জুমবাংলা ডেস্ক : চীজ খুবই পুষ্টিকর ডেয়রি পণ্য। শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধির জন্য চীজে রয়েছে প্রয়োজনীয় প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন ও মিনারেলস। বাজারে নানা রকম চীজ পাওয়া যায় যাদের মধ্যে চ্যাডার চীজ, মোজেরেলা চিজ, প্রসেসড চিজ, অষ্টগ্রাম বা ঢাকা চীজ খুবই জনপ্রিয়। প্রতিটি চীজের রয়েছে যেমন আলাদা স্বাদ, গন্ধ ও গঠন তেমনি রয়েছে আলাদা তৈরির প্রক্রিয়া।
বিভিন্ন রকম চীজ তৈরির পদ্ধতি ও গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা করেছেন- বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ডেয়রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আশিকুল ইসলাম ও তার গবেষক দল। গবেষক দলে রয়েছেন স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী মো. আল ইমাম, তাছরোভা সুলতানা, আল ইমরান, ফাইজা ফেরদৌস, রুবায়েত ফেরদৌস, আনিকা ইয়েসমিন, আফিয়া রহমান এবং স্নাতকের সাত জন শিক্ষর্থী। গবেষক দল ইতোমধ্যে মোজেরেলা চীজের ওপরে দুই ধরনের গবেষণা সম্পন্ন করেছে এবং অষ্টাগ্রাম, চ্যেডার ও প্রসেসড চীজের উপরে আরও গবেষণা চলমান রয়েছে।
নতুন পদ্ধতিতে অষ্টগ্রাম চীজ তৈরিতে উৎপাদন বৃদ্ধি:
অষ্টগ্রাম চীজ বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই তৈরি হয়ে আসছে। প্রচলিত পদ্ধতিতে অষ্টগ্রাম চীজ তৈরিতে ব্যবহার হয় গরুর পৌষ্টিকতন্ত্রের বিশেষ অংশ যেটা অঞ্চলিক ভাষায় ‘মাওয়া হিসেবে পরিচিত। মাওয়ার গুণগতমান গরুর বয়স ও খাবারের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্ক যুক্ত এবং এটি সহজলভ্য নয়। গরুর উপজাত ব্যবহার করায় সুস্বাদু ও পুষ্টিসম্পন্ন পণ্যটি অনেকে তাদের খাবারে অন্তর্ভূক্ত করে না। এ সমস্যা দূরীকরণে বাকৃবির গবেষক দল সফ্ট চীজ বা অষ্টগ্রাম চীজ তৈরিতে দুটি নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। সকল ধরনের ভোক্তা যেন খেতে পারে এমন উৎসের এনজাইমের সাথে বিশেষ ধরনের ফুড গ্রেড সল্ট ব্যবহার করে চীজ তৈরি করেছেন গবেষকরা। এর ফলে প্রচলিত পদ্ধতির থেকে বেশি চীজ তৈরি সম্ভব হচ্ছে। যেখানে প্রচলিত পদ্ধতিতে প্রতি দশ কেজিতে ৮শ থেকে ৯শ গ্রাম চীজ পাওয়া যেত সেখানে নতুন পদ্ধতিতে প্রায় ১৩শ গ্রাম চীজ উৎপাদন সম্ভব। এর ফলে চীজ উৎপাদনকারীরা বেশি লাভবান হবে। বর্তমানে নতুন পদ্ধতিতে উৎপাদিত অষ্টগ্রাম চীজে গুণগতমান উন্নয়নের কাজ চলমান।
বাংলাদেশে এই প্রথম চ্যেডার চীজ তৈরিতে সাফল্য:
হার্ড চীজ বা চ্যেডার চীজে অষ্টগ্রাম চীজের তুলনায় ময়েশ্চার বা পানির পরিমাণ কম থাকে। এই চীজে চল্লিশ শতাংশের কম পানি থাকে। প্রতি পাঁচ কেজি দুধ থেকে ৫শ থেকে ৬শ গ্রাম চ্যেডার চীজ তৈরি করা যায়। এই চীজের বিশেষ গুনাগুণও রয়েছে। নির্দিষ্ট পরিবেশে রেখে চীজটিকে রাইপেনিং করা হয়। এই চীজের যত বেশি বয়স হয় বা রাইপিনিং করা হয় তত বেশি দাম। রাইপিনিং এর সময় ব্যবহৃত অণুজীব প্রোটিন ও ফ্যাট ভেঙ্গে সরলতম পুষ্টিতে পরিণত করে। ফলে পুষ্টি উপাদানগুলো খুব সহজেই ক্ষুদ্রান্ত্রে শোষিত হয়। অন্য চীজের তুলনায় এই চীজটি ব্যবহারেও রয়েছে কিছুটা ভিন্নতা। সরাসরি খাওয়া যায় যে কোন কিছুর সাথে দিয়েই। অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আশিকুল ইসলাম বলেন, চ্যেডারিং নামক এক বিশেষ পদ্ধতিতে চীজটি তৈরি করা হয়। চীজ তৈরির শুরুতে কাক্সিক্ষত অণুজীব যোগকরা হয়। অণুজীবগুলো দুধের ল্যাকটোজ ভেঙে আম্লত্ব বৃদ্ধি করে যার ফলে চীজের স্বাদ বৃদ্ধি পায় ও চ্যেডারিং প্রক্রিয়ায় চীজের বিশেষ গঠন দেওয়া হয়।
মোজেরেলা চীজের পুষ্টিগুণ বৃদ্ধি:
