রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে একটানা কান্নার শব্দ। চোখে ঘুম, মাথায় যন্ত্রণা, হৃদয়ে অস্থিরতা নিয়ে ছোট্ট সোনামণির দিকে তাকিয়ে থাকা এক মায়ের অসহায়ত্ব। বুকের ভেতর ক্লান্তির ভার আর চোখের নিচে কালো দাগ – শিশুর ঘুম না আসা শুধু তার জন্য নয়, গোটা পরিবারের জন্য এক দুঃস্বপ্ন। “আর কত রাত জেগে কাটাব?” – এই প্রশ্নটি বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মা-বাবার রাতের সঙ্গী। কিন্তু হতাশ হবেন না, এই যুদ্ধে আপনি একা নন। শৈশবের এই ঘুমের লড়াই জয়ের কার্যকরী, গবেষণাভিত্তিক ও মানবিক পথ রয়েছে। আজ জানবো বাচ্চাদের ঘুম না হলে করণীয় নিয়ে সেই সব জরুরি টিপস, যা শুধু বইয়ের পাতায় নয়, বাস্তব জীবনের ঘরোয়া অভিজ্ঞতা আর চিকিৎসা বিজ্ঞানের আলোকে প্রমাণিত।
শিশুর ঘুম না আসার যত কারণ: বাবা-মায়ের যা জানা জরুরি
শিশু কেন ঘুমাতে চায় না? এই প্রশ্নের উত্তরই সমাধানের প্রথম ধাপ। বাচ্চাদের ঘুম না হলে করণীয় খুঁজতে গেলে আগে বুঝতে হবে ‘কেন’। কারণগুলো শারীরিক, মানসিক, পরিবেশগত বা দৈনন্দিন অভ্যাসের জটিল সমন্বয় হতে পারে।
শারীরিক অস্বস্তি ও স্বাস্থ্য সমস্যা: নবজাতক বা ছোট শিশুরা কথা বলতে পারে না। তাদের অস্বস্তি প্রকাশের মাধ্যমই কান্না আর ঘুমের অসুবিধা।
- পেটের সমস্যা: কোলিক (Colic), গ্যাস, রিফ্লাক্স (GERD), কোষ্ঠকাঠিন্য বা ক্ষুধা। বাংলাদেশে নবজাতকদের মধ্যে কোলিক খুবই সাধারণ, যা সাধারণত সন্ধ্যার পর শুরু হয় এবং দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হতে পারে (সূত্র: বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ)।
- দাঁত ওঠা: মাড়ি ফুলে যাওয়া, ব্যথা ও জ্বালাপোড়া ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। প্রায় ৬ মাস বয়স থেকে শুরু হয় এই যাত্রা।
- জ্বর, সর্দি-কাশি, কানপাকা: অসুস্থতা ঘুমের সবচেয়ে বড় শত্রু। কানে ব্যথা (Otitis Media) অনেক শিশুর ঘুম ভাঙার অন্যতম কারণ।
- ত্বকের সমস্যা: একজিমা, ফুসকুড়ি, ঘামাচি, কাপড়ের ট্যাগ বা সেলাইয়ের কারণে চুলকানি বা অস্বস্তি।
- পুষ্টির ঘাটতি: আয়রন বা ভিটামিন ডি-এর অভাব (যা বাংলাদেশে কিছুটা সাধারণ) শিশুকে অস্থির ও ক্লান্ত করে তুলতে পারে, তবু ঘুম আসতে বাধা দেয়। (সূত্র: জাতীয় পুষ্টি পরিষেবা, বাংলাদেশ)।
মানসিক ও বিকাশগত কারণ:
- বিচ্ছেদ উদ্বেগ (Separation Anxiety): সাধারণত ৬ মাস থেকে ১৮ মাস বয়সে তীব্র হয়। মা-বাবাকে না দেখলে বা আলাদা বিছানায় শোয়ালে প্রচণ্ড ভয় ও কান্না।
- উন্নয়নমূলক মাইলস্টোন: হামাগুড়ি দেওয়া, হাঁটা, কথা বলা শেখা – এসব নতুন দক্ষতা অর্জনের উত্তেজনা মাথায় ঘুরতে থাকে, ঘুম তাড়িয়ে দেয়।
