ড. মো. হাসিবুল আলম প্রধান: ২০০৫ সালের ২৫ জুন শনিবার রাত ১২টা ৩০ মিনিটে নেদারল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডাম থেকে ফিরে ডেন হেগ সেন্ট্রাল রেলওয়ে স্টেশন হয়ে ইনস্টিটিউট অব সোস্যাল স্টাডিজের (আইএসএস) হোস্টেল যে এলাকায় অবস্থিত সেই গোন্ডেলস্ট্রাট এলাকায় ট্রাম ধরে ফিরছি। সম্ভবত শেষ ট্রাম তাই লোকজন নেই বললেই চলে। আমার পাশের সীটে বসেছিল ষাটোর্ধ বয়সী এক ইরাকী, তিনি একটি পেট্রোল পাম্পে কর্মরত। আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে তিনি খুব আগ্রহ সহকারে আমাদের দেশের প্রশংসা করলেন। যেহেতু ভালো ইংরেজি বলতে পারছিলেন না, তাই তার সব কথা ঠিকমত বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল। এক পর্যায়ে তিনি বললেন, ‘Your leader Mujib, very good leader’। বিদেশের মাটিতে এসে একজন বিদেশি শ্রমিকের মুখে আমাদের জাতির পিতার নাম শুনে দারুণ এক আনন্দে আমি রোমাঞ্চিত হলাম। সেই সাথে শ্রমিকটির প্রতি আমার মাথা শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে গেল।
বঙ্গবন্ধু যখন আমাদের মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের উত্তাপ দেশের মাটি থেকে বিদেশেও ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেই উত্তাপ তখন স্পর্শ করেছিল ত্রিশোর্ধ যুবক ইরাকী শ্রমিক রহমানকে। এখনও তাই তার স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি বঙ্গবন্ধুর নাম। অথচ আমাদের দেশে আমাদের জাতির পিতাকে যথাযথ সম্মান করার বদলে প্রতিনিয়ত মিথ্যা ইতিহাস রচনা করে তাঁর মহান ভাবমূর্তিকে ম্লান করার জন্য কতোই না ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। অতীতে বিএনপি ও চারদলীয় জোট সরকার বঙ্গবন্ধু নামটিকে প্রচার মাধ্যম থেকে নির্বাসিত করেছিল এবং বঙ্গবন্ধুকে খাটো করার জন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের চেতনামূলে আঘাত হেনেছিল। শুধু কি তাই ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা নির্মমভাবে নিহত হলেও খুনিদের বাঁচানোর জন্য কত জঘন্য কূটকৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে এদেশে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর দীর্ঘ ২১ বছর দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) অধ্যাদেশের মাধ্যমে সেই হত্যার বিচার প্রক্রিয়া রুদ্ধ করা হয়েছিল। সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকাকালীন ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম কালো আইন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করাসহ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিদেশে পাঠিয়ে ও রাষ্ট্রদূত বানিয়ে নানাভাবে পুরস্কৃত করেছিলেন। পরবর্তীতে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এ নৃশংস হত্যার বিচার হয় এবং অধিকাংশ খুনিকে ফাঁসির রায়ে দণ্ডিত করা হয়।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, বিএনপি ও চার দলীয় জোট সরকারের শাসনামলে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামীদের বাঁচাবার পাঁয়তারা শুরু হয়, সেজন্য দেশের সর্বোচ্চ আদালতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাটির আপীল শুনানি ছাড়াই চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য প্রায় ৫ বছর ধরে ঝুলে ছিল। ২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট জয়লাভ করায় এবং জাতির পিতার কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় আপীল বিভাগে মামলাটি শুনানি করার উদ্যোগ নেয়া হয়।
