একেএম কামাল উদ্দিন চৌধুরী, বাসস: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর ভবিষ্যত বাংলাদেশের এক ‘রূপকল্প’। ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত-সমৃদ্ধ-শিল্পোন্নত সোনার বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণে বর্তমান সরকারের একটি সফল উদ্যোগ এই স্মার্ট শিল্প নগরী। বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় পর্যায়ক্রমে এই শিল্প নগরীতে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাই থেকে ১০ কিলোমিটার এবং বন্দর নগরী চট্টগ্রাম থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে বঙ্গবন্ধু শিল্প নগর অবস্থিত। ইছাখালী, চর শরত, চর মোশাররফ, চর লক্ষ্মী ও সাধুর চরে সমুদ্র উপকূলে ৩৩ হাজার একর জমিতে এটি নির্মিত হচ্ছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক বরাবর বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরের কৌশলগত অবস্থান এবং সমুদ্র তীরবর্তী অর্থনৈতিক অঞ্চল হওয়ায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে একটি বড় ক্যানভাসে স্বপ্ন দেখতে অনুপ্রাণিত করছে।
বাংলাদেশ ইকনমিক জোনস অথরিটি(বেজা)’র নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, বঙ্গবন্ধু শিল্প নগর দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য অন্যতম উপযুক্ত স্থান। বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল শহরের তুলনায় মিরসরাই এবং চট্টগ্রাম বিভাগে ব্যবসা এবং জীবনযাত্রার ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। ফলে এটি ঢাকা-চট্টগ্রাম শিল্প করিডোরের কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে।
‘এতে উচ্চমানের ব্যবসা বান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা হয়েছে। যা চট্টগ্রামকে একটি নেতৃস্থানীয় আঞ্চলিক ব্যবসায়িক কেন্দ্রে পরিণত করতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে,’ যোগ করেন তিনি।
দেশের প্রথম পরিকল্পিত শিল্প নগরী ‘বঙ্গবন্ধু শিল্প নগর’ একটি সত্যিকারের বিশ্বমানের ব্যবসা ও শিল্প কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
বেজার পরামর্শক মোঃ আব্দুল কাদের খান বলেন, কোভিড মহামারীর সময়েও বাংলাদেশ বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এবং শিল্পায়নের সাথে, গ্রামীণ জনসংখ্যার শহরাঞ্চলে অভিবাসন দেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বিদ্যমান শহুরে এলাকাগুলি আরও ঘনীভূত হচ্ছে। প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৭,৪০০ জন লোকের ঘনত্বের কারণে ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর হিসাবে পরিচিত হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, ২০৩৫ সালের মধ্যে প্রায় ১১০ মিলিয়ন মানুষ অর্থ্যাৎ মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক, শহরাঞ্চলে বসবাস করবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। বর্তমানে, বাংলাদেশের শহুরে জনসংখ্যার ৬০ শতাংশেরও বেশি প্রধানত চারটি মেট্রোপলিটন শহর – ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা এবং রাজশাহীতে কেন্দ্রীভূত।
নগরায়নের এই গতির পরিপ্রেক্ষিতে কর্মসংস্থান এবং অন্যান্য সার্বজনীন পরিষেবার পাশাপাশি আবাসন, পরিবহন, জ্বালানি এবং অন্যান্য অবকাঠামোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান শহুরে জনসংখ্যার চাহিদা পূরণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে।
একজন উন্নয়ন ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ আবদুল কাদের খান বলেন, ‘নগরায়নের সমস্যা মোকাবেলায় একটি স্মার্ট শিল্প শহরই হতে পারে নিখুঁত চিকিৎসা।’
তার মতে, এটি একটি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে চালিত করে এবং এর বিকাশকে উৎসাহিত করে। এটি পর্যাপ্ত শহুরে অবকাঠামো প্রদানের তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয়তাকেও নির্দেশ করে। অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত দিকগুলির ক্ষেত্রে আইসিটি এবং অন্যান্য উপায়গুলি ব্যবহার করে জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, নগর ব্যবস্থাপনা এবং পরিষেবাগুলির দক্ষতা বৃদ্ধি করে। যা বর্তমান এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম।
