জুমবাংলা ডেস্ক: বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্রে দীর্ঘ সময় ধরে যারা প্রভাব বিস্তার করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ মওদুদ আহমদ কখনও নন্দিত, কখনও সমালোচিত হয়েছেন। তার সহকর্মীরা মনে করেন, মওদুদ আহমদ প্রকৃত অর্থেই একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন।
মওদুদ আহমদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ছিলেন। পরে তিনি জিয়াউর রহমান, জেনারেল এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার সরকারেও ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন।
জেনারেল এরশাদের সরকারে থাকলেও পরে তিনি আবার বিএনপির রাজনীতিতে ফিরে আসেন। তার সহকর্মীরা উল্লেখ করেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ একজন দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান যেমন ছিলেন, তেমনি তিনি আইন পেশাতেও সফল ছিলেন।
বাংলাদেশের রাজনীতির বিভিন্ন পর্ব নিয়ে তার লেখা একাধিক বই প্রশংসিত হয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
মওদুদ আহমদ ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময় ওই কলেজের ছাত্র সংসদের আপ্যায়ন সম্পাদক ছিলেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ফরমান উল্লাহ খানের প্রতিষ্ঠিত খেলাফত রব্বানীর ছাত্র সংগঠন ছাত্রশক্তির সঙ্গে জড়িত হয়েছিলেন।
এর আগে স্কুলের ছাত্র থাকার সময় বাংলা ভাষা আন্দোলনের মিছিলে যোগ দিয়ে তিনি জেলও খেটেছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করার পর তিনি লন্ডনে বার-অ্যাট-ল পড়তে যান। সেখানে তার পরিচয় হয়েছিল একই বিষয়ের সিনিয়র শিক্ষার্থী আমীর উল ইসলামের সঙ্গে।
সিনিয়র আইনজীবী আমীর উল ইসলাম বলেছেন, তিনি এবং মওদুদ আহমদ বার-অ্যাট-ল শেষ করে ৬০ এর দশকের মাঝামাঝি দেশে ফেরেন। তখন ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা ঘোষণা করলে তারা তার সমর্থনে সক্রিয়ভাবে মাঠে নামেন।
ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম জানিয়েছেন, তিনি দেশে ফেরার পরই হাইকোর্টে ওকালতি শুরু করেন। তখন মওদুদ আহমদ তার জুনিয়র হিসাবে কাজ শুরু করেন।
তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানি শাসকদের করা যে মামলা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছিল এবং যে মামলা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল – সেই মামলায় তিনি এবং মওদুদ আহমদ আইনজীবী হিসাবে কাজ করেছেন।
মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধের সময় মওদুদ আহমদকে পোস্টমাস্টার জেনারেল নিয়োগ করেছিল। যুদ্ধ শুরুর আগে ১৯৭১ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের ডাকা গোলটেবিল বৈঠকে শেখ মুজিবের সঙ্গে ছিলেন মওদুদ আহমদ। মুক্তিযুদ্ধে সংগঠকদেরও অন্যতম একজন ছিলেন তিনি।
মওদুদ আহমদের একজন ঘনিষ্ঠ আত্নীয় জানিয়েছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে তার সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল। সে সময় মওদুদ আহমদ আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে আটক রাজনীতিকদের জন্য আইনি লড়াই চালানোসহ মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেছেন।
১৯৭৫ সালে পট পরিবর্তনের পর তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন। তিনি মওদুদ আহমদকে উপদেষ্টা নিয়োগ করেছিলেন ১৯৭৭ সালে।
বিএনপি প্রতিষ্ঠার আগে জিয়াউর রহমান জাগদল গঠন করেছিলেন। সেই জাগদলের ১৯ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন মওদুদ আহমদ। পরে তিনি বিএনপি প্রতিষ্ঠার সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন।
জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারে ১৯৭৯ সালে উপপ্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন মওদুদ আহমদ। তবে বিএনপির একজন নেতা বলেন, উপপ্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরের বছরই ১৯৮০ সালে জিয়াউর রহমান তাকে মন্ত্রীসভা থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন।
পরে সামরিক শাসক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সরকারে ব্যারিস্টার আহমেদ প্রথমে মন্ত্রী, তারপর উপপ্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত হয়েছিলেন। তিনি ১৯৮৯ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এরশাদ সরকারের পতনের সময় পর্যন্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
২০০১ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারেও তিনি আইনমন্ত্রী ছিলেন।
জিয়াউর রহমানের জাগদল এবং পরে বিএনপি প্রতিষ্ঠার সাথে ছিলেন ব্যারিস্টার আহমদ। তবে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ১৯৮৫ সালে তাকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।
সে বছরই তিনি জেনারেল এরশাদের সরকারের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও অন্যতম একজন ছিলেন মওদুদ আহমদ।
আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর গণআন্দোলনের মুখে এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি জাতীয় পার্টি থেকে অংশ নিয়ে এমপি হন। তিনি ১৯৯৬ সালে বিএনপিতে ফিরে আসেন।
জিয়াউর রহমান, জেনারেল এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার সরকার-তিনটি সরকারের ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা এবং বিভিন্ন সময় দলবদল নিয়ে অনেক সময় তিনি সমালোচিতও হয়েছেন।
মওদুদ প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপির প্রার্থী হিসাবে ১৯৭৯ সালে তার এলাকা নোয়াখালী-৫ আসন থেকে।
জেনারেল এরশাদের শাসনের সময় ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সালের সংসদের তিনি জাতীয় পার্টি থেকে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। ১৯৮৮ সালের সংসদে তিনি সংসদ নেতাও ছিলেন।
১৯৯১ সালে সব দলের অংশগ্রহণে যে নির্বাচন হয় – তাতে তিনি জাতীয় পার্টি থেকেই এমপি হয়েছিলেন।
আবার বিএনপির প্রার্থী হিসাবে এমপি হয়েছিলেন তিনি ২০০১ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদে।
সংসদে সাংবিধানিক কোন ইস্যুতে আলোচনায় বিএনপি ব্যারিস্টার আহমদের ওপর বেশি নির্ভর করতো বলে দলটির নেতারা বলেছেন।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪০ সালের ২৪ মে। তার পিতা মরহুম মাওলানা মমতাজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষক এবং মাতা বেগম আম্বিয়া খাতুন গৃহিণী ছিলেন। ছয় ভাই বোনের মধ্যে ব্যারিস্টার আহমদ ছিলেন চতুর্থ।
তার স্ত্রী হাসনা জসীমউদদীন মওদুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক এবং তিনিও এরশাদ সরকারের সময়ে সংরক্ষিত নারী আসনে এমপি হয়েছিলেন। তার দুই ছেলে এবং এক মেয়ে। বড় ছেলে আসিফ মওদুদ অল্প বয়সেই মারা যান অনেক আগে। আর দ্বিতীয় সন্তান আমান মওদুদ প্রতিবন্ধী ছিলেন এবং তিনিও মারা যান ২০১৫ সালে। তার মেয়ে আনা আসপিয়া মওদুদ স্বামীসহ থাকেন নরওয়েতে। সূত্র: বিবিসি বাংলা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।