২০০৯ সালের ১৯শে নভেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায় সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগ ঘোষণা করলে খুনী লে. কর্ণেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্ণেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, মেজর (অব.) বজলুল হুদা, মুহিউদ্দিন আহমদ (আর্টিলারি) ও এ কে এম মহিউদ্দিন আহমদ (ল্যান্সার) এর ফাঁসি কার্যকর হয় এবং এর ফলে কিছুটা হলেও জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। পরবর্তীতে পলাতক ৭ দÐপ্রাপ্ত আসামীদের মধ্যে অন্যতম ক্যাপ্টেন (বরখাস্তকৃত) আব্দুল মাজেদকে গত ১২ই এপ্রিল ২০২০ দিবাগত রাতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যদÐ কার্যকর করা হয়। তবে এখনও বঙ্গবন্ধুর খুনি বেশ কয়েকজন ফাঁসির দণ্ড প্রাপ্ত আসামী বিদেশে পলাতক থাকায় তাদের ফাঁসি কার্যকর না হওয়ায় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়েছে তা বলতে পারি না। বঙ্গবন্ধুর মতো একজন বিশ্ববরেণ্য নেতার ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ায় বাঙালি জাতি হিসেবে আমরা কলঙ্কিত ছিলাম। কারণ আমাদের ভুলে গেলে চলবে না বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন করতে শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বের নির্যাতিত স্বাধীনতাকামী মানুষের নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। তাইতো বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো ১৯৭৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্স-এ ৭২ জাতি জোট নিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে দেখে বলেছিলেন এতদিন আমি হিমালয় পাহাড়ের নাম শুনেছি কিন্তু সেই হিমালয় পাহাড় আজ আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু তাই নয়, সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শেষ হওয়ার পর ক্যাস্ট্রো তার নিজের আসন ছেড়ে উঠে এসে বঙ্গবন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরেন।
জাতীয় শোক দিবস আসলে আমি নিজের মাঝে দারুণ এক যন্ত্রণা অনুভব করি। এ যন্ত্রণা লাঘব করার জন্য বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের ওপর কিছু কিছু বই পড়ি। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ও মুক্তিযুদ্ধের মহামূল্যবান গানগুলো বার বার শুনতে থাকি। প্রফেসর সালাহ উদ্দিন, মোনায়েম সরকার ও ড. নুরুল ইসলাম মঞ্জুর সম্পাদিত বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস (১৯৪৭-১৯৭১) গ্রন্থের ২৪৪ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে একটি প্রতিবেদনের উপমা আমাকে দারুণভাবে মোহিত করে। সেটি হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতা হিসেবে শেখ মুজিব সম্পর্কে নিউজ উইকের এক প্রতিবেদনে বলা হয় ‘Poet of Politics’ অর্থাৎ রাজনীতির কবি। কথাটি আমাকে প্রচন্ডভাবে নাড়া দেয়, সত্যিই বঙ্গবন্ধু তো রাজনীতির কবি। রাজনীতির কবি বলেইতো তিনি পাকিস্তানের জেলের মধ্যে বন্দি থেকেও ৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে সমগ্র বাঙালি জাতিকে আলোড়িত ও আন্দোলিত করতে পেরেছিলেন এবং তাঁর নামেই সমগ্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে।
রাজনীতির কবি বলেই তো তাঁর নাম উচ্চারণ করতে করতে স্বাধীনতা যুদ্ধে হাজার হাজার বাঙালি হাসতে হাসতে জীবন দিয়েছে। রাজনীতির কবি বলেইতো বঙ্গবন্ধু বিশাল হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন গুরুতর অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত নয় এমন সব পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর ও দালাল হিসেবে পরিচিত রাজাকার ও আল বদরদের জন্য। ৭১’র রাজাকার ও আলবদরদেরকে (গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত ব্যতিত) সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা প্রসঙ্গে অনেকে বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করলেও এ প্রসঙ্গে ২০০৪ সালের জাতীয় শোক দিবসে ‘রাজশাহী বঙ্গবন্ধু পরিষদের’ একটি আলোচনা সভায় প্রফেসর সনৎ কুমার সাহার বক্তব্যের একটি অংশ খুবই যৌক্তিক মনে হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন ‘বাঙালি জাতি তাঁকে জাতির পিতার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে, সেই আসন থেকে তো তিনি হিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতি করতে পারেন না। ক্ষমাই-তো তার মহোত্তম ধর্ম হওয়া উচিত, বঙ্গবন্ধু সেই কাজই করেছেন।’
