ইভান লিডারেভ : ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার এই পতন ভারতের জন্য ‘কূটনৈতিক পরাজয়’ বলে মনে করছেন অনেকে। আর এতে চীন ‘কূটনৈতিকভাবে জিতে’ গেছে বলেও মনে করছেন এসব বিশ্লেষক। তবে, শেখ হাসিনার পতন চীনকে ভারতের চেয়ে বেশি সুবিধা দেবে বলে মনে হলেও, এ ব্যাপারে এত দ্রুত উপসংহারে আসার সুযোগ নেই।
এটা সত্য যে, বাংলাদেশের এ সংকট চীনকে ভারতের চেয়ে বেশি সুবিধা দেবে। এ ছাড়া প্রভাব বিস্তারের সুযোগও তৈরি হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে বেইজিং গুরুতর বাধার সম্মুখীন হতে পারে বলেই মনে হচ্ছে। আর এসব বাধা বাংলাদেশে চীনের প্রভাব বিস্তারকে ধীর করে দেবে এবং এই সুযোগকে কাজে লাগানো কঠিন করে তুলবে।
কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন নয়াদিল্লির জন্য একটি বড় ধাক্কা। কেননা এই বিক্ষোভে বিরোধী দলের সমর্থক ও ইসলামপন্থীরা ছিল। আর তাদের মধ্যে ভারতবিরোধী ঝোঁক প্রবলভাবে বিদ্যমান।
‘হাসিনার সরকার’ ছিল ভারতের জন্য একটি মূল্যবান কৌশলগত সম্পদ। দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে বলতে গেলে ২০২১ সালে প্রকাশিত যৌথ বিবৃতির দিকে তাকানো যেতে পারে। তাতে বলা হয়, দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক বেশ স্থিতিশীল এবং ‘সোনালী অধ্যায়’ পার করছে ঢাকা-দিল্লি। ১৫ বছরের মেয়াদে হাসিনা আন্তঃসীমান্ত জঙ্গিবাদ, বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানি কার্যকলাপ সম্পর্কে নয়াদিল্লির দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগের ব্যাপারে যাবতীয় তথ্য সরবরাহ করেন।
দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বাড়াতে বাংলাদেশের সঙ্গে এই সম্পর্ক ভারতের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে রেল চলাচলেরও সুযোগ পায় ভারত, যা তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ আরও সহজ করে দেয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এসব সুবিধা থমকে যায়।
একসময় দিল্লি ও বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করতে থাকে শেখ হাসিনা সরকার। তবে, ভারতের দিকেই ঝুঁকে ছিল বেশি। বাংলাদেশে বিভিন্ন চীনা প্রকল্প শুরু হলেও সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পটি চীনকে দেয়নি বাংলাদেশ। এর কারণ হিসেবে ভারতের চাপ ছিল বলেই মনে করা হয়।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন হয়ে যায় শেখ হাসিনার জন্য। তিস্তা নদী পুনরুদ্ধার ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য চীন প্রস্তাব দিয়ে রেখেছিল। একসময় ভারতও এতে অর্থায়নের প্রস্তাব দেয়। শেষমেশ শেখ হাসিনা ভারতকেই বেছে নেওয়ার কথা জানান। চীন সফরে যাওয়ার পর এ নিয়ে বেইজিং অসন্তোষও প্রকাশ করে বলে জানা যায়।
বাংলাদেশে নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেছে। এই অন্তর্বর্তী সরকার ভারতপন্থী নয় বলেই মনে করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে চীন বাংলাদেশ থেকে বাড়তি সুবিধা পেতে পারে। কেননা একদিকে পাকিস্তান ও আরেকদিকে মালদ্বীপ রয়েছে চীনের হাতে। এবার তারা বঙ্গোপসাগরেও প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
শেখ হাসিনার পতন থেকে কি শিক্ষা নেবে দক্ষিণ এশিয়ার স্বৈরশাসকেরা?শেখ হাসিনার পতন থেকে কি শিক্ষা নেবে দক্ষিণ এশিয়ার স্বৈরশাসকেরা?
তবে, এতে প্রভাব বিস্তার করতে বেশ জটিল সংকটে পড়তে হবে চীনকে। এর অন্যতম কারণ বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা। কোন দল ক্ষমতায় আসবে, তা এখনো বলা যাচ্ছে না। এমনকি এই সরকার কতদিন ক্ষমতায় থাকবে, তাও স্পষ্ট নয়। ব্যবসা ও প্রভাব বিস্তার করতে বাংলাদেশে একটি স্থিতিশীল সরকার দরকার বেইজিংয়ের। এ ছাড়া ইসলামিক বিভিন্ন দলের ব্যাপক উপস্থিতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিবিধি ঠিক করে দিলেও বেইজিংকে সংকটে পড়তে হবে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও এখন তেমন সুবিধাজনক নয়। এ কারণে এখানে প্রভাব বিস্তার করতে হলে আরও অনেক ঋণের প্রস্তাব দিতে হবে বেইজিংকে। আর এভাবে ঋণ দিলে ভবিষ্যতে কী হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তো রয়েছেই।
তবে, চীনের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হতে পারে আমেরিকা। কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকেই ছাত্রদের পক্ষে ছিল ওয়াশিংটন। এর আগেও হাসিনা সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমে ক্ষুব্ধ ছিল আমেরিকা। এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আমেরিকার বেশ ঘনিষ্ঠ। আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে আমেরিকাকে দরকার হবে বাংলাদেশের।
শেখ হাসিনাকে কি দেশে আনা যাবে, ভারতের সাথে চুক্তি কী বলছে?শেখ হাসিনাকে কি দেশে আনা যাবে, ভারতের সাথে চুক্তি কী বলছে?
আর প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে বাংলাদেশকে। কেননা ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন অর্থনৈতিক কার্যক্রমে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। সেক্ষেত্রে ভারত যদি দ্রুত বাংলাদেশের সঙ্গে আগের মতো স্থিতিশীল সম্পর্কে ফিরে যেতে পারে, তাহলে সুবিধা করতে পারবে না চীন।
অর্থাৎ, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, আমেরিকার প্রভাব ও ভারতের সঙ্গে সহজাত সম্পর্ক চীনকে দেশটিতে প্রভাব ফেলতে বাধা দেবে। সাম্প্রতিক বিপ্লবের কারণে হয়তো এবার বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে চীনকে বেশি গুরুত্ব দেবে। কিন্তু এতে চীনের খুব একটা সুবিধা হবে না।
লেখক: এশিয়ার নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশেষজ্ঞ। এ ছাড়া তিনি চীন-ভারত নিয়েও দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন।
নিবন্ধটি ইস্টএশিয়াফোরাম থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত ও সংক্ষেপিত।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।