স্পোর্টস ডেস্ক : দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে যেন পাত্তাই পেল না বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল আজ সিডনিতে ১০৪ রানে হেরেছে। এই বিশ্বকাপে এখনো পর্যন্ত এটিই সবচেয়ে বড় রান ব্যবধানে হার।
একদম শুরু থেকেই বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে মানের পার্থক্য ছিল স্পষ্ট, সেটা ফলাফলেও ফুটে উঠেছে।
শুরুতে ব্যাট করে দক্ষিণ আফ্রিকা ২০৫ রান তোলে। জবাবে বাংলাদেশ ১২০ বলের খেলায় ১২০ রানও তুলতে পারেনি, ১০১ রানে অলআউট হয়েছিল দলটি।
বাংলাদেশ দলের রিভিউতে ভুল
দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিংয়ের প্রথম ওভারেই বাংলাদেশ এমন একটি রিভিউ নিয়েছিল যা কখনোই মনে হয়নি ব্যাটে বলে কোনো সংযোগ হয়েছে।
বাংলাদেশের উইকেট কিপার নুরুল হাসান সোহান এরপরে আরো একটি রিভিউ নেন মেহেদী হাসান মিরাজের বলে। সেই বলে রিভিউ নেয়ার সময় সোহানকে এতটাই নিশ্চিত মনে হচ্ছিল যেন এটা নিশ্চিত আউট।
এমনকি অধিনায়ক সাকিবের দিকেও ফিরে তাকাননি তিনি। কিন্তু সেটাও রিপ্লেতে দেখা গেল, ব্যাটে বা গ্লাভসের সাথে বলের কোনো সংযোগ ঘটেনি।
এই রিভিউগুলোর কারণে বাংলাদেশ পরে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আর রিভিউ নিতে পারেনি। সাকিব আল হাসান ব্যাট করতে নামার পর চতুর্থ বলেই আনরিখ নরকীয়ার বলে লেগ বিফোর হয়ে আউট হয়ে যান।
তখন বাংলাদেশের দু’টি ব্যাটিং রিভিউ হাতে ছিল, কিন্তু অপরপ্রান্তে লিটন দাসকে প্রশ্ন করলেও ইতিবাচক কোনো সারা না পেয়ে আর রিভিউ নেননি সাকিব।
টেলিভিশন রিপ্লেতে দেখা গেল, বল লেগ স্ট্যাম্পের বাইরে পিচ করেছে, অর্থাৎ রিভিউ নিলে বাংলাদেশের অধিনায়ক টিকে যেতে পারতেন।
তখনই বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইন আপের ধস শুরু হয়। সৌম্য সরকার ও নাজমুল হোসেন শান্তর ২ ওভারে ২৬ রানে শুরু হুট করেই পাঁচ ওভারের মাথায় ৩৯ রানে ৩ উইকেটে দাঁড়ায়। সেখান থেকে বাংলাদেশ আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।
৪টি নো বল, ২টি ওয়াইড ও ৫ রান পেনাল্টি
তাসকিন আহমেদ দলের তৃতীয় ও নিজের দ্বিতীয় ওভারেই দুটি নো বল দেন।
সেখান থেকে শুরু হয় দক্ষিণ আফ্রিকার হাত খুলে খেলা। চারটি নো বলের মধ্যে তাসকিন একাই তিনটি নো বল দেন।
আরেকটি নো বল দেন সাকিব আল হাসান, তার প্রথম ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকা দুটি ছক্কাসহ মোট ২১ রান নেয়। এর আগে দেখা গেছে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এশিয়া কাপে একটি বাঁচা মরার ম্যাচে বাংলাদেশের বোলাররা ১২টি রান এক্সট্রা দিয়েছিলেন।
সেটাই বাংলাদেশের হারের বড় কারণ মনে করা হয়।