স্মার্ট শিল্প শহরগুলি শহরের অবকাঠামো নিরীক্ষণের জন্য ইন্টারনেট অফ থিংস প্লাটফর্ম ব্যবহার করে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি লাভের জন্য পরিচিত। যা ট্রাফিক, পার্কিং, পানি এমনকি বায়ুর গুণমান থেকে শুরু করে সবকিছুই তদারকি করে এবং দীর্ঘমেয়াদী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ফলাফল ডেটা ব্যবহার করে।
শুধুমাত্র অর্থনৈতিক অঞ্চলের ধারণার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ না করে, বেজা এমন একটি অভূতপূর্ব পদ্ধতিতে বঙ্গবন্ধু শিল্প নগর প্রকল্প এলাকা ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা বাংলাদেশের সমগ্র অর্থনীতিকে বদলে দেবে, পাশাপাশি ব্যবসায়ী এবং নাগরিকদের আকৃষ্ট করে জীবনের সামগ্রিক মান উন্নত করবে।
বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ স্মার্ট শিল্পনগরীতে রূপান্তর করতে বেজা মহাপরিকল্পনা তৈরি করছে। যাতে সমুদ্র বন্দর, রেল ও সড়ক যোগাযোগ, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেরিন ড্রাইভ এবং আবাসিক এলাকার মতো সামাজিক অবকাঠামো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখানে পর্যটন, পার্ক, হাসপাতাল, স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও স্থাপন করা হবে।
আবদুল কাদের খান বলেন, মহাপরিকল্পনার প্রাথমিক লক্ষ্য হল গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো, অর্থনৈতিকভাবে টেকসই, স্বচ্ছ এবং পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে পাবলিক পরিষেবাগুলির গতিশীলতা নিশ্চিত করা।
শিল্প উন্নয়নের পাঁচটি কেন্দ্রীয় উপাদান: শাসন, অর্থনীতি, বাস্তুসংস্থান, সম্পদ এবং স্থানীয় জনগণকে উদ্দেশ্য করে এই মহাপরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শিল্প নগর দেশের প্রথম পরিকল্পিত শহর, যা সত্যিকারের বিশ্বমানের ব্যবসা ও শিল্প কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করবে।
তিনি জানান, আগামী ১৫ বছরের মধ্যে ১৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং এই শিল্প নগর থেকে ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি নিশ্চিত করবে বলে আশা করা হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ ও রপ্তানি বাজারের জন্য উৎপাদন শুরু করতে শহরটি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করতে শুরু করেছে।
স্থানীয় কোম্পানিগুলো, যারা জায়ান্ট হিসেবে বিবেচিত, তারাও এখানে কারখানা স্থাপন শুরু করেছে। আশা করা হচ্ছে যে, এই শিল্প নগরীতে বিভিন্ন ধরণের শিল্প যেমন; গার্মেন্টস এবং এর সহায়ক শিল্প, কৃষি-পণ্য এবং কৃষি প্রক্রিয়াকরণ যন্ত্র, সমন্বিত টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, জাহাজ নির্মাণ, মোটরবাইক সংযোজন কারখানা, খাদ্য ও পানীয়, পেইন্ট এবং রাসায়নিক, কাগজ এবং পণ্য, প্লাস্টিক, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং (অটো-পার্টস এবং সাইকেল সহ), ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য, বিদ্যুৎ এবং সোলার পার্ক স্থাপন করা হবে।
আবদুল কাদের খান বলেন, বঙ্গবন্ধু শিল্প নগর হতে যাচ্ছে দেশের প্রথম ‘সবুজ’ বা পরিবেশ-শিল্পের শহর, যা প্রকৃতি, জ্বালানি ব্যবস্থা, উপকরণ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যাতে জল সরবরাহ এবং নিষ্কাশন; কার্যকর ইকো-ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক ব্যবস্থাপনা, নির্মাণ এবং সংস্কারের ব্যবস্থা থাকবে।
বেজার অফিস সূত্রে জানা যায়, বেজা ইতিমধ্যেই ১২৭টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রায় ৫,৬১৪ একর জমি বরাদ্দ করেছে এবং তাদের প্রস্তাবিত বিনিয়োগ প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।