রিউমার স্ক্যানার প্রতিবেদন : প্রতিদিনই গুজব, ভিডিও চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে খবরের নামে। এতে সামাজিক বিশৃঙ্খলা, রাজনৈতিক উত্তেজনা ও উস্কানিমূলক তৎপরতা বেড়ে যাওয়ার শঙ্কাও বাড়ছে। ভারতীয় স্বনামধন্য ও প্রভাবশালী ইংরেজি ও বাংলা সংবাদমাধ্যমগুলো এসব গুজব কোনো রকম যাচাই বাছাই না করেই খবর হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছে। ইন্টারনেটের কল্যাণে তা ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের সর্বত্র। কি নেই এসব গুজবে। এমননিক শেখ হাসিনার মৃত্যু এমন গুজব যেমন ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তেমনি রয়েছে গণভবনে কনডম উদ্ধারের গুজব।
এসব গুজব যে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট বা উস্কানিমূলক তৎপরতা সৃষ্টি করে বিশৃঙ্খলা করার অপচেষ্টায় পরিকল্পিতভাবে করা হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রতিদিন রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে এসব গুজব ধরা পড়ে যেগুলো খবর হিসেবে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে বাংলাদেশে ভারতের পতাকা অবমাননার ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার পর পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা ভারত থেকে ছড়ানো হয়েছে।
হিন্দু নারীকে হত্যাচেষ্টার গুজব
সম্প্রতি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুইজন পুরুষ কর্তৃক তিনজন নারীকে মারধরের একটি ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হচ্ছে, উগ্র মুসলিম পুরুষ কর্তৃক প্রকাশ্যে হিন্দু নারী হত্যাচেষ্টার ভিডিও এটি। রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আলোচিত ভিডিওটি সাম্প্রতিক কোনো ঘটনার নয় বরং, এটি ২০২২ সালে জাম পাড়া এবং জমি সংক্রান্ত দীর্ঘদিনের বিরোধকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে সংঘটিত একটি মারধরের ঘটনার সময়ের ভিডিও। আর এ গুজবের ভিডিওটি বিশ্বাসযোগ্য করতে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রথম আলোর লোগো। ফ্যাক্টচেকে ঢাকা ট্রিবিউনের ওয়েবসাইটে ২০২২ সালের ০৩ জুন ‘চট্টগ্রামে জাম পাড়াকে কেন্দ্র করে তিন নারীকে মারধর, ভিডিও ভাইরাল’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি খুঁজে পাওয়া যায়।
আসিফ-নাহিদের নয়, রুটি বানানো
সম্প্রতি, অন্তর্বর্তী সরকারের ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া এবং তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের রুটি বানানোর দৃশ্য দাবিতে একটি ছবি গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রামে প্রচার করা হচ্ছে। ফ্যাক্টচেকে দেখা গেছে রুটি বানানোর ভাইরাল ছবিটি আসলে ভিন্ন দুই শিক্ষার্থীর। কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইফুদ্দিন আহমেদ রিফাত ও তার বন্ধু মো: সাইফুল্লাহ আল হাদীর এই ছবিটি ক্যাম্পাসের পাশে মেসে থাকাকালীন ২০২২ সালে ধারণকৃত।
শেখ হাসিনার মৃত্যুর গুজব
শেখ হাসিনা মারা গেছেন দাবিতে গত ০১ ডিসেম্বর সম্প্রতি শর্ট ভিডিও প্লাটফর্ম টিকটকে একটি ভিডিও প্রচার করা হয়েছে। এই প্রতিবেদন লেখা অবধি টিকটকে ভিডিওটি দেখা হয়েছে প্রায় ১ লক্ষ ৭০ হাজার বারেরও বেশি। এছাড়াও ভিডিওটিতে প্রায় ৩ হাজারেরও বেশি পৃথক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছে। পাশাপাশি ভিডিওটি ৯ শত বারের বেশি শেয়ার করা হয়েছে। ফ্যাক্টচেকে ধরা পড়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মারা যাননি বরং, কোনো তথ্য প্রমাণ ছাড়াই আলোচিত দাবিটি প্রচার করা হয়েছে।
ভিন্ন ব্যক্তিকে চিন্ময়ের আইনজীবী দাবি ভারতীয় গণমাধ্যমে