রাজনীতির কবির এই মহানুভতার নজীর পৃথিবীর আর কোথাও খুঁজে পাওয়া কঠিন। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নিজের ব্যাখ্যাও আমরা ইতিহাসের পাতা থেকে নিতে পারি। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সম্পাদিত বঙ্গবন্ধু হত্যার দলিল গ্রন্থে ‘বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ’ শিরোনামে একটি লেখায় শামসুজ্জামান খান লিখেছেন যে প্রফেসর কবীর চৌধুরীর সাথে তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে গেলে আলোচনার এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলেন ‘আমাকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল আলবদর ও রাজাকারদের ক্ষমা না করতে। খুব কঠোর পরামর্শও দেয়া হয়েছিল। শামসুজ্জামান জানো বোধ হয় প্রতিবিপ্লবীদের ধ্বংস করে দিতে। আমি তা করিনি। তাদের কুকীর্তির কথা জেনেও করিনি। আমার চোখে মুখে ভেসেছে অসংখ্য মা, বাবা, স্ত্রী ও শিশুর মুখ। আমার মনে হয়েছে আল্লাহর আরশ কাপতো না! আমি মানবিক হতে চেয়েছি, অনেকগুলো পরিবারকে ধ্বংস করিনি। আমি জাতির স্রষ্ঠা হিসেবে সেটা করতে পারি না। আমি ভুল করেছি, না ঠিক করেছি ইতিহাস একদিন সে বিচার করবে। তবে খুনি ও প্রকৃত অপরাধীরা রেহাই পাবে না, তাদের বিচার করবো।’ রাজাকার ও আলবদরদের (গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত ব্যতিত) সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলেও যারা খুনি ও প্রকৃত অপরাধী অর্থাৎ যারা মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত, তাদের যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়নি তা বঙ্গবন্ধুর কথা থেকে স্পষ্ট।
শুধু তাই নয় ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা পরের দিন সরকারী প্রেসনোটের রেফারেন্স দিয়ে দৈনিক বাংলা, বাংলার বাণী ও দি বাংলাদেশ অবজারভারসহ অন্যান্য জাতীয় দৈনিকগুলো যে হেড লাইন দিয়ে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার খবর ছেপেছিলো সেই হেডলাইনে সাব হেডলাইন দিয়ে এটাও বলা হয়েছিলো যে ধর্ষন ও হতাকারী এবং অগ্নি সংযোগকারীদের ক্ষমা নেই। আরো বিশদভাবে খবরগুলিতে যেটা বলা হয়েছে তা হলো- ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আইনে আটককৃত ও সাজাপ্রাপ্তদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করা হলেও বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা ( হত্যা) , ৩০৪ ধারা (দণ্ডার্হ নরহত্যা), ৩ ৭৬ ধারা (ধর্ষণ), ৪৩৫ ধারা (অগ্নি বা কোন বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে সম্পত্তি বা কৃষিজ ফসলের ক্ষতি সাধন), ৪৩৬ ধারা (অগ্নি বা কোন বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে গৃহ ধ্বংস) ও ৪৩৮ ধারা (অগ্নি বা কোন বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে জাহাজ ধ্বংস করা) সমূহের অধীন কোন ব্যাক্তি দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের ক্ষেত্রে এ সাধারণ ক্ষমা প্রযোজ্য হবে না। তারপরও অনেকেই বিভ্রান্তি ছড়ান যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে সকল রাজাকার আলবদরদেরকে ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছিল যা মোটেই সত্য নয়।
প্রকৃত সত্য হল যে, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আইনের অধীনে যে ৩৭ হাজার ৪ শত ৭১ জন দালালকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে ২৬ হাজার ব্যক্তির বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ না থাকায় তাদেরকে মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ ছিল এসব যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকার আলবদরদের কখনও সাধারণ ক্ষমার আওতায় আনা হয়নি। বঙ্গবন্ধুর আমলে দালাল আইনে ৭৫২ ব্যক্তির মামলায় বিচার সম্পন্ন করে দণ্ড প্রদান করা হয় এবং সাধারণ ক্ষমার ঘোষনার পরও ১১ হাজার ব্যক্তি কারাগারে আটক ছিল যাদের মামলার বিচার কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীসহ তাদের সহযোগী আলবদর ও রাজাকারদের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে বিচার করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) এ্যাক্ট, ১৯৭৩ (আন্তÍর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩) বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে ১৯৭৩ সালের ২০ই জুলাই জাতীয় সংসদে পাস হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হলে রাজাকার-আলবদরদের যা কিছু বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল তা বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি সাজা প্রাপ্ত ব্যক্তিদের মুক্তি দেওয়া এবং দালাল আইন রহিত করা হয়। ফলে ৭১’র মানবতাবিরোধী কর্মকান্ড ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত অনেক যুদ্ধাপরাধীও জেল থেকে বেড়িয়ে আসে।
এদেশে একাত্তরের চিহ্নিত ঘাতকদের বিচার যাতে না হয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উপর ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধু যে শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা গড়ার জন্য দৃঢ় প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছিলেন তা যেন বাস্তবায়িত না হয়, সেজন্য বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সুযোগ গ্রহণকারী সেই রাজাকার আলবদর ও ৭১’র ঘাতকদের প্রত্যক্ষ মদদে এবং আন্তর্জাতিক চক্রান্তে মীরজাফর খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে আমাদের সেনাবাহিনীর কতিপয় স্বাধীনতাবিরোধী, পাকিস্তানপন্থি ক্ষমতালোভী অফিসার খুনী লে. কর্ণেল ফারুক, লে. কর্ণেল রশীদ, মেজর শাহরিয়ার, মেজর বজলুল হুদা, ক্যাপ্টেন নূর প্রমুখ ১৫ আগস্টের কালরাতে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ঐ রাতে শুধু বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর পরিবারেরই ১৬জন সদস্য নিহত হন, এ ছাড়া নিহত হন সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর ৩জন সদস্যসহ নাম না জানা আরো কয়েকজন। জাতির পিতাকে হত্যা করার পর এদেশে খন্দকার মোশতাক এর নেতৃত্বে সামরিক জান্তাদের জংলী শাসন শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের হত্যার বিচার না করে বরং খুনিদেরকে আইন করে রক্ষা করা হয় এবং নানাভাবে পুরস্কৃত করা হতে থাকে।
১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রক্ষা করার জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারী করেন। সংবিধানের মৌলিক চেতনাবিরোধী এবং মানবতা ও সভ্যতা বিরোধী এই অধ্যাদেশকে ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই জিয়াউর রহমান সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে আইন হিসেবে অন্তভর্‚ক্ত করে আমাদের পবিত্র সংবিধানকে ভ‚লুন্ঠিত ও কলঙ্কিত করে। পৃথিবীর কোন সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে আইন করে খুনিদের রক্ষা করার এরকম দ্বিতীয় কোন নজীর নাই। এই খুনি চক্রকে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকাকালীন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠিয়ে দিয়ে পুরস্কৃত করেন। ঘাতকরা বুলেটের মাধ্যমে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল রাজনীতির কবির জীবন। কিন্তু পেরেছি কি? রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন কোটি বাঙালির হৃদয়ের অন্তঃস্থলে শক্তি, সাহস আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হয়ে। বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন মিছিলে, আন্দোলনে, কৃষকের হাসিতে, শ্রমিকের ঘামে আর সবুজ বাংলার পরতে পরতে। বঙ্গবন্ধু ৭১’র যে খুনি ও প্রকৃত অপরাধীদের বিচার করতে চেয়েছিলেন সেসব কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার উদ্যোগ মহাজোট সরকারের আমলে শুরু হয়। ইতোমধ্যে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, আলী আহসান মুজাহিদ, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মতিউর রহমান নিজামী এবং মীর কাসেম আলী-এর ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে ও অন্য যুদ্ধাপরাধীদেরও বিচার প্রায় সম্পন্ন হওয়ার পথে।
