মোঃ মাহামুদুল হাসান : উত্তরের জেলা নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার কৃষক আলমগীর কবির। তিনি সপ্তাহে দুইদিন নিকটস্থ হাটে তার উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিক্রি করেন। পণ্য বিক্রির টাকা হাটের ভিড়ে হারানোর ভয়ে তিনি তার বিকাশ (এমএফএস কোম্পানি) নাম্বারে ‘ক্যাশ-ইন’ করে রাখেন। এতে টাকা যেমন থাকে নিরাপদ তেমনি তিনি প্রয়োজন মতো করতে পারেন খরচও। ছেলে ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ছেলের পড়াশোনার টাকাও তিনি পাঠান বিকাশ অ্যাকাউন্টে জমানো টাকা থেকে।
ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় রিকশা চালান কাশেম মিয়া। কিন্তু তার পরিবার থাকে জামালপুর জেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। তিনি প্রত্যেক মাসে গ্রামের বাড়িতে না গেলেও পরিবারের খরচের টাকা ঠিকই চলে যায়। টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে তিনি ব্যবহার করেন এমএফএস কোম্পানি নগদের অ্যাকাউন্ট।
শুধু কি আলমগীর কবির এবং কাশেম মিয়া? বাংলাদেশের গ্রাম এবং শহরে যারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন তাদের প্রত্যেকেরই অন্তত একটি করে ডিজিটাল ওয়ালেট আছে। টাকা পাঠানো ছাড়াও নানান আর্থিক কাজে তারা এটি ব্যবহার করছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর করা জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ৯৮ শতাংশ পরিবারের কাছে কমপক্ষে একটি মোবাইল ফোন রয়েছে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ পরিবারের কাছে স্মার্টফোন রয়েছে। ২০২২ সালে এই হার ছিল ৫২ শতাংশ। শহর-গ্রাম উভয় জায়গাতেই স্মার্টফোনের ব্যবহার বাড়ছে; তবে গ্রাম এলাকার তুলনায় শহরে স্মার্টফোন ব্যবহারের প্রবণতা বেশি।
বাংলাদেশে মোবাইলে আর্থিক সেবা (এমএফএস) গ্রহীতার সংখ্যা ইতোমধ্যে ২৪ কোটি ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মোবাইলে আর্থিক লেনদেনের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে দেশে এমএফএস গ্রাহকের সংখ্যা ছিল ২৪ কোটি ৪ লাখ ৬৬ হাজার ৩৩৪। আগের মাস জানুয়ারি শেষে এমএফএস সংখ্যা ছিল ২৩ কোটি ৯৩ লাখ ২ হাজার ৯৯১। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ছিল ২৩ কোটি ৮৬ লাখ ৭৬ হাজার ১৫৩। নভেম্বরে ছিল ২৩ কোটি ৭৩ লাখ ১২ হাজার ৫১৫। এভাবে প্রতি মাসেই এমএফএস গ্রাহক সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ হিসাবে দেশে মোট জনসংখ্যা এখন ১৭ কোটি ৩৫ লাখ। প্রশ্ন জাগতে পারে, দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়ে এফএমএস গ্রাহক সংখ্যা কীভাবে বেশি হয়। এর উত্তর হচ্ছে- একজন গ্রাহক একাধিক এমএফএস সেবায় হিসাব খুলতে পারেন।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে ঠিক কত নাগরিক এমএফএসের আওতায় এসেছেন, তা বলা যাচ্ছে না। তবে প্রতিটি পরিবারেই সেবাটি পৌঁছে গেছে বলা যায়।
গত ছয় বছরে দেশে এমএফএস গ্রাহকের সংখ্যা সাড়ে তিন গুণের বেশি বেড়েছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে এমএফএস গ্রাহক ছিল ৬ কোটি ৭৬ লাখ ৭০ হাজার ৪৬৮। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্রাহক সংখ্যা ছিল ২২ কোটি ১৪ লাখ ৭৮ হাজার ৬২৫ জন।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, গত এক বছরেই প্রায় দুই কোটি এমএফএস গ্রাহক বেড়েছে।