ইসকনের কলকাতা শাখার সহ-সভাপতি রাধারমণ দাস তার এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্ট থেকে একটি পোস্ট করেন। পোস্টে হাসপাতালে চিকিৎসারত এক আহত ব্যক্তির একটি ছবি যুক্ত করে তিনি দাবি করেন, ছবির আহত ব্যক্তির নাম রমেন রায়। তিনি চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী। মুসলিমরা রমেন রায়ের বাড়ি ভাঙচুর করেছে এবং তার ওপর হামলা করেছে। সে এখন আইসিইউতে আছেন। রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ছবির আহত ব্যক্তি তথা রমেন রায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী নন। অথচ উক্ত পোস্টকে সূত্র ধরে এধরনের সচিত্র গুজব খবর হিসেবে প্রচার করেছে এনডি টিভি, দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, জি ২৪ ঘন্টা, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, উইয়ন, ফিনানশিয়াল এক্সপ্রেস, রিপাবলিক ওয়াল্ড, নিউজ৯, টিভি৯, আজতাক, টাইমস নাউ নিউজ, ইন্ডিয়া টুডে, এবিপি লাইভ, হিন্দুস্তান টাইমস, লোকমাত টাইমস, পিটিসি নিউজ, ফ্রি প্রেস জার্নাল, ওয়ান ইন্ডিয়া, মাতৃভূমি, নিউজ এক্স, সিএনএন নিউজ ১৮, দ্য টাটভা, স্বরাজ্য, মিন্ট, নিউজ বাইটস, ভাইবস অফ ইন্ডিয়া এবং এইচডব্লিউ নিউজ। প্রকৃতপক্ষে, গত ২৫ নভেম্বর শাহবাগে চিন্ময়কে গ্রেফতারের প্রতিবাদে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কর্মসূচিতে দুর্বৃত্তদের হামলায় রমেন রায় আহত হন। তবে তার বাড়ি ভাঙচুরের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
ইউনূসের মেয়ে মনিকা নয়
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, এক্সসহ ইউটিউব ও টিকটকে এই ভিডিও ব্যাপকভাবে প্রচার করে দাবি করা হয়েছে, ভিডিওটিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মেয়ে মনিকা ইউনূসকে দেখা যাচ্ছে যিনি মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালাতে গিয়ে আটক হয়েছিলেন এবং তিনি একজন লেসবিয়ান বা সমকামী। একই দাবিতে উইকলি ব্লিটজের সম্পাদক সালাউদ্দিন শোহাইব চৌধুরীর এক্স পোস্ট ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। একই দাবিটি ভারতীয় ইউটিউব চ্যানেল বঙ্গটিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভারতের আইনজীবী নাজিয়া এলাহি খানকেও করতে দেখা গেছে। কিন্তু রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রচারিত ভিডিওটিতে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাতে গিয়ে আটক নারী মনিকা নামের ভিন্ন এক নারী। তার জন্ম নিউইয়র্কে এবং তিনি একজন পুয়ের্তো রিকান।
গণভবনে কনডম
সম্প্রতি, “গনভবনে কনডম ছিলো কেন?” শীর্ষক তথ্যে বা শিরোনামে শেখ হাসিনা, সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের ছবিসহ ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যম যমুনা টেলিভিশনের ডিজাইন সম্বলিত একটি ফটোকার্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, “গনভবনে কনডম ছিলো কেন?” শীর্ষক তথ্যে বা শিরোনামে যমুনা টেলিভিশন কোনো ফটোকার্ড বা সংবাদ প্রকাশ করেনি বরং, ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় সম্পাদনা করে যমুনা টেলিভিশনের ডিজাইন সম্বলিত আলোচিত ভুয়া ফটোকার্ডটি তৈরি করা হয়েছে।
হাসনাত আব্দুল্লাহর মৃত্যুর গুজব
গত ২৭ নভেম্বর চট্টগ্রাম থেকে ফেরার পথে লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের হাজীপাড়া এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমের বহরের একটি গাড়ি সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। এরই প্রেক্ষিতে ‘ট্রাক চাপায় নিহত হাসনাত আব্দুল্লাহ, গুরুতর আহত সারজিস’ শীর্ষক থাম্বনেইল এবং “ট্রাক চাপায় নিহত হাসনাত আব্দুল্লাহ, লাইফ সাপোর্টে সারজিস আলম” শীর্ষক শিরোনামে একটি ভিডিও প্রচার করা হয়েছে। ভিডিওটি ৬ হাজার বার দেখা হয়েছে। ভিডিওতে শতাধিক লাইক দেওয়া হয়েছে। রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, চটকদার শিরোনাম ও থাম্বনেইল ব্যবহার করে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই আলোচিত ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে।
ভারতীয় হাইকমিশনে হামলার আহ্বান জানাননি নুর
প্রথম আলোর ডিজাইন সম্বলিত একটি ফটোকার্ডে গণঅধিকার পরিষদের একাংশের নেতা নুরুল হক নুরের নামে ‘ভারত প্রসঙ্গে নুরুল হক নুর “আপনারাও ভারতীয় হাইকমিশনে হামলা করুন, এখন শুধু মারের বদলে মার হবে” শীর্ষক একটি মন্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হয়। রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, নুরুল হক নুর ভারতীয় হাইকমিশনে হামলা করার আহ্বান জানাননি এবং প্রথম আলোও উক্ত দাবিতে কোনো ফটোকার্ড প্রচার করেনি বরং প্রথম আলোর প্রচলিত ফটোকার্ডের ডিজাইন সম্পাদনার মাধ্যমে ভুয়া এই দাবি প্রচার করা হয়েছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।