ছায়াপথ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। অন্যদিকে বিগ ব্যাং মডেলের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, শুধু বিপুল মহাজাগতিক দূরত্বেই শিশু ছায়াপথ দেখা সম্ভব। তবে ১৯৪০-এর শেষ দিকেও আমাদের টেলিস্কোপগুলো যথেষ্ট উন্নত ছিল না। তাই শিশু ছায়াপথ আর পরিণত ছায়াপথের মধ্যে পার্থক্য করা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কাজেই কোন মডেল যে সঠিক, তা অমীমাংসিত রয়ে যায়।
তবে জ্যোতির্বিদদের জন্য মডেল বাছাই করার সুযোগ ছিল। চাইলে যে কেউ পছন্দমতো বিগ ব্যাং অথবা স্টেডি স্টেট মডেল বেছে নিতে পারতেন। তাই দুই দলেই সমর্থক জ্যোতির্বিদ বাড়তে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই জ্যোতির্বিজ্ঞান সমাজও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। যেসব বিজ্ঞানী মহাবিশ্বের বিগ ব্যাং মডেল মেনে নিতে পারছিলেন না, তাঁদের কাছে হয়েল দলের স্টেডি স্টেট থিওরিটা আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দিল।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।