এই ম্যাচেও যখন বাংলাদেশের সঠিক লাইন লেন্থ ও ভালো বল করে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটারদের আটকে দেয়ার কথা, ঠিক তখনই নো বলগুলোর কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার পাওয়ার হিটার রাইলি রুশো ও কুইন্টন ডি কক আরো হাত খুলে খেলার সুযোগ পান।
ওয়াইড বল তুলনামূলক কম হলেও বাংলাদেশ পাঁচটি পেনাল্টি রানও হজম করেছে।
কেবল মাত্র ক্রিকেটের খুব সাধারণ একটি নিয়ম মাথায় না থাকার কারণে নুরুল হাসান সোহান এই শাস্তি পেয়েছেন। রান যোগ হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার খাতায়।
নো বলের পর ফ্রি হিটে কোনোভাবেই ফিল্ডিং পরিবর্তন করার নিয়ম নেই। কিন্তু উইকেট কিপিংয়ে থেকেও সোহান নিজের জায়গা পরিবর্তন করেন সাকিব আল হাসানের করা নো বলের পরের বলে।
মাঠের আচরণ বুঝে বল না করা
বাংলাদেশের ক্রিকেট বিশ্লেষক সৈয়দ আবিদ হুসেইন সামি মনে করেন সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের যে আচরণ সেটা বাংলাদেশের ফাস্ট বোলাররা ধরতে পারেননি।
আবিদ হুসেইন বলেন, ‘প্রথম ১৫ ওভারে বল খেয়াল করলে দেখবেন গতিতে ভ্যারিয়েশন নেই মুস্তাফিজ ছাড়া। এখানে মুস্তাফিজ আলাদাভাবে কাজ করেন। কাটার, স্লো বাউন্সার দেন। শেষ পর্যন্ত এই ম্যাচে ৪ ওভারে মাত্র ২৫ রান দেন।’
বাকি ফাস্ট বোলারদের মধ্যে তাসকিন ৩ ওভারে দেন ৪৬ রান, হাসান মাহমুদ শেষ ওভারে দারুণ বল করে ৭ রান দিলেও-এর আগে তিনি ২ ওভারে ২৫ দেন।
আবিদ হুসেইন সামির পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে, ‘শেষ ৫ ওভারে ১২ বলে মাত্র ৫ রান এসেছে, এই ১২টি বল ছিল স্লোয়ার।’
তিনি বলেন, মিডিয়াম পেসার সৌম্য সরকারকে বল দেয়া যেত। ধারাভাষ্যকার ডেল স্টেইন বারবার বলছিলেন, গতি কমিয়ে অফ স্ট্যাম্পের বাইরে ফুল লেন্থে বল দিতে। এ সবই এই ম্যাচে বাংলাদেশের জন্য ভরাডুবি ডেকে এনেছে।’
মেহেদী হাসান মিরাজ ও সাকিব আল হাসানের স্পিন কাজে লাগেনি আজো। মেহেদী হাসান মিরাজ যখন বল করতে আসেন প্রথম ওভারে ৮ রান দেন। এই উইকেট ও রানের গতির তুলনায় ভালো মনে হলেও। পরে তার বল খুব অনায়াসে তুলে মারেন দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটাররা।
দুটি চার ও দু’ছয়ে শেষ পর্যন্ত ৩ ওভারে ৩২ রান দেন তিনি।
মেহেদী হাসান মিরাজের বল দেখে মনে হচ্ছিল তাকে সহজেই খেলেছে ব্যাটাররা। বিশেষত স্কয়ার লেগে দুটি ছক্কা হাঁটু গেড়ে কেবল তুলে দেন রাইলি রুশো, তাতেই বল বাউন্ডারি পার করেছে।
সাকিব আল হাসান এই মাসের শুরুর ত্রি-দেশীয় টি-টোয়েন্টি সিরিজ থেকেই বল হাতে হতাশ করছেন।
আজো প্রথম ওভারে ২১ রান হজম করেন। পরের দু’ওভার তুলনামূলক ভালো করে দু’টি উইকেট নেন। তবে তা সামগ্রিকভাবে তেমন প্রভাব ফেলেনি।
ক্রিকেট পরিসংখ্যানবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ক্রিকউইজের পারফরম্যান্স এনালাইসিস হেড ফ্রেডি উইলডি একটি টুইটে লেখেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে বাংলাদেশের সাথে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট দলের তুলনা করতে পারছি না।’
