জুমবাংলা ডেস্ক: শহুরে তস্কর রাত কেটে বহুদূর থেকে কাঁপাকাঁপা সুরে রাধারানীর আর্তনাদ ভেসে এলো আমার কাছে। ভ্রমরকে বিরহ ভরা চোখে মিনতির ডালা মেলে বলছে সে, কৃষ্ণকে বুঝাতে। তাকে না পেলে জীবনের মায়া ত্যাগ করবে।
ভ্রমর রে, কইয়ো কইয়ো কইয়োরে ভ্রমর,
কৃষ্ণরে বুঝাইয়া মুই রাধা মইরা যাইমু
কৃষ্ণ হারা হইয়ারে, ভ্রমর কইয়ো গিয়া।
কথার তালে বুঝতে পারলাম, হিন্দু পুরাণের রাধার এই মিনিতি আমাদের অধুনাবাদেও লালিত হচ্ছে সকল শ্রেণীর হৃদমাজারে। প্রতিনিয়ত নতুনত্বের পালক লাগছে কৃষ্ণের প্রতি রাধার। অন্যদিকে কৃষ্ণেরও কমকি, কটাক্ষের যমুনায় প্রেমের রেণু ফেলে সে সখীদের বলে, কলঙ্কিনী রাধা নাম ধরে বাঁশি বাজায়-
প্রাণ সখিরে
ঐ শোন কদম্বতলে বাঁশি বাজায় কে।
বাঁশি বাজায় কে রে সখি, বাঁশি বাজায় কে
এগো নাম ধরিয়া বাজায় বাঁশি, তারে আনিয়া দে।
অষ্ট আঙ্গুল বাঁশের বাঁশি, মধ্যে মধ্যে ছেদা
নাম ধরিয়া বাজায় বাঁশি, কলঙ্কিনী রাধা ॥
তাদের অমর প্রেমের মুগ্ধতায় মজে রাধারমণ দত্ত লেখেন-
জলের ঘাটে দেইখা আইলাম
কি সুন্দর শ্যাম ও রাই,
শ্যাম ও রাই, ভ্রমরায়
ঘুইরা ঘুইরা মধু খায়।
রাধারমণ দত্ত। লোকসংগীত পিপাসুদের কাছে নামটি খুবই পরিচিত। তিনি সাধক কবি, বৈঞ্চব বাউল, ধামালি নৃত্যের প্রবর্তক। কৃষ্ণ বিরহের আকুতি আর না-পাওয়ার ব্যথা কিংবা সব পেয়েও না-পাওয়ার কষ্ট রাধারমণকে সাধকে পরিণত করেছে। তিনি দেহতত্ত্ব, ভক্তিমূলক, অনুরাগ, প্রেম, ভজন, ধামাইলসহ নানা ধরনের কয়েক হাজার গান রচনা করেছেন।
লেখার শুরুতে যে গানতিনটি আপনারা পেয়েছেন তা মূলতো ধামাইল গান। ‘ধামা’ শব্দটি থেকে ‘ধামাইল’ শব্দটির উৎপত্তি; এর অর্থ আবেশ, ভাব। আঞ্চলিক অর্থ উঠোন। ধারণা করা হয়, রাধারমণ দত্ত ভাবুক প্রকৃতির হওয়ায় এই জাতীয় নামের উৎপত্তি হয়েছে। আবার অনেকের মতে, বাড়ীর উঠোনে এই গান-নাচের আয়োজন করা হয় বলে একে ‘ধামাইল গান-নাচ’ বলে। এটাকে নারীদেরও গান বলা হয়।
এই গান-নাচ বাংলাদেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার অঞ্চলের লোকসংগীত হিসেবেই পরিচিত। এছাড়াও ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, কুমিল্লা, নেত্রকোণা, ময়মনসিংহ জেলার কিছু অংশে এবং ভারতের ত্রিপুরা, করিমগঞ্জ, কাছাড়, আসাম, হাইলাকান্দি, শিলচর এলাকায় ধামাইল গানের প্রচলন রয়েছে।
