বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক ও কৌশলগত ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতার পর পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় পার করে আজ দেশটি একটি মধ্যম আয়ের রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। উন্নয়নের এই গতি ও উৎসাহ ঠিক যখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে, তখন ভারত হঠাৎ করে বাংলাদেশের জন্য ট্রানজিট সুবিধা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে একপ্রকার কূটনৈতিক ধাক্কা দিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত শুধু একটি সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত করার চেয়ে বেশি কিছু—এটি একটি রাজনৈতিক বার্তা এবং কৌশলগত অবস্থান প্রকাশ।
প্রেক্ষাপট
ঘটনার প্রেক্ষাপটটি ছিল এমন: রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনে বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশের প্রতিনিধি ও বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে এবং বাংলাদেশে কয়েক বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করে। সম্মেলনের সময় বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী তাঁর উপস্থাপনায় বলেন, “বাংলাদেশে ফ্যাক্টরি স্থাপন করুন, উৎপাদন করুন এবং এখান থেকে প্রতিবেশী দেশগুলোতে পণ্য রপ্তানি করুন।” অর্থাৎ, বাংলাদেশ এখন শুধু নিজস্ব চাহিদা পূরণ নয়, বরং আঞ্চলিক রপ্তানি হাব হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে। কিন্তু তার ঠিক পরেই ভারতের এই প্রতিক্রিয়াশীল পদক্ষেপ এক প্রশ্ন তুলেছে—এই অঞ্চলের বৃহৎ প্রতিবেশী দেশটি কি সত্যিই বাংলাদেশের উন্নয়নকে সমর্থন করে?

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
ভারতের এই সিদ্ধান্ত কেবল একটি ট্রানজিট বাতিল নয়, বরং দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক নির্ভরতাকেন্দ্রিক কূটনৈতিক কাঠামোকে ভেঙে নতুন কৌশল নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে। বাংলাদেশ এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে তাকে আর শুধুমাত্র একটি দেশের ওপর নির্ভর করে কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়া চলবে না।
বিকল্প পথের সন্ধান
বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাণিজ্য ও উন্নয়ন সহযোগিতার গতি বাড়িয়েছে। চীনের সঙ্গে “বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ”-এ অংশগ্রহণ, জাপানের সঙ্গে “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর” ও মেট্রোরেল প্রকল্প, তুরস্কের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা—এসবই দেখায় যে বাংলাদেশ একক নির্ভরতা নয়, বরং কৌশলগত বৈচিত্র্যকে প্রাধান্য দিচ্ছে।
আঞ্চলিক সংযোগ ও বিকল্প রুট উন্নয়ন
এছাড়া, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ইউরোপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংলাপ শুরু করেছে। ফলে ভবিষ্যতের ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যে বাংলাদেশের অবস্থান ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সক্ষমতাও এখন অনেক বেশি। দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) ইতিমধ্যেই ৪৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। রপ্তানি আয় বছরে ৫৫ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি, রিজার্ভ স্থিতিশীল, এবং বৈদেশিক বিনিয়োগও দ্রুত বাড়ছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক, এবং আইটি, ফার্মাসিউটিক্যালস, চামড়া ও হালকা প্রকৌশল পণ্যেও নতুন বাজার সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশের তরুণ জনগোষ্ঠী
সবচেয়ে বড় শক্তি হলো বাংলাদেশের তরুণ জনগোষ্ঠী। দেশের প্রায় ৬৫ শতাংশ জনসংখ্যা কর্মক্ষম, এবং তারা প্রযুক্তিতে দক্ষ, নতুন উদ্যোগ নিতে আগ্রহী এবং বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মে প্রতিযোগিতার উপযোগী। ফ্রিল্যান্সিং, স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম, ই-কমার্স ও ডিজিটাল পেমেন্ট সেক্টরে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম উদীয়মান দেশ হয়ে উঠেছে।
সরকারের কৌশলগত চিন্তাভাবনা
সরকারও এখন অনেক বেশি কৌশলগত চিন্তাভাবনা করছে। ‘ভিশন ২০৪১’, ‘ডেল্টা প্ল্যান ২১০০’, স্মার্ট বাংলাদেশ কর্মসূচি—এসবের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট যে দেশটি আগামী কয়েক দশকের জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করছে। এমন বাস্তবতায় একটি দেশের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা শুধু ঝুঁকিপূর্ণই নয়, বরং প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতামত
বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের এ ধরনের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের একটুও ঘাবড়ানোর কিছু নেই। বরং এটি আত্মসমালোচনার এবং আত্মপর্যালোচনার সুযোগ। বাংলাদেশ এখন বুঝে গেছে, একপেশে নীতির বন্ধন থেকে বেরিয়ে কৌশলগত স্বাধীনতাই ভবিষ্যতের চাবিকাঠি।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি
এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য—বাংলাদেশ কাউকে শত্রু মনে করে না, বরং সব দেশের সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থ ও সম্মানের ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। কিন্তু যখন কোনো রাষ্ট্র বারবার বাংলাদেশের স্বার্থকে অগ্রাহ্য করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তখন সে রাষ্ট্রকে ‘বন্ধু’ বলা কঠিন হয়ে পড়ে।
ভারতকে ছাড়াই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ
ভারত যদি সত্যিই বাংলাদেশের অগ্রগতি চায়, তাহলে সে অবশ্যই কৌশলগতভাবে সহযোগিতা করবে; আর যদি না করে, তাহলে বাংলাদেশ বিকল্প পথেই এগিয়ে যাবে—ধীরে, দৃঢ়ভাবে, আত্মবিশ্বাস নিয়ে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যত
আজকের বাংলাদেশ জানে—উন্নয়নের জন্য কারও অনুমতির প্রয়োজন নেই। দেশটির অর্থনীতি, মানবসম্পদ, আন্তর্জাতিক অবস্থান ও রাজনৈতিক পরিণততা এখন এমন পর্যায়ে, যেখানে ‘বন্ধু’র শর্তে নয়, বরং নিজের স্বার্থেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
নির্ভরশীলতা নয়, স্বাধীনতা
ভারতকে ছাড়াই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে—এটা এখন আর স্লোগান নয়, বরং বাস্তবতা। এ বাস্তবতা গঠিত হয়েছে অভিজ্ঞতা, সংগ্রাম ও কৌশলগত পরিণতির ভিত্তিতে।
ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত
ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কেমন হবে, তা নির্ধারণ করবে এই মুহূর্তের সিদ্ধান্ত। আর সেই সিদ্ধান্ত স্পষ্ট: বাংলাদেশ আত্মনির্ভর, বহুমাত্রিক, এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়—কারো ছায়া নয়, বরং নিজের আলোয় পথ দেখাতে চায়।
-রাকিব হাসান, লেখক ও সাংবাদিক, যুক্তরাষ্ট্র, ই-মেইল: [email protected].
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।