জুমবাংলা ডেস্ক: অনেকেই তাকে চেনেন রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. সাহেদ নামে। টেলিভিশনের বিভিন্ন টকশোতে নানা নীতিবাক্য বলায় সারাদেশের সাধারণ মানুষের কাছেও তার চেহারা পরিচিত খানিকটা। ‘সমীহ করা’ এই লোকটা নিজের আরও কিছু নাম ব্যবহার করেন নানা জায়গায়। সর্বসাকল্যে স্কুলের গণ্ডি পেরোনো এই ব্যক্তি কখনও নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা বলে পরিচয় দেন। কখনও নিজেকে সচিব, মেজর বা কর্নেল বলেও দাবি করেন। মোবাইল ফোনের ফটো গ্যালারিতে সংরক্ষিত ছবিতে প্রভাবশালী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে নিজেকে দেখিয়ে নিজের প্রভাব জানান দেন কখনও কখনও। তার মালিকানাধীন হাসপাতালের গেটেও সেসব ছবি টাঙানো থাকত বড় করে।
জাতীয় দৈনিক সমকালের আজকের সংখ্যায় প্রকাশিত সাংবাদিক আতাউর রহমানের করা একটি বিশেষ প্রতিবেদনে সাহেদ কিভাবে বহুরূপ ধারন ও বহুনাম ব্যবহার করে সম্পদের পাহাড় গড়েন সেই তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বারবার নাম পাল্টানোর নেপথ্যে অপকর্ম আর প্রতারণাকে বৈধ করাই ছিল রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদের উদ্দেশ্য। প্রতারণার মাধ্যমে তিনি দুটি হাসপাতালের মালিক, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন। এতদিন মানুষ তাকে সমাজের প্রভাবশালী আর সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে জানলেও রিজেন্ট হাসপাতালে র্যাবের অভিযানের পর বেরিয়ে আসছে সাহেদের নানা কুকীর্তির কাহিনি।
প্রশ্ন উঠেছে, বহুরূপী এই প্রতারককে নেপথ্যে থেকে কারা দীর্ঘ দিন ধরে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছিলেন? কাদের কারণে বারবার অপকর্ম করেও পার পেয়েছেন তিনি? জেল থেকেও বেরিয়ে কী করে আবারও জড়িয়েছেন একই ধরনের প্রতারণায়? এত মামলা আর অভিযোগ নিয়ে প্রতারক সাহেদ সমাজের মূল স্রোতধারায় যেভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে ওঠাবসা করেছেন এবং করোনা হাসপাতাল হিসেবে নিজের প্রতিষ্ঠানকেও অন্তর্ভুক্ত করেছেন, তাতে পর্যবেক্ষকরাও বিস্মিত। কেপিআইভুক্ত এলাকার তার যাতায়াত ছিল প্রায় নিয়মিত।
গত সোমবার থেকে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত রাজধানীর উত্তরায় ১১ নম্বর সেক্টরে সাহেদের মালিকানাধীন রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালায়। বিনামূল্যে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে চুক্তি থাকলেও র্যাবের অভিযানে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ রোগীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। অন্তত ছয় হাজার মানুষকে করোনা টেস্টের ভুয়া সনদ দিয়েছে। অনুমোদন না থাকলেও রিজেন্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বাসায় গিয়ে করোনা নমুনা সংগ্রহ করে তা ফেলে দিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া পজিটিভ ও নেগেটিভ রিপোর্ট তৈরি করে আসছিল। উত্তরায় অবস্থিত এই হাসপাতালটির পাশাপাশি মিরপুরে সাহেদের মালিকানাধীন রিজেন্ট হাসপাতালেও অভিন্ন চিত্র পায় র্যাবে। এরপর রোগী সরিয়ে দুটি হাসপাতালই সিলগালা করে দেওয়া হয়।
ওই অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, রিজেন্ট হাসপাতালের অনুমোদনই ছয় বছর আগে শেষ হয়ে গেছে। এরপর প্রতারণা করে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কভিড রোগীদের চিকিৎসার জন্য চুক্তি করেন হাসপাতালের মালিক সাহেদ।
তিনি বলেন, ভাড়া করা ভবনে স্থাপিত রিজেন্টের অবকাঠামো যেমন হাসপাতালের মতো নয়, তেমনি সেখানকার আইসিইউও ছিল নামকাওয়াস্তে। আইসিইউর নূ্যনতম সরঞ্জাম বা সুবিধাও ছিল না সেখানে। নোংরা কক্ষে পাওয়া গেছে কাঁথা-বালিশ। এমনকি হাসপাতালের ল্যাবের ফ্রিজে কাঁচা মাছ সংরক্ষিত ছিল।
সাহেদ প্রভাব খাটিয়ে হাসপাতাল ভবনের মালিকদেরও ঠিকমতো ভাড়া পরিশোধ করতেন না। ভাড়া চাইলে উল্টো হুমকি দিতেন।
নাম পাল্টে প্রতারণা : রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে নিজের ওয়েবসাইটে তিনি নাম লিখেছেন মো. সাহেদ। হাসপাতালের নথিতেও তাই। ‘নতুন কাগজ’ নামে একটি দৈনিক পত্রিকারও ‘সম্পাদক’ এবং প্রকাশকও স্কুল পাস মো. সাহেদ। কিন্তু পত্রিকাটির নামে সরকারি অ্যাক্রিডিটেশন কার্ডে তিনি নাম ব্যবহার করেছেন মোহাম্মদ সাহেদ। তথ্য অধিদপ্তরের অস্থায়ী এই কার্ড নম্বর-৬৮৪৫। তবে রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে ওয়েবসাইটে দেওয়া তার স্বাক্ষরের সঙ্গে অ্যাক্রিডিটেশন কার্ডের স্বাক্ষরে নূ্যনতম মিল নেই! আবার জাতীয় পরিচয়পত্রে তার নাম মো. শাহেদ করিম, বাবার নাম সিরাজুল করিম, মা সুফিয়া করিম। তার বাড়ি সাতক্ষীরায়। ঢাকায় লালবাগে থাকেন। সূত্র বলছে, তিনি দুটি জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করতেন।
এ তো গেল তার কাগজপত্রের নাম। প্রতারণা করতে গিয়ে সাহেদ নিজেকে কখনও মেজর ইফতেকার আহম্মেদ চৌধুরী, কর্নেল ইফতেকার আহম্মেদ চৌধুরী, আবার কখনও কখনও মেজর শাহেদ করিম হিসেবে পরিচয় দিতেন। র্যাব সদস্যরা রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযানের পর সোমবার থেকে পলাতক তিনি। তার বিরুদ্ধে মামলাও করেছে র্যাব।
নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে শত শত কোটি টাকার মালিক তিনি! রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদ নিজেকে আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে দাবি করতেন। আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির সদস্য হিসেবে পরিচয় দিতেন তিনি।
তবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপকমিটির সাধারণ সম্পাদক শাম্মী আহমেদ বলেছেন, ‘সাহেদ করিম কমিটির সদস্য নন।’
সূত্র বলছে, সাহেদের অপকর্মের হাতেখড়ি চারদলীয় জোট সরকারের আমলে। ওই সময়ে জামায়াত নেতা ও যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলী এবং তারেক রহমানের বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। মামুনের হাত ধরে হাওয়া ভবন পর্যন্ত পৌঁছে যান এই প্রতারক। এরপর প্রতারণার নানা ব্যবসা খুলে বসেন তিনি। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মামুনের সঙ্গেই জেলে যেতে হয় তাকে। জেল থেকে বেরিয়ে ভোল পাল্টে আওয়ামী লীগের নেতা পরিচয়ে চালাতে থাকেন অপকর্ম। এভাবে হয়ে যান শত শত কোটি টাকার মালিক।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।