রাধারমণ আর প্রতাপ ছাড়াও ধামাইলগানের গীতিকারদের মধ্যে মধুসূদন দাস, যতীন্দ্রমোহন রায় তালুকদার, সূর্যকান্ত বিশ্বাস, রুক্ষ্মিণী, চিত্রাঙ্গন মাস্টার, ভরত চন্দ্র সরকার, জীতেন্দ্র, নবকুমার, সন্ধ্যা রানী চন্দ, শিখা রানী দাস, রামজয় সরকার, শ্যামসুন্দর, মহেন্দ্র গোঁসাই, দুর্গাপ্রসাদ, মুকুল ঠাকুর প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এঁরা ছাড়াও অন্তত কয়েক শ গীতিকারের নাম উল্লেখ করা সম্ভব, যাদের রচিত ধামাইলগান নারীরা পরিবেশন করে থাকেন।
ধামাইল গান মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিয়ে উপলক্ষে আয়োজন করা হয়। এর বাইরে সাধভক্ষণ, অন্নপ্রশানসহ বিভিন্ন হিন্দু-ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও এ গানের পরিবেশনা দেখা যায়। মধ্যযুগের সাহিত্যে ‘ধামালী’ শব্দের ব্যবহার লক্ষ করা গেলেও রাধারমণের হাত ধরেই নৃত্যগীত হিসেবে ‘ধামাইল গান’ উদ্ভব হয়।
ধামাইল গানের মধ্যে আবার বিভিন্ন পর্ব রয়েছে, যেমন–বন্দনা, আসর, বাঁশি, জলভরা, গৌররূপ, শ্যামরূপ, বিচ্ছেদ, কোকিল সংবাদ, কুঞ্জ সাজানো, স্বপন, চন্দ্রার কুঞ্জ, মান ভাঙানো, মিলন, সাক্ষাৎ খেদ, বিদায় প্রভৃতি।
এই গান সমবেত সংগীত আকারে পরিবেশন করা হয়ে থাকে। শিল্পীরা চক্রাকারে নৃত্যের আঙ্গিকে ঘুরে ছন্দময় করতালির মাধ্যমে গেয়ে থাকেন। গানের সময় কোনো প্রকারের বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার না করলেও বর্তমান সময়ে কিছু কিছু জায়গায় ঢোল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে বাদ্যযন্ত্র মুখ্য বিষয় নয়। ধামাইল শিল্পীরা তাদের ছন্দময় করতালির মাধ্যমে সুর, তাল ও লয়ের সমন্বয় করে থাকেন। আবার এই গানের গায়নরীতিও অন্য গানের চেয়ে আলাদা। গানের শেষে লম্বা টানের রেশ পরিলক্ষিত হয়।
‘কারে দেখাব মনের দুঃখ’, ‘কলঙ্কিনী রাধা’, ‘আমারে আসিবার কথা কইয়া’, ‘আমার বন্ধু দয়াময়’, ‘আমি রব না রব না গৃহে’, ‘পালিতে পালিছিলাম পাখি দুধ-কলা দিয়া’, ‘শ্যাম কালিয়া প্রাণ বন্ধুরে’, ‘মনে নাই গো আমারে বন্ধুয়ার মনে নাই’, ‘বংশী বাজায় কে গো সখী’, ‘আমার গলার হার’, ‘বিনোদিনী গো তোর’, ‘দেহতরী ছাইড়া দিলাম’, ‘কার লাগিয়া গাঁথো রে সখী’ প্রভৃতি গান ছাড়াও বৃহত্তর সিলেট, আসাম, শিলিগুড়ি অঞ্চলে ধামাইল গানগুলো আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
ধামাইল গানের গতি ক- বন্দনা, খ- আহ্বান বা আসরস্তুতি, গ- উদয়, ঘ- বাঁশি, ঙ- জলভরা, চ- শ্যামরূপ, ছ- গৌররূপ, জ- আক্ষেপ, ঝ- বিচ্ছেদ, ঞ- কুঞ্জ, ট- মানভঞ্জন, ঠ- মিলন, ড- সাক্ষাৎ এবং ঢ- বিদায় ছন্দে এগিয়ে যায়। অদ্ভুত সুন্দর এক ব্যঞ্জনায় ধামাইল গান আর নৃত্য দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধতার আবেশে আচ্ছন্ন করে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।