গ্রাহক বৃদ্ধির পাশাপাশি মোবাইলে আর্থিক সেবার মাধ্যমে লেনদেনও বেড়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে এমএফএসে লেনদেন হয়েছে ১ লাখ ৬৪ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা। একক মাসের হিসাবে এই লেনদেন তৃতীয় সর্বোচ্চ।
আগের মাস জানুয়ারিতে লেনদেনের অঙ্ক ছিল এর চেয়ে একটু বেশি ১ লাখ ৭১ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা, যা ছিল অতীতের যেকোনো মাসের চেয়ে বেশি। তার আগের মাস গত বছরের ডিসেম্বরে ১ লাখ ৬৪ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, গত ছয় বছরে এমএফএসে লেনদেন বেড়েছে প্রায় ৪১৫ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে ব্যক্তিপর্যায়ের লেনদেন। এরপরে এগিয়ে রয়েছে বিভিন্ন মার্চেন্ট পেমেন্ট, বেতন পরিশোধ, পরিষেবা বিল, সরকারি ভাতা, টকটাইম ও প্রবাসীয় আয়সংক্রান্ত লেনদেন।
হাতে থাকা মোবাইল ফোনটিই এখন আর্থিক লেনদেনের বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে। যোগাযোগের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় আর্থিক লেনদেনে ব্যবহৃত হচ্ছে মুঠোফোন। বিকাশ, নগদ ও রকেটের মতো মোবাইলে আর্থিক সেবার (এমএফএস) মাধ্যমে প্রতিদিন এখন সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে।
এসব লেনদেনে অনেক সময় কারও সহায়তার প্রয়োজন হচ্ছে না। কারণ, গ্রাহক নিজেই নিজের হিসাবে টাকা জমা করে অন্যকে পাঠানোর পাশাপাশি কেনাকাটাও করতে পারেন। যেমন মুঠোফোনে রিচার্জ, বিভিন্ন কেনাকাটা, হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাওয়া-দাওয়া ও পরিষেবার বিল পরিশোধ, টিকিট ক্রয় ইত্যাদি। পাশাপাশি এখন অর্থ স্থানান্তর, প্রবাসী আয় গ্রহণ, সরকারি ভাতা ও বৃত্তি বিতরণ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বেতন-বোনাস প্রদান এবং ব্যবসায়িক লেনদেনের বড় মাধ্যম হয়ে উঠছে এসব সেবা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২২ সালের এপ্রিলে এসব সেবায় প্রথমবারের মতো লেনদেন এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এরপর ২০২৪ সালের মার্চে তা দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়ায়।
আর্থিক খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আনুষ্ঠানিক মাধ্যমের কারণে এসব লেনদেনের হিসাব থাকছে। কে কাকে কখন কত টাকা টাকা দিয়েছেন, সে তথ্য জমা থাকছে। ফলে দিন দিন অবৈধ অর্থায়ন কিংবা ঘুষের মতো অপরাধ কমাতে এসব সেবা বড় মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। আস্থা বাড়ায় এখন সাধারণ গ্রাহকদের লেনদেনের পাশাপাশি প্রবাসী আয় গ্রহণ ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের হিসাবেও ভালো লেনদেন হচ্ছে।
গ্রাহকসেবা দিতে সারা দেশে এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় সাড়ে ১৮ লাখ এজেন্ট রয়েছে।
এমএফএসে শীর্ষে রয়েছে বিকাশ। তাদের নিবন্ধিত গ্রাহক আট কোটি। বিকাশে দিনে লেনদেন হয় প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। এ সেবায় দ্বিতীয় অবস্থানে আছে নগদ। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দৈনিক লেনদেন হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এ সেবা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে চালু হলেও এখন শহরে বসবাসকারী নাগরিকেরাও এর বড় ব্যবহারকারী।
ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে এ সেবা এখন শুধু টাকা পাঠানো ও গ্রহণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বিল পরিশোধ, কেনাকাটা, মুঠোফোনে রিচার্জ, টাকা জমানো, ঋণ গ্রহণসহ নানা ধরনের লেনদেনে ব্যবহৃত হচ্ছে। উৎসবে-পার্বণে এসব সেবার ব্যবহার ১৫–২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়।
এমএফএস চালুর ফলে কম আয়ের মানুষ থেকে শুরু করে বড় করপোরেট ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান এবং শিল্পমালিকেরাও এর সুবিধা পেয়েছেন। এখন দেশের সব বড় ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য বিক্রির টাকা এ সেবার মাধ্যমে সংগ্রহ করছে, যেটাকে কালেকশন সেবা বলছে এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলো। আবার অনেক বড় শিল্পগোষ্ঠী তাদের শ্রমিকের বেতন দিচ্ছে এমএফএসের মাধ্যমে।
শুধু তাই নয় সরকারি ভাতা, বৃত্তি, কেনাকাটা, পরিষেবা বিল পরিশোধ- সবই করা যাচ্ছে এমএফসের মাধ্যমে। আবার ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ ও আদায় এবং বিদেশি সংস্থার তহবিল বিতরণও হচ্ছে এসব সেবার মাধ্যমে।
বাংলাদেশে মোবাইলের মাধ্যমে আর্থিক সেবার যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালের ৩১ মার্চ। বেসরকারি খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংক প্রথম এ সেবা চালু করে। পরে এটির নাম বদলে হয় রকেট। এরপর ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এমএফএস সেবা চালু করে বিকাশ। পরবর্তী সময়ে আরও অনেক ব্যাংক এ সেবায় এসেছে।
বর্তমানে বিকাশ, রকেটের পাশাপাশি মাই ক্যাশ, এম ক্যাশ, উপায়, শিওর ক্যাশসহ ১৫টি ব্যাংক এ সেবা দিচ্ছে। এর বাইরে ডাক বিভাগের নগদও দিচ্ছে এই সেবা।
২৪ জুন বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছে গুগলের ডিজিটাল সেবা গুগল ওয়ালেট। এই সেবা সাধারণভাবে ‘গুগল পে’ নামে পরিচিত। গুগল, মাস্টারকার্ড ও ভিসার সহযোগিতায় সিটি ব্যাংক পিএলসি এই ডিজিটাল লেনদেন সেবা চালু করেছে। এর মধ্য দিয়ে গ্রাহকের হাতে থাকা স্মার্টফোনই হয়ে উঠবে ডিজিটাল ওয়ালেট। ফলে গ্রাহককে আলাদা করে প্লাস্টিক কার্ড বহন করতে হবে না। আকাশপথে যাতায়াত থেকে শুরু করে কেনাকাটা কিংবা সিনেমা—সব লেনদেন মোবাইল ফোনে হবে।
অথচ দেড় দশক আগেও আর্থিক লেনদেন প্রক্রিয়া বেশ কঠিন ও ঝামেলাপূর্ণ ছিল। মানুষ সাধারণত নগদ টাকা সাথে রাখত, যা বহন করা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ছোটখাটো লেনদেনের জন্যও যেতে হতো ব্যাংকে, যা ছিল সময়সাপেক্ষ। চেক এবং পে-অর্ডারের মাধ্যমে লেনদেন করতে হতো। প্রত্যন্ত অঞ্চলে আর্থিক লেনদেন করা আরও কঠিন ছিল। কারণ সেখানে ব্যাংকের শাখা বা এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের সুযোগ ছিল না। মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) বা মোবাইল ব্যাংকিং আসার পর মানুষ ঝামেলাহীনভাবে যখন খুশি তখন লেনদেন করতে পারছেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।