- ভয় ও দুঃস্বপ্ন: বড় শিশুরা অন্ধকার, কাল্পনিক দানব, বা দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পেতে পারে। টিভি বা মোবাইলে দেখা ভয়ানক দৃশ্য এর জন্য দায়ী হতে পারে।
- অতিরিক্ত উদ্দীপনা: সারাদিনের হৈচৈ, অতিরিক্ত খেলাধুলা, নতুন জায়গায় যাওয়া, অতিথি আপ্যায়ন – এসব শিশুর মস্তিষ্ককে অতিরিক্ত সক্রিয় করে রাখে, শান্ত হতে সময় লাগে।
- পরিবেশ ও অভ্যাসগত কারণ (যেগুলো সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়):
- অনিয়মিত ঘুমের রুটিন: প্রতিদিন একই সময়ে না ঘুমানো বা না ঘুম থেকে ওঠা।
- অনুপযুক্ত ঘুমের পরিবেশ: অতিরিক্ত আলো, শব্দ, গরম বা ঠান্ডা ঘর, অস্বস্তিকর বিছানা বা কাপড়।
- ঘুমানোর আগে স্ক্রিন টাইম: মোবাইল, ট্যাব, টিভির নীল আলো মেলাটনিন (ঘুমের হরমোন) উৎপাদনে বাধা দেয়। (সূত্র: আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিক্স)।
- দিনের বেলা পর্যাপ্ত ন্যাপ না নেওয়া বা অতিরিক্ত ন্যাপ নেওয়া: ক্লান্ত শিশুও ঘুমাতে অসুবিধা করতে পারে (“ওভারটায়ার্ড”)।
- ঘুমের সাথে নেগেটিভ অ্যাসোসিয়েশন: শিশু যদি শুধুমাত্র কোলে করে দোলানো, গাড়িতে চড়ানো, স্তন্যপান করানো বা হাত ধরে থাকার মাধ্যমেই ঘুমানোর অভ্যস্ত হয়, তাহলে রাতে ঘুম ভাঙলে সে আবার সেই একই শর্ত চাইবে।
- খাদ্যাভ্যাস: ঘুমানোর আগে ভারী খাবার, চিনি বা ক্যাফেইনযুক্ত খাবার/পানীয় (চকলেট, কোলা, কিছু চা)।
বিশেষজ্ঞের কণ্ঠস্বর: ঢাকা শিশু হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. ফারহানা রহমান বলেন, “বাচ্চাদের ঘুম না আসার ৮০% কারণই পরিবেশগত ও অভ্যাসগত। অনেক অভিভাবকই বুঝতে পারেন না, রাতের কান্নায় সাড়া দেওয়ার ধরন বা দিনের ছোট ছোট অভ্যাসই ঘুমের সমস্যাকে দীর্ঘস্থায়ী করছে। প্রথমেই শারীরিক অসুস্থতা বাদ দিতে হবে, তারপর ধৈর্য ধরে ঘুমের স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।”
ঘুমন্ত শিশুর জন্য স্বর্গরাজ্য: ঘরের পরিবেশ ও রুটিন গড়ে তোলার বিজ্ঞান
বাচ্চাদের ঘুম না হলে করণীয় এর সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হল একটি সুসংগত রুটিন এবং ঘুমবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা। এগুলো জাদুর মতো কাজ করে, তবে একদিনে ফল পাবেন না। ধৈর্য ও সামঞ্জস্যতা এখানে চাবিকাঠি।
ঘুমের পবিত্র রুটিন: প্রতিদিন একই ছন্দ (Sleep Routine is King):
- নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করুন: প্রতিদিন একই সময়ে (সন্ধ্যা ৭-৮টার মধ্যে আদর্শ) বিছানায় যাওয়া এবং সকালে একই সময়ে ওঠার চেষ্টা করুন। সপ্তাহান্তেও এই রুটিন যথাসম্ভব বজায় রাখুন।
- শান্তিপূর্ণ রুটিন তৈরি করুন (৩০-৬০ মিনিট): এটি ঘুমের সংকেত হিসেবে কাজ করবে। ক্রমাগত একই ধারা বজায় রাখুন। উদাহরণ:
- হালকা গরম পানিতে গোসল (শরীরের তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে)।
