হেমন্তের হিম হিম হাওয়া বইছিল। আমলকির ছায়ায় বসে থাকতে থাকতে ছেলেটির চোখে তাই বুঝি ঘুম নেমেছিল। বয়স ওর দশ বছর। আমলকি গাছে হেলান দিয়ে দিব্যি ঘুমাচ্ছে। পরনে লুঙ্গি। পায়ের কাছে রাখা গুলতি ও মাটির তৈরি শক্ত ‘গুরোল’।
গুলতি হাতে ও এসেছিল ধানক্ষেত পাহারা দিতে। বিশাল ধানের মাঠে কেবল সোনারং লাগতে শুরু করেছে। রোপা-আমনের মাঠ। এই মাঠেরই একখণ্ড জমি বর্গা করে ছেলেটির বাবা। ওই জমিটারই ধান আগাম পেকেছে, দু-একদিনের ভেতরেই ধান কাটার মতো হবে। কিন্তু ঝাঁক বেঁধে ক্ষেতে নামতে শুরু করেছে সবুজরঙা পাখি। পাকা ধানের শীষ কেটে নিয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে সুন্দরবনের দিকে।
যেভাবে আসছে পাখিগুলো, তাতে দুই বিঘার এই ধানক্ষেতের সবগুলো শীষ ওরা কেটে নিয়ে যাবে ১০/১২ দিনের ভেতর। তাহলে বর্গাচাষির মাথায় হাত। ধানক্ষেত উজাড় হলে বকুনি খেতে হবে ক্ষেতমালিকের, নিজেরও উপোষ দেওয়ার দশা হবে। চাষি তাই ছেলেকে পাঠিয়েছে ক্ষেত পাহারা দিতে। কিন্তু ছেলেটা বসে আছে তো বসেই আছে, পাখিগুলোর দেখা নেই। চারপাশে ধানের মাঠ। মাঝখানে এক চিলতে উঁচু জমি। ঝোপঝাড়। দু-চারটে তাল-খেজুর গাছ। একটা আমলকি গাছ। ওর পাশেই বর্গাজমি। গুলতিতে ছেলেটির হাতের টিপ ভালো। পাখিগুলো এলে আজ দেখে নেবে সে।
আকাশে সবুজ রঙের ছবি এঁকে, হেমন্তের মিঠে রোদে ঝলকাতে ঝলকাতে প্রায় ৩০০টি পাখি এল দক্ষিণ দিক থেকে। খুশিতে ডাকছে। ডাকতে ডাকতেই নেমে পড়ল ধানক্ষেতে। ধানগাছে তেরছা হয়ে বসে বাছতে লাগল পাকা শীষগুলো। ধারালো ঠোঁট দিয়ে কুট করে শীষ কেটে উড়ে যাবে আবার।
সবুজ পাখিদের ঠোঁটে সোনালি ধানের শীষ, উড়ছে সারি সারি—চমৎকার দৃশ্যই বটে। কিন্তু পাখিদের চিৎকারে টুটে গেল ছেলেটির ঘুম। ঝট করে উঠে দাঁড়াল সে গুলতি হাতে। ক্ষেতে পাখিদের ঝাঁক দেখে ছুটল ওদিকে। পিচ্চি বালককে পাখিগুলো যেন পাত্তাই দিল না। ক্ষেতে নেমে সে চেঁচাতে লাগল, হাততালি দিতে লাগল। কিসের কী! পাখিগুলো ওড়াউড়ি করে এদিক-সেদিকে গিয়ে বসছে আবার। সমস্বরে চেঁচিয়ে ছেলেটিকে যেন শাসাচ্ছে।
একে তো আঙুলে মরণ কামড়, তার ওপর পাখিদের আক্রমণ। নখ-ঠোঁটে আহত করতে চাইল ছেলেটিকে। ফাঁকা মাঠে পাখিদের এ রকম আক্রমণের কথা তার কল্পনাতেও ছিল না। সে জানত না, যাকে সে গুলতি দিয়ে পেড়ে ফেলেছে, সেটার বয়স মাত্র ৪ মাস। গত আষাঢ়ে ওটার জন্ম। বাচ্চাই। বাচ্চার জন্যই পাখিগুলো ঝাঁক বেঁধে আক্রমণ করেছে। খোলা মাঠে পিচ্চি একটি মানুষকে ওরা ভয় পাবে কেন!