তিনি আরো বলেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকায় এত এত বাঁহাতি ব্যাটার থাকায় বল হাতে সাকিবের প্রভাবও কমে এসেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার শক্তির জায়গা ফাস্ট বোলিং ও কন্ডিশন। বাংলাদেশের দুর্বলতার জায়গা গতি ও বাউন্স।’
সাকিব বাঁহাতি ব্যাটারদের ১৪ বল করে ৩১ রান হজম করেন। ডানহাতি ব্যাটারদের ৪ বল করে ২ রান দিয়ে একটি উইকেট নেন।
এই দু’জনের চেয়ে মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত বলা যায় খারাপ করেননি। প্রথম ওভারে তিন রান দেন। দু’ওভার বল করে দেন ১৬ রান।
মোসাদ্দেক মূলত জোরের ওপর বল করেন।
রাইলি রুশোকে ঠেকাতে না পারা
রাইলি রুশো আছেন দুর্দান্ত ফর্মে। ঠিক আগের ম্যাচেই তিনি ভারতের বিপক্ষে ৪৮ বলে ১০০ রান তুলেন অপরাজিত থেকে। আজ তিনি করেন ৫৬ বলে ১০৯।
সাতটি চার ও আটটি ছক্কা হাঁকান তিনি। বাংলাদেশের কোনো বোলারই ছাড় পায়নি। টেম্বা বাভুমা আউট হওয়ার পর মাঠে নামেন রুশো।
এ সময় অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট সাংবাদিক নিক স্যাভেজ টুইট করেন, ‘বাংলাদেশের তাসকিন আহমেদ বাভুমাকে দু’রানে আউট করার পর সিডনিতে বাংলাদেশের সমথর্কদের উল্লাস দেখছি। খেলনা বাঘ ছুড়ে ছুড়ে মারছেন তারা বাতাসে।’
কিন্তু বাভুমা গত সাত ম্যাচের একটিতেও ১০ রান করতে পারেননি।
বাভুমাকে আউট করে যেন বিপদই ডেকে আনেন তাসকিন, এটাই বুঝাতে চেয়েছেন নিক স্যাভেজ। তার ওপরে ১৪ ওভারে তাসকিনের বলে রাইলি রুশোর তুলে দেয়া ক্যাচ মিস করেন হাসান মাহমুদ।
জনপ্রিয় ক্রিকেট উপস্থাপক হারশা ভোগলে তার টুইটে রেখেন, ‘রাইলি রুশোর ইনিংসে শক্তি ও কর্তৃত্ব ছিল। সেঞ্চুরির পর তার আবেগময় একটা সেলিব্রেশন ছিল। এটা তিনি খুব করে চেয়েছিলেন।’
আনরিখ নরকীয়াকে কী বাংলাদেশের ব্যাটাররা ভয় পায়?
এখন এমন একটি প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। কারণ ঠিক এক বছর আগে বাংলাদেশের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ৮৪ রানে অলআউট হয়েছিল।
সেবার নরকীয়া নিয়েছেন আট রানে তিন উইকেট। এবারে নিয়েছেন তিনি ১০ রানে চার উইকেট। দু’ম্যাচ মিলিয়ে ১৮ রান দিয়ে সাত উইকেট নেন তিনি।
নরকীয়া বল হাতে নেয়ার আগে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ১২ বলে ২৬, কোনো উইকেট না হারিয়ে। তৃতীয় ওভারে বল হাতে নিয়ে ১ রান দিয়ে ২ উইকেট নিয়ে নেন।
হঠাতই বাংলাদেশের স্কোর দাঁড়ায় ২৭ রানে ২ উইকেট। এখান থেকে বাংলাদেশের জয়ের আর কোনো সম্ভাবনাই দেখা যায়নি গোটা ম্যাচে।
সূত্র : বিবিসি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।