- নরম আলোয় মালিশ (বেবি অয়েল বা লোশন দিয়ে)।
- পায়জামা পরানো।
- দাঁত ব্রাশ করা (বড় শিশুদের জন্য)।
- একই বই পড়া বা একই গান গাওয়া/শোনা (নিচু, মৃদু স্বরে)।
- আলিঙ্গন করা, চুমু দেওয়া, শুভ রাত্রি বলা।
- রুটিন সংক্ষিপ্ত ও শান্ত রাখুন: উত্তেজক খেলা, টিকটক ভিডিও দেখা বা জোর করে খাওয়ানো এড়িয়ে চলুন। লক্ষ্য মস্তিষ্ক ও শরীরকে শান্ত করা।
ঘুমের আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি:
- অন্ধকার: ঘর যতটা সম্ভব অন্ধকার করুন। ব্ল্যাকআউট কার্টেন ব্যবহার করুন। নবজাতক বা ছোট শিশুর জন্য খুব নরম, লাল বা কমলা বাতি ব্যবহার করতে পারেন (যা মেলাটনিন উৎপাদনে কম বাধা দেয়)। ঢাকার মতো শহরে রাস্তার আলো ঘরে ঢুকলে ব্ল্যাকআউট কার্টেন অপরিহার্য।
- শব্দহীনতা: যতটা সম্ভব শব্দ কমান। ফ্যান বা হোয়াইট নয়েজ মেশিনের শব্দ (যেমন: বৃষ্টির শব্দ, সমুদ্রের ঢেউ) অন্যান্য আকস্মিক শব্দ (গাড়ির হর্ন, কুকুরের ঘেউঘেউ) ঢেকে দিতে সাহায্য করে। বাংলাদেশের ব্যস্ত পরিবেশে হোয়াইট নয়েজ খুবই কার্যকরী হতে পারে।
- আদর্শ তাপমাত্রা: খুব গরম বা খুব ঠান্ডা নয়। সাধারণত ২০-২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৬৮-৭২ ডিগ্রি ফারেনহাইট) আরামদায়ক। শিশুকে হালকা, নরম, শ্বাস-প্রশ্বাসের সুবিধাযুক্ত (কটন) কাপড়ে ঢেকে দিন। অতিরিক্ত কাঁথা বা কাপড়ে জড়ানো বিপজ্জনক হতে পারে। ঢাকার গ্রীষ্মে এসি বা ফ্যান ব্যবহার নিশ্চিত করুন ঘর ঠান্ডা রাখতে।
- নিরাপদ ও আরামদায়ক বিছানা: ফার্ম ম্যাট্রেস, শক্ত সমতল পৃষ্ঠ (শিশুর জন্য), ফিটফাট চাদর। বিছানায় নরম খেলনা, বালিশ (১ বছরের কম বয়সী শিশুর জন্য না), বা আলগা কাঁথা রাখবেন না (SIDS-এর ঝুঁকি বাড়ায়)।
- শুধুমাত্র ঘুমের জায়গা: শিশুর বিছানা শুধুমাত্র ঘুমানোর জন্যই ব্যবহার করুন। খেলাধুলা বা শাস্তি দেওয়ার স্থান হিসেবে নয়। এতে বিছানার সাথে ঘুমের ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
- দিনের বেলার ঘুম (ন্যাপ) সুবিন্যস্ত করুন:
বয়স অনুযায়ী ন্যাপ: নবজাতক দিনে ১৬-১৮ ঘণ্টা ঘুমায় (ছোট ছোট ভাগে)। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ন্যাপের সংখ্যা কমে যায়। সাধারণ গাইডলাইন: বয়স (মাস) মোট ঘুম (২৪ ঘণ্টায়) রাতের ঘুম দিনের ন্যাপ (সংখ্যা) 0-3 14-17 ঘণ্টা 8-9 ঘণ্টা 3-5 (কম সময়ের) 4-11 12-15 ঘণ্টা 9-10 ঘণ্টা 2-3 1-2 বছর 11-14 ঘণ্টা 10-11 ঘণ্টা 1-2 3-5 বছর 10-13 ঘণ্টা 10-11 ঘণ্টা 1 (বা কিছুটা বিকেলে বিশ্রাম) - বিকালের ন্যাপ সকালের দিকে: শেষ ন্যাপটি যেন বিকাল ৩-৪টার পরে না শেষ হয়। দেরি করে ন্যাপ নিলে রাতের ঘুমের উপর প্রভাব পড়ে।
- ন্যাপেরও রুটিন: দিনের বেলার ঘুমের জন্যও একটি ছোট রুটিন (গান গাওয়া, বই পড়া, আলিঙ্গন) অনুসরণ করুন।
রাত জেগে কান্না: তখন কী করবেন?