প্রায় বুক সমান ধানক্ষেত ঠেলে ছেলেটি দৌড়তে পারল না বেশিক্ষণ। ধানবনে পড়ে গেল পা হড়কে। পাখির বাচ্চাটি কিন্তু কামড় ছাড়েনি—ঝুলে আছে ছেলেটির আঙুলে। মাটিতে পড়ার পর ছেলেটি বুঝে ফেলল আসল ঘটনা। হ্যাঁচকা টানে পাখিটিকে আঙুল থেকে ছাড়িয়ে ছুড়ে দিল শূন্যে, আহত পাখির বাচ্চা কিছুটা উড়তে পারল, তারপরে পড়ে গেল মুখ থুবড়ে। পাখিদের ঝাঁক তখন সরে গেল ছেলেটির মাথার ওপর থেকে। ঘুরতে লাগল সেখানে। ছেলেটির কান, চিবুক, পিঠ ও ঘাড়—সব জায়গায় পাখিগুলো হয় নখর চালিয়েছে, না হয় ঠোঁট লাগিয়েছে। ছেলেটি কাঁপছে থরথর করে।
এই পাখিদের ঠোঁটের ধার সে জানে। দেখেছে বাসা-ডিম-বাচ্চা। অন্য পাখিদের হটিয়ে দিয়ে বাসা দখল করতেও সে দেখেছে—দেখেছে বেজি, বনবিড়াল ও পেঁচাদের ধাওয়া করতে। কিন্তু এ রকম দলবদ্ধ আক্রমণ যে মানুষকে করতে পারে, তা তার কল্পনারও বাইরে ছিল। অবশ্য বাসায় উঠে ডিম-বাচ্চা চুরি করতে গেলে মানুষকে আক্রমণ করে। ছেলেটি নিজেও সে আক্রমণের শিকার হয়েছে। কিন্তু আজকের ঘটনাটা অপ্রত্যাশিত।
দুঃসাহসী ও ধারালো ঠোঁটের এই পাখিটির নাম টিয়া বা গোলাপিকণ্ঠি টিয়া (Roseringed Parakeet)। বাংলাদেশে আরও ৪/৫ রকম টিয়া আছে। স্বভাব-চরিত্র, খাদ্য, বাসা-বাঁধার জায়গা ও ডিম-বাচ্চার ক্ষেত্রে সবাই একই রকম। তবে গোলাপিকণ্ঠির মতো সাহসী টিয়া বাংলাদেশে আর নেই।
এবার অতি সংক্ষেপে বাংলাদেশের টিয়াদের পরিচয় জেনে নেওয়া যাক।
১. গোলাপিকণ্ঠি টিয়া বা টিয়া (Roseringed Parakeet): বৈজ্ঞানিক নাম Psittacula krameri। মাপ ৪২ সেন্টিমিটার। গলায় গোলাপি-কালো বলয়। আলতারঙা ঠোঁট। মেয়েপাখির গলায় কণ্ঠি নেই। সবুজ ঘাসের মতো শরীরের রং। ঢাকা শহরে প্রচুর পরিমাণে আছে। গ্রাম-শহর সব জায়গাতেই দেখা যায়।
২. বড় টিয়া বা চন্দনা (Alexandrine Parakeet): মাপ ৫৩ সেন্টিমিটার। দেখতে সবুজরঙা। গলায় কালচে রঙের অর্ধবলয় আছে। ঠোঁট লাল। বন পছন্দ করে। মেয়েটির গলায় অর্ধবলয় থাকে না।
৩. লালমাথা টিয়া (Blossomheaded Parakeet): মাপ ৩৬ সেন্টিমিটার। পুরুষের মাথা লাল-নীল। মেরুন রঙের ঘাড়-মাথা কপাল। মেয়েটির মাথা-ধূসর ছাই, গলায় থাকে চকচকে হলুদ বলয়।
৪. মদনা বা লালবুক টিয়া (Redbreasted Parakeet): মাপ ৩৮ সেন্টিমিটার। বুক-পেট লালচে। তাতে গোলাপি হালকা আভা। ঠোঁটের ওপর দিয়ে দুচোখ পর্যন্ত হালকা টান আছে। ঘাড়-গলাজুড়ে চওড়া হলুদ টান আছে।
এরা সবাই দুই পা ও ঠোঁটকে হাতের মতো ব্যবহার করতে এবং গাছের ডালে উল্টো হয়ে ঝুলতে পারে। সবার গলায় ভালো জোর আছে। মিষ্টি গলা। উড়তে পারে দ্রুত। আচমকা বাঁক নিতে পারে। উল্টো হয়ে ঝুলে ঝুলে বাদুড়ের মতো এক ডাল থেকে অন্য ডালে চলাফেরা করে।
টিয়া বলতে আমরা গোলাপিকণ্ঠিকেই বুঝি। তাই এই টিয়া সম্পর্কে অতিসংক্ষেপে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
দলে থাকে। গাছের খোঁড়ল বা দরদালানের ফাঁকফোকরে বাসা করে। জায়গা বাছাই করে ২/৩ দিনে। মাঘ-জ্যৈষ্ঠে ডিম পাড়ে। ডিমের সংখ্যা ৪-৬টা। গোল ধরনের, রং সাদা। মেয়েটি একা ডিমে তা দেয়। ২৩-২৭ দিনে বাচ্চা ফোটে। ৫২-৫৭ দিন পরে বাচ্চারা উড়তে পারে। টিয়াদের খাদ্যতালিকায় আছে ধান, গম ও ফল।
টিয়া পোষ মানে। কিছু বুলি আওড়াতে পারে। দ্রুত উড়ে গিয়ে বসার ঠিক আগমুহূর্তে খাঁজকাটা (লেজের পালকের বিন্যাসের জন্য ওরকম মনে হয়) লেজটা পাখার মতো মেলে দেয়। খুব সুন্দর লাগে দেখতে। খাঁচাবন্দি টিয়া বুনো টিয়াদের ডাক শুনলে সাড়া দেয়, ছটফট করে। পাখা মেলতে চায়। ঢাকা শহরে প্রচুর পোষা টিয়া আছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।