দেশে কতো ধরনের মিথ্যা ইতিহাস রচনার প্রতিযোগিতা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি, পাকিস্তানিদের হাতে ধরা দিয়েছিলেন এসব কতো কল্পকাহিনী সাজিয়ে চার দলীয় জোট সরকার ঢাক-ঢোল বাজিয়ে বাজারে তা প্রচার করেছে। ২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোট সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস : দলিলপত্র গ্রন্থের ৩য় খন্ডে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর পরিবর্তে জিয়াউর রহমানের নাম উল্লেখ করে মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিমূলে আঘাত হেনেছে এবং নগ্নভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করেছে। জোট সরকারের এই ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে জনস্বার্থে মামলা হলে গত ২১জুন ‘০৯ তারিখে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও বিচারপতি মমতাজ উদ্দিনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে রায় দিয়ে ইতিহাসের প্রকৃত সত্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।
এই রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস : দলিলপত্র গ্রন্থের ৩য় খন্ড বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। এই রায়ে বলা হয়েছে যে ২৬ মার্চ প্রত্যুষে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, যা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা আছে। সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদে এই ঘোষণাকে সাংবিধানিক মৌলিকত্ব দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় কোনো বক্তব্য বা এমনকি কোনো আইন যদি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হয় তা বাতিল বলে গণ্য হবে। অতএব ২০০৪ সালের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হলো এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস : দলিলপত্র গ্রন্থের ৩য় খন্ড আইন ও সংবিধান পরিপন্থি ঘোষণা করা হলো।
বিএনপি ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি যতই মিথ্যাচার করুক না কেন রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধুর ঔজ্জ্বল্য সামান্যতম ম্লান হয়নি বরং তিনি আরো বেশি গুণে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়েছেন, তাঁকে নিয়ে নানা গবেষণা হচ্ছে ও ভবিষ্যতেও হবে। ইতিহাস থেকে প্রকৃত সত্য ও তথ্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতা ও সাহসী বলিষ্ঠ নেতৃত্ব মানুষকে তাঁর মতো আদর্শবাদী রাজনীতিবিদ হতে প্রতিনিয়ত অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে। কারণ তিনি বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি মাটি ও ধুলিকণার সাথে মিশে আছেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিতা নেতা ও জাতির পিতা শেখ মুজিব হয়ে। তার কণ্ঠস্বর ৭১’র মুক্তি সংগ্রামে বাঙালি জাতিকে যেমন খ্যাপা পাগলাটে করেছিল আজও তেমনি একই অনুভব ও উদ্দীপনা তৈরী করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বীর বাঙালির অন্তরে।
রাজনীতির কবি এই মহান নেতা তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতেও তাঁর প্রজ্বলিত আলোকধারায় বাঙালির হৃদয়ে চির ভাস্বর, চির অম্লান। তাঁকে সপরিবারে হত্যা করার ৪৫ বছর পরও তিনি প্রতিনিয়ত স্বমহিমায় উদ্ভাসিত বাঙালির চিন্তা, আবেগ ও অনুভবে। তাইতো মুজিবকে স্বাধীনতাবিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের এতো ভয়, এতো হিংসা। মুজিব বাঙালির নেতা, বাঙালির কণ্ঠস্বর। তাইতো ১৯৭১ সালের মে মাসে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত একটি গানের কলি আজও বাঙালি জাতিকে করে আন্দোলিত ও আলোড়িত, ডাক দেয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীদের রুখবার মিছিলে তা হলো : `শোন একটি মুজিবরের থেকে/ লক্ষ মুজিবরের কন্ঠ স্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি/ আকাশে বাতাসে ওঠে রণি/ বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।’
লেখক : প্রফেসর ও সভাপতি, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।