বাচ্চাদের ঘুম না হলে করণীয় এর সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা হল মধ্যরাতের কান্না সামাল দেওয়া। এখানে ধৈর্য, নমনীয়তা ও কিছু কৌশল প্রয়োজন।
- পাঁচ সেকেন্ডের পজ: কান্নার শব্দ শুনে সাথে সাথে দৌঁড়ে না গিয়ে ৫-১০ সেকেন্ড অপেক্ষা করুন। অনেক সময় শিশুরা হালকা ঘুমের মধ্যেও কেঁদে ওঠে এবং নিজে থেকেই আবার ঘুমিয়ে পড়ে। তড়িঘড়ি করে সাড়া দিলে আপনি তাকে পুরোপুরি জাগিয়ে দিতে পারেন।
- শারীরিক অস্বস্তি দূর করুন: যদি কান্না থামে না, তাহলে শান্তভাবে ঘরে যান। প্রথমে শারীরিক কারণ খুঁজে দেখুন:
- ডায়াপার ভিজেছে? বদলে দিন (নরম আলোতে, কম কথা বলে)।
- ক্ষুধার্ত? নবজাতক বা ছোট শিশুকে দুধ খাওয়ান (কিন্তু বড় শিশুদের ক্ষেত্রে ঘুমের সাথে খাওয়াকে সংযুক্ত করবেন না)।
- পেটে গ্যাস? পিঠে আলতো করে চাপড় দিন বা পা সাইকেল চালানোর মতো নাড়ুন।
- খুব গরম/ঠান্ডা? শরীর স্পর্শ করে দেখুন। কাপড় ঠিক করুন।
- নাক বন্ধ? স্যালাইন ড্রপ ও বাল্ব সিরিঞ্জ ব্যবহার করুন (ডাক্তারের পরামর্শে)।
- সান্ত্বনা দেওয়ার কৌশল (কম থেকে কমতর): শারীরিক অস্বস্তি না থাকলে, শান্তভাবে সান্ত্বনা দিন। লক্ষ্য হল তাকে আবার ঘুম পাড়ানো, কিন্তু একই সাথে তাকে নিজে থেকে ঘুমিয়ে পড়ার সুযোগ দেওয়া।
- শব্দ দিয়ে সান্ত্বনা: ঘর থেকে বের হওয়ার আগে শান্ত, মৃদু স্বরে বলুন, “শুয়ে থাকো বাবা/মা, মা এখানেই আছি।” বারবার বলতে থাকুন যতক্ষণ না সে শান্ত হয় (একে ‘ভয়েস চেকিং’ বলে)। অনেক শিশু শুধু কণ্ঠস্বর শুনেই শান্ত হয়।
- স্পর্শ দিয়ে সান্ত্বনা: যদি শব্দে কাজ না হয়, ঘরে ঢুকে তার পিঠে বা বুকে হাত রাখুন, আলতো করে চাপড় দিন। কথা বলবেন না, চোখে চোখ রাখবেন না। শুধু উপস্থিতি জানান।
- কোলে তোলা (শেষ অবলম্বন): যদি তাতেও না থামে, আলতো করে কোলে তুলে নিন, শান্ত করুন (কাঁধে মাথা রেখে পিঠে আলতো চাপড়), কিন্তু ঘুমিয়ে পড়ার আগেই আবার বিছানায় নামিয়ে দিন। লক্ষ্য হল তাকে জাগ্রত অবস্থায় বিছানায় রাখা, যাতে সে নিজে থেকে ঘুমিয়ে পড়তে শেখে। কোলে করে ঘুম পাড়ানো এড়িয়ে চলুন।
- ধৈর্য ধরুন ও সামঞ্জস্য বজায় রাখুন: এই পদ্ধতিগুলো কাজ করতে কিছু সময় লাগে (দিন বা সপ্তাহ)। একরাতে এক পদ্ধতি, আরেক রাতে অন্য পদ্ধতি ব্যবহার করলে শিশু confused হয়ে যায়। একই পদ্ধতি ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যান। প্রথম কয়েক রাত কঠিন হবে, তারপর ধীরে ধীরে উন্নতি হবে।
- নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিন: রাতের পর রাত জেগে থাকা ক্লান্তিকর ও হতাশাজনক। সঙ্গীর সাথে পালা করে নিন। দিনের বেলায় শিশু ঘুমালে আপনিও একটু বিশ্রাম নিন। সাহায্য চাইতে