মোজেরেলা চীজ তৈরির নতুন টেকনোলজি আবিষ্কার করেছে বাকৃবির ডেয়রি বিজ্ঞানীরা। বিভিন্ন ধরনের চীজের মধ্যে মোজেরেলা চীজের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। কিন্তু দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রজাতির (গরু, মহিষ ইত্যাদি) দুধ ব্যবহার করা হয়। সেই সাথে গবাদি প্রাণির খাদ্য ব্যবস্থাপনাও ভিন্ন হয়ে থাকে। প্রজাতি ও খাদ্যাভাস ভিন্নতার ফলে মোজেরেলা চীজের গুণগুতমানে প্রভাব ফেলে। এই চীজের গুণগুতমান নিয়ে দুটি গবেষণা সম্পন্ন করেছে গবেষক দলটি। অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আশিকুল ইসলাম বলেন, গবেষণায় দেখা যায় গরুর ও মহিষের দুধে মোজেরেলা চীজ তৈরি করা যায়। গুণগত ও মানদণ্ডে দুই রকমের দুধেই বেশ ভালো ফলাফল পেয়েছি। আবার খামারীরা বছর জুড়ে একই ধরনের আঁশ জাতীয় (কাঁচা ঘাস কিংবা খড়) পশুখাদ্য গবাদি প্রাণিকে সরবারহ করতে পারে না। আমাদের দেশে সর্বাধিক ব্যবহৃত চার ধরনের আশঁ জাতীয় পশুখাদ্য গাভীকে খাওয়ানোর পর সেই দুধ থেকে মোজেরেলা চীজ তৈরি করেছি। চার ধরনের আঁশ জাতীয় খাদ্য থেকে পাওয়া দুধের চীজের গুণমানও পরীক্ষা করে দেখেছি। এছাড়া যে ধরনের বৈশিষ্ট্যগুলো মোজেরেলা চীজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ায় সেসব বৈশিষ্ট্যগুলো খড়ের চেয়ে কাঁচা ঘাস খাওয়ানো হলে চীজে বেশি পাওয়া যায়। মোজেরেলা চীজ যা সেমি হার্ড চীজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। রেস্টুরেন্টগুলো কিংবা ফাস্টফুড দোকানগুলোতে খুবই জনপ্রিয় চীজটি।
প্রসেস্ড চীজ ও নানামুখী ব্যবহার:
প্রসেস্ড চীজ তৈরিতে পূর্বে প্রস্তুতকৃত চীজের সাথে দুধ, দই, ছানা, পানি, ক্রিম, বিভিন্ন মসলা-হার্বস ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। গবেষক দল দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের সবচেয়ে বড় ঘাটতি ডায়েটারি ফাইবার এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড যুক্ত চীজ তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছে। অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আশিকুল ইসলাম জানান, প্রসেসড চীজকে বাচ্চাদের খাবার উপযোগী করতে আমরা চকলেটের আকারে বা নাগেটস এর আকারে বা বিভিন্নভাবে খাবারের সাথে যোগ করে উপস্থাপন করতে পারি। এছাড়া এর মধ্যে স্প্রেডেবল বৈশিষ্ট্যও দেয়া সম্ভব। ফলে এটি মাখনের মত ব্রেড অথবা কুকিজের সাথে খাওয়া যেতে পারে। প্রসেসড চীজ নিয়ে আল ইমাম বলেন, এই চীজে সবসময় আকর্ষণীয় ফ্লেভার পাওয়া যায়। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এটি একটি আদর্শ খাদ্য। চীজ খেলে হৃদরোগ হবার ভয় থাকে না। গবেষণায় দেখা গেছে, চীজ খেলে অতিরিক্ত চিন্তা বা মানসিক চাপ কমে।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা:
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আশিকুল ইসলাম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে আমি চাই আমার ছাত্রদেরকে নতুন নতুন প্রযুক্তি শিক্ষা দিতে যেন গ্রাজুয়েটরা মাঠ পর্যায়ে দক্ষতার সাথে কাজ করতে পারে। অনেক খামারে- প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে দেশের বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞ আনা হয়। তাই আমাদের গ্রাজুয়েটদের এমন ভাবে তৈরি করতে চাই যেন বিশেষজ্ঞের চাহিদা স্থানীয়ভাবে মেটানো সম্ভব হয়।
তিনি আরও বলেন, খাদ্য উৎপাদনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব খামারী পর্যায়ে ডেয়রি পণ্য উৎপাদন করতে যেসব প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছে সেগুলো সমাধান করা। যারা খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে যুক্ত তাদের নৈতিক দায়িত্ব গ্রাহকদের কাছে পুষ্টিগুণাগুণ সম্পন্ন খাদ্য পৌঁছানো। একই সাথে খামারীদের জন্য লাভজনক করা যায় সে বিষয়ে গবেষণা করা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।