সূর্যাস্তের আলোয় ঢাকা শহরের দিগন্তজুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা অট্টালিকাগুলোর দিকে তাকালে স্বপ্ন জাগে নিজের ছাদের। ফ্ল্যাট কিনতে যাওয়া মানে শুধু চার দেয়াল কেনা নয়, সেখানে জড়িয়ে থাকে এক জীবনের সঞ্চয়, পরিবারের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার স্বপ্ন। কিন্তু ঢাকার বায়েজিদ বোস্তামী রোডে বসবাসকারী রিয়াজ উদ্দিনের গল্প ভিন্ন। তিনি স্বপ্নের ফ্ল্যাট কিনেছিলেন, কিস্তি পরিশোধ শেষে আবিষ্কার করলেন ফ্ল্যাটের দলিলে ভুল নাম, জমির প্রকৃত মালিকানা নিয়ে জটিলতা। এ যেন সারা জীবনের কষ্টার্জিত টাকায় কেনা বিষাদ! ফ্ল্যাট কেনার আগে জেনে নিন এই সহজ কথাটিই রিয়াজের মতো হাজারো ক্রেতার জন্য জটিল আইনি লড়াই আর আর্থিক ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে পারত।
এই নিবন্ধে শুধু তালিকা দেওয়া হবে না; বরং ঢাকার রিয়াজ, চট্টগ্রামের সুমাইয়া কিংবা খুলনার জাহিদের মতো বাস্তব অভিজ্ঞতা, বিশেষজ্ঞ পরামর্শ এবং আইনি কাঠামোর বিস্তারিত আলোচনা থাকবে। জেনে নেবেন কিভাবে আপনার স্বপ্নের বাসা যেন দুঃস্বপ্নে পরিণত না হয়।
ফ্ল্যাট কেনার আগে জেনে নিন: কেন এই গাইড আপনার জন্য অপরিহার্য
বাংলাদেশে রিয়েল এস্টেট সেক্টরে প্রতারণা ও আইনি জটিলতা ক্রমাগত উদ্বেগের কারণ। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (RAJUK) সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধুমাত্র ঢাকায় ২০২৩ সালে ফ্ল্যাট ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত ১,২০০+ অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে, যার ৭০%ই দলিলগত ত্রুটি ও মালিকানা জালিয়াতির সাথে সম্পর্কিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, আবাসিক ঋণের পরিমাণ গত পাঁচ বছরে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে, যা এই খাতে সাধারণ মানুষের বিনিয়োগ ও ঝুঁকি কতটা বাড়ছে তারই ইঙ্গিত দেয়।
ফ্ল্যাট কেনার আগে যে ১০টি মারাত্মক ভুল এড়াতে হবে: বিস্তারিত গাইডলাইন
১. দলিল ও মালিকানা যাচাই না করা: সবচেয়ে বড় ফাঁদ
“ভদ্রলোক এত বিশ্বাসযোগ্য ছিলেন, কাগজপত্র দেখার কথা ভাবিনি,” – এভাবেই নারায়ণগঞ্জের ক্রেতা শাহানা আক্তার বর্ণনা করেন তাঁর ২৫ লাখ টাকা হারানোর কষ্টের অভিজ্ঞতা। ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে দলিল যাচাইয়ের ভুলই সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক।
- কি করবেন:
- মূল দলিল (মুঠো দলিল) পরীক্ষা: জমির প্রকৃত মালিক কে? দলিল রেজিস্ট্রেশন নম্বর, তারিখ, রেজিস্ট্রার অফিস যাচাই করুন। অনলাইনে জমি জরিপ (ভূমি মন্ত্রণালয়ের e-mutation সার্ভিস) থেকে মৌজা ম্যাপে জমির অবস্থান ও মালিকানা মিলিয়ে নিন।
- মিউটেশন সার্টিফিকেট: বর্তমান মালিকের নামে মিউটেশন (খতিয়ান) হয়েছে কিনা নিশ্চিত হোন। এটি না থাকলে বিক্রেতার আইনি মালিকানা দুর্বল।
- অনুমোদনপত্র (RAJUK/সিটি কর্পোরেশন): বিল্ডিং নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অনুমতি আছে কিনা? রাজউকের ওয়েবসাইটে প্রজেক্টের অনুমোদন স্ট্যাটাস চেক করুন।
- অবৈধ দখল বা লিটিগেশন চেক: স্থানীয় তহসিলদার অফিস বা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে গিয়ে জমির বিরুদ্ধে কোন মামলা আছে কিনা খোঁজ নিন।
বিশেষজ্ঞ পরামর্শ: “দলিলের ‘শিরোনাম’ পরিষ্কার না হলে কখনই অগ্রিম টাকা দেবেন না। ফ্ল্যাটের সাথে জমির স্বত্ব (Land Rights) স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে,” – ব্যারিস্টার সারা হোসেন, রিয়েল এস্টেট আইন বিশেষজ্ঞ।
২. আর্থিক প্রস্তুতি ও গোপন খরচ উপেক্ষা করা
ফ্ল্যাটের দাম শুনে মনে হয়, “এত টাকা জমা আছে, বাকিটা লোন নিলেই হবে!” কিন্তু ঢাকার ডিবি হাউজিংয়ের ক্রেতা ইমরান হোসেনের হিসাব মেলেনি। দাম ছিল ৮০ লাখ, কিন্তু রেজিস্ট্রেশন, স্টাম্প ডিউটি, সোসাইটি প্রবেশ ফি, ইন্টেরিয়র ওয়ার্ক মিলিয়ে অতিরিক্ত ১২ লাখ টাকা গুনতে হয়েছে!
গোপন খরচের তালিকা: খরচের ধরন আনুমানিক পরিমাণ (টাকায়) মন্তব্য রেজিস্ট্রেশন ফি সম্পত্তির মূল্যের ২-৩% সরকার নির্ধারিত স্ট্যাম্প ডিউটি ১.৫% – ৪.৫% সম্পত্তির মান ও অবস্থানভেদে সোসাইটি/ক্লাব ফি ৫০,০০০ – ৩,০০,০০০ প্রজেক্টভেদে ব্যাপক তারতম্য ইউটিলিটি কানেকশন (বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি) ৫০,০০০ – ১,০০,০০০ নতুন কানেকশনের ক্ষেত্রে বার্ষিক মেইনটেন্যান্স চার্জ ২০,০০০ – ১,০০,০০০/বছর ফ্ল্যাটের আকার ও সুযোগসুবিধা অনুযায়ী - ঋণের বাস্তবতা:
- বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন অনুযায়ী, মাসিক কিস্তি আপনার আয়ের ৫০% এর বেশি হওয়া উচিত নয়।
- প্রি-ইএমআই (অনির্মিত ফ্ল্যাটে) সুদ আপনার মোট ঋণের বোঝা বাড়িয়ে দেয়।
- প্রক্রিয়াজাতকরণ ফি, ভ্যালুয়েশন ফি, বীমা প্রিমিয়াম – এগুলো ঋণের খরচে যোগ হয়।
৩. নির্মাণের মান ও বিল্ডিং সুরক্ষা যাচাইয়ে অবহেলা
২০২৩ সালের এপ্রিলে ঢাকার গুলশানে একটি বহুতল ভবনের আংশিক ধসের ঘটনা নির্মাণ মানের ভয়াবহ রূপ প্রকাশ করে। শুধু চকচকে টাইলস আর পেইন্টে ভুলবেন না।
- নির্মাণ মান যাচাইয়ের উপায়:
- কোম্পানির ট্র্যাক রেকর্ড: ডেভেলপার/বিল্ডারের আগের প্রজেক্টগুলো ঘুরে দেখুন। বাসিন্দাদের সাথে কথা বলুন নির্মাণের গুণগত মান ও সমস্যা নিয়ে।
- উপাদানের স্পেসিফিকেশন: চুক্তিতে সিমেনের ব্র্যান্ড (সিমেন্ট, প্রিমিয়ার, হোলসিম), ইস্পাতের গ্রেড (৫০০W), প্লাম্বিং-ইলেকট্রিক্যাল ফিটিংসের ব্র্যান্ড (সানভি, CIXI) স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে।
- স্ট্রাকচারাল ড্রয়িং ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের সার্টিফিকেট: ভবনটি ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (BNBC) মেনে তৈরি হয়েছে কিনা?
- ফায়ার সেফটি সিস্টেম: ফায়ার এক্সিট, হাইড্রেন্ট, ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম ফাংশনাল কিনা?
ইঞ্জিনিয়ার মাহবুবুর রহমানের অভিজ্ঞতা: “অনেক ক্রেতা বাথরুমের ফিনিশিং দেখেই খুশি। কিন্তু লুকানো ইলেকট্রিক্যাল ওয়্যারিং, সাব-স্ট্যান্ডার্ড প্লাম্বিং পাইপ পরে ভোগান্তির কারণ হয়। ফ্ল্যাট হ্যান্ডওভারের সময় বিশেষজ্ঞ দিয়ে পরীক্ষা করানো জরুরি।”
৪. লোকেশন ও সুযোগ-সুবিধার ভবিষ্যৎ মূল্যায়ন না করা
“সস্তা বলে মিরপুর ১৩ নম্বরে কিনেছিলাম, এখন অফিস যেতে ৩ ঘণ্টা লাগে!” – অভিযোগ করছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা ফারহানা ইয়াসমিন। লোকেশন শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যতের জীবনযাত্রাকেও প্রভাবিত করে।
- লোকেশন নির্বাচনের ফ্যাক্টরস:
- কর্মস্থলের দূরত্ব: দৈনিক যাতায়াতের সময় ও খরচ হিসাব করুন।
- শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা: কাছাকাছি মানসম্মত স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল বা ক্লিনিক আছে কি?
- পরিবহন নেটওয়ার্ক: মেট্রোরেল/বিআরটি রুটের কাছাকাছি? রিকশা/অটোর সহজলভ্যতা?
- ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা: এলাকায় নতুন সেতু, ফ্লাইওভার, শপিং কমপ্লেক্সের পরিকল্পনা আছে কিনা রাজউক/সিটি ডেভেলপমেন্ট অথরিটির ওয়েবসাইটে দেখুন।
- নিরাপত্তা ও পরিবেশ: এলাকার অপরাধের হার কেমন? জলাবদ্ধতার সমস্যা আছে কিনা?
৫. বিল্ডার/ডেভেলপারের খ্যাতি ও ট্র্যাক রেকর্ড না দেখা
বিজ্ঞাপনের চাকচিক্যে বিভ্রান্ত হবেন না। “প্রিমিয়ার হাউজিং”-এর নামে এক ডেভেলপার ঢাকার উত্তরায় কয়েকশ ক্রেতার অগ্রিম টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে ২০২২ সালে।
- ডেভেলাপার যাচাইয়ের স্টেপস:
- REHAB (রিয়েল এস্টেট হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ) সদস্যতা: REHAB-এর ওয়েবসাইটে ডেভেলপার সদস্য কিনা চেক করুন।
- অতীত প্রজেক্ট ভিজিট: তাদের কমপ্লিটেড প্রজেক্টে গিয়ে বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতা জানুন।
- অনলাইন রিভিউ ও অভিযোগ: সোশ্যাল মিডিয়া, ফোরামে (যেমন: “BD Property Forum”) কোম্পানির নাম সার্চ করুন।
- ব্যাংক রেফারেন্স: কোম্পানির আর্থিক সচ্ছলতা সম্পর্কে তাদের ব্যাংকের কাছ থেকে তথ্য নিন।
৬. চুক্তিপত্র না পড়ে বা আইনি পরামর্শ ছাড়াই সই করা
চুক্তিপত্র শুধু ফরমালিটি নয়, আপনার অধিকারের রক্ষাকবচ। চুক্তিতে অস্পষ্ট বা ক্ষতিকর ক্লজ থাকতে পারে।
- চুক্তিতে যে বিষয়গুলো অবশ্যই দেখবেন:
- সম্পত্তির পূর্ণ বিবরণ (ঠিকানা, আকার, ফ্ল্যাট নম্বর, পার্কিং/লকার ডিটেলস)।
- দাম ও পেমেন্ট শিডিউল (অগ্রিম, কিস্তি, ফাইনাল পেমেন্ট) স্পষ্ট উল্লেখ।
- হ্যান্ডওভারের নির্দিষ্ট তারিখ ও বিলম্বের জন্য ডেভেলপারের জরিমানার বিধান।
- নির্মাণ সামগ্রীর ব্র্যান্ড ও স্পেসিফিকেশন।
- ওয়ারেন্টি/ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড (সাধারণত ১ বছর)।
- মালিকানা হস্তান্তরের দায়িত্ব (খতিয়ান/মিউটেশন) কার উপর?
- বিরোধ নিষ্পত্তির পদ্ধতি (আর্টিট্রেশন কোর্ট?)।
অত্যাবশ্যকীয়: একজন রিয়েল এস্টেট আইনজীবী দিয়ে চুক্তিপত্র রিভিউ করান। খরচ মনে হলেও, এটিই ভবিষ্যতের কোটি টাকার ঝামেলা ও মামলা থেকে বাঁচাবে।
৭. প্রকৃত মাপ ও ইউটিলিটি কানেকশন যাচাই না করা
বিজ্ঞাপনে “১২০০ ফুট” বলা হলেও প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য জায়গা ১০০০ ফুট হতে পারে! আর বিদ্যুৎ-গ্যাস না থাকলে ফ্ল্যাট অচল।
- যা করবেন:
- সেলফ-মেজারমেন্ট: টেপ মেজার নিয়ে নিজেই ফ্ল্যাটের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ মেপে নিন। করিডোর, বারান্দা, বালকনির মাপ আলাদা কিনা খেয়াল করুন।
- কার্পেট এরিয়া বনাম সুপার বিল্ট-আপ এরিয়া: কোন পদ্ধতিতে মাপ দেওয়া হয়েছে? (সাধারণত সুপার বিল্ট-আপ এলাকায় কমন স্পেস যোগ করা হয়)।
- ইউটিলিটি কানেকশন: সরাসরি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (ডেসা/ডিপিডিসি/রেসকো) ও গ্যাস কোম্পানির অফিসে যোগাযোগ করে ফ্ল্যাটে চূড়ান্ত কানেকশন দেওয়া হয়েছে কিনা নিশ্চিত হোন। প্রি-পেইড মিটার ফিট আছে কিনা দেখুন।
৮. হ্যান্ডওভার ও দখল নেওয়ার সময় ত্রুটি চিহ্নিত না করা
হ্যান্ডওভার হল শেষ বাধা। এই সময় ত্রুটি ধরা পড়লে মেরামতের দায় ডেভেলপারের। পরে সমস্যা হলে সব খরচ আপনার।
- হ্যান্ডওভার চেকলিস্ট (সংক্ষিপ্ত):
- দেয়াল ও ছাদ: ক্র্যাক, দাগ, প্লাস্টারের মান, রংয়ের কাজ।
- ফ্লোরিং: টাইলসের জয়েন্ট, লেভেলিং, চিপ বা ভাঙ্গা অংশ।
- ডোর-উইন্ডো: সহজে খুলছে-বন্ধ হচ্ছে কিনা? লক ও হ্যান্ডেল ঠিক আছে কিনা? সিলিং (ওয়াটার সিল) যথেষ্ট কিনা?
- প্লাম্বিং: সব ট্যাপ, শাওয়ার চালু করুন। লিকেজ আছে কিনা? বাথরুম ফ্লোরিংয়ে সঠিক ঢাল (Slope) আছে কিনা? পানির স্ট্রেস পরীক্ষা করুন।
- ইলেকট্রিক্যাল: সব লাইট, সুইচ, সকেট, মেইন ডিবি বক্স চেক করুন। ওয়্যারিং মানসম্মত কিনা?
- ব্যালকনি ও ওয়াশ এরিয়া: ওয়াটার প্রুফিং, ড্রেনেজ সিস্টেম।
পরামর্শ: একজন বিল্ডিং ইন্সপেক্টর বা অভিজ্ঞ হাউজিং কনসালট্যান্টকে দিয়ে হ্যান্ডওভার পরিদর্শন করান। তাদের ফি সমস্যা খুঁজে পেতে ও দাবি আদায়ে সাহায্য করবে।
৯. ভবিষ্যৎ রিসেল ভ্যালু ও রেন্টাল ইয়েল্ড না ভাবা
ফ্ল্যাট শুধু বাসস্থান নয়, বিনিয়োগও বটে। ভবিষ্যতে বিক্রি বা ভাড়া দিলে কি লাভ হবে?
- বিনিয়োগের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচ্য:
- এলাকার রেন্টাল ইয়েল্ড: আশেপাশে অনুরূপ ফ্ল্যাটের ভাড়ার হার কেমন? (বার্ষিক সম্ভাব্য ভাড়া / ফ্ল্যাটের ক্রয়মূল্য) * ১০০% = আনুমানিক ইয়েল্ড (%)। ঢাকার ভালো লোকেশনে সাধারণত ৫%-৭%।
- ভবিষ্যৎ মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনা: এলাকায় নতুন অবকাঠামো (মেট্রো, বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স) আসছে কিনা?
- চাহিদা ও সরবরাহ: এলাকায় ফ্ল্যাটের চাহিদা কেমন? নতুন অনেক ফ্ল্যাট আসছে কিনা?
১০. আবেগ দ্বারা অত্যধিক প্রভাবিত হওয়া ও তাড়াহুড়ো করা
“ওই ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে সন্ধ্যার মেঘ দেখা যায়!” – এই আবেগে চটজলদি ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ফেললে পরবর্তীতে আইনি ত্রুটি ধরা পড়ে। রিয়েল এস্টেটে আবেগকে পাশ কাটিয়ে যুক্তি ও যাচাই প্রাধান্য পেতে হবে।
- আবেগ নিয়ন্ত্রণের টিপস:
- কমপক্ষে ৩-৫টি ফ্ল্যাট/প্রজেক্ট ঘুরে দেখুন। তুলনা করুন।
- পরিবারের সদস্য বা বন্ধুকে নিয়ে যান, যিনি আবেগপ্রবণ হবেন না।
- কোন প্রেসার (“আরেক ক্রেতা আগ্রহ দেখিয়েছেন!”) বা লিমিটেড টাইম অফারের ফাঁদে পা দেবেন না।
- সব তথ্য যাচাই, আইনজীবীর পরামর্শ এবং আর্থিক ক্যালকুলেশন শেষ না করে কোন সাইনিং বা বড় টাকা প্রদান করবেন না।
জেনে রাখুন (FAQs):
Q1: পুরোনো ফ্ল্যাট কিনতে গেলে বিশেষভাবে কোন বিষয়গুলো যাচাই করব?
A1: পুরোনো ফ্ল্যাটে নির্মাণের গুণগত মান, ইলেকট্রিক্যাল-প্লাম্বিং সিস্টেমের অবস্থা, রক্ষণাবেক্ষণের ইতিহাস ও বকেয়া বিল (ইউটিলিটি, মেইনটেন্যান্স) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সম্মিলিত মেরামত তহবিল (সিঙ্কিং ফান্ড) আছে কিনা ও তার অবস্থা জানুন। বাসিন্দাদের কাছ থেকে সরাসরি ভবন ও ফ্ল্যাটের সাধারণ সমস্যা (জলাবদ্ধতা, লিফট খারাপ) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করুন। মালিকানা হস্তান্তরের পুরো প্রক্রিয়া (মিউটেশন) বিক্রেতা সঠিকভাবে করবেন কিনা চুক্তিতে লিখিত নিশ্চয়তা নিন।
Q2: ফ্ল্যাট কেনার জন্য ঋণ নেওয়ার আগে কী কী প্রস্তুতি নেব?
A2: প্রথমেই আপনার ক্রেডিট স্কোর (CIB রিপোর্ট) চেক করুন। স্কোর ভালো না থাকলে সুদের হার বেশি হতে পারে বা ঋণ মিলতেও সমস্যা হতে পারে। ঋণের যোগ্যতা নির্ধারণ করুন: আপনার আয়, চলতি ঋণ, পরিবারের খরচ বিবেচনায় মাসিক কত কিস্তি দিতে পারবেন। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র (আয়ের প্রমাণপত্র, ট্যাক্স সার্টিফিকেট, জাতীয় পরিচয়পত্র, ক্রয় চুক্তির ড্রাফ্ট) আগে থেকেই গুছিয়ে রাখুন। বিভিন্ন ব্যাংক ও এনবিএফআই-এর (ইসলামী ব্যাংকসহ) ঋণের শর্তাবলী, সুদের হার ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ফি তুলনা করুন।
Q3: রাজউক (RAJUK) অননুমোদিত ফ্ল্যাট কিনলে কী ঝুঁকি আছে?
A3: রাজউক অননুমোদিত ভবনের ফ্ল্যাট কেনা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এ ধরনের ফ্ল্যাটের বৈধ দলিল (খতিয়ান/মিউটেশন) পাওয়া প্রায় অসম্ভব। ভবনটি ভেঙে ফেলার আদেশ (ডেমোলিশ) হতে পারে। ব্যাংক ঋণ বা রেজিস্ট্রেশনে জটিলতা তৈরি হয়। ভবিষ্যতে বিক্রি করা কঠিন এবং দামও কম পাওয়া যায়। পৌরসভার বিল্ডিং কোড লঙ্ঘন করলে সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক জরিমানা আরোপিত হতে পারে। তাই শুধুমাত্র রাজউক বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত প্রজেক্টে বিনিয়োগ করুন।
Q4: ফ্ল্যাট কেনার পর রেজিস্ট্রেশন কত দিনের মধ্যে করতে হয়?
A4: বাংলাদেশে সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়ের রেজিস্ট্রেশন সাধারণত চুক্তি সাক্ষরের তারিখ থেকে সর্বোচ্চ ৯০ (নব্বই) দিনের মধ্যে সম্পন্ন করতে হয়। তবে, এটি যত দ্রুত সম্ভব করা উচিত। রেজিস্ট্রেশন না হলে আইনগতভাবে আপনি সম্পত্তির মালিক হিসেবে স্বীকৃত হবেন না। বিক্রেতার সাথে চুক্তি অনুযায়ী রেজিস্ট্রেশনের খরচ কে বহন করবেন (সাধারণত ক্রেতা স্ট্যাম্প ডিউটি, বিক্রেতা রেজিস্ট্রেশন ফি দেয়), তা নিশ্চিত করুন। একজন রেজিস্ট্রেশন এজেন্ট বা আইনজীবীর সহায়তা নিন।
Q5: ডেভেলপার যদি হ্যান্ডওভারের তারিখে ফ্ল্যাট দিতে ব্যর্থ হয়, তখন কী করব?
A5: চুক্তিপত্রে বিলম্বের জন্য ডেভেলপারের জরিমানার বিধান (যেমন: মাসিক বিক্রয়মূল্যের ০.৫%-১%) থাকা আবশ্যক। প্রথমে ডেভেলপারকে লিখিত নোটিশ দিন, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী জরিমানা দাবি করুন এবং ফ্ল্যাট হস্তান্তরের নতুন তারিখ জানতে চান। ডেভেলপার সাড়া না দিলে, REHAB-এ অভিযোগ দায়ের করুন। প্রয়োজনে, চুক্তিতে উল্লিখিত বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি (আর্টিট্রেশন) অনুসরণ করুন বা দেওয়ানি আদালতে মামলা করার বিকল্প বিবেচনা করুন।
Q6: ফ্ল্যাট কেনার পরে হঠাৎ করে অতিরিক্ত চার্জ বা ফি দাবি করলে কী করণীয়?
A6: সব ধরনের ফি ও চার্জ ক্রয় চুক্তিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক। যদি চুক্তির বাইরে হঠাৎ অতিরিক্ত ফি দাবি করা হয়, দৃঢ়ভাবে এর বিরোধিতা করুন। চুক্তির কপি রেফারেন্স দিন। ডেভেলপারের উচ্চতর কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করুন। REHAB বা বাংলাদেশ রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন (BREBAA)-এর শরণাপন্ন হন। প্রয়োজনে আইনি নোটিশ পাঠানোর পরামর্শ আইনজীবীর কাছ থেকে নিন। চুক্তি লঙ্ঘনের শাস্তিমূলক বিধান থাকলে তা প্রয়োগের দাবি জানান।
ফ্ল্যাট কেনার এই যাত্রাপথে প্রতিটি পদক্ষেপই আপনার জীবনের অন্যতম বৃহৎ বিনিয়োগকে সুরক্ষিত করে। ‘ফ্ল্যাট কেনার আগে জেনে নিন’ এই মন্ত্রটিকে আঁকড়ে ধরে আইনি যাচাই, আর্থিক সতর্কতা আর নির্মাণের মান পরীক্ষার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিলেই কেবল আপনার স্বপ্নের ছাদ প্রকৃত অর্থে নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হবে। রিয়াজ, শাহানার মতো অসংখ্য মানুষের অভিজ্ঞতা আমাদের শেখায়, একটু ধৈর্য, একটু গবেষণা আর সঠিক পরামর্শ কেড়ে নিতে পারে না আপনার কষ্টার্জিত টাকা আর নিরাপদ ভবিষ্যৎ। আজই একজন রিয়েল এস্টেট আইনজীবী বা বিশেষজ্ঞ কনসালট্যান্টের সাথে কথা বলুন, আপনার স্বপ্নকে যুক্তির অমোঘ শক্তিতে বলীয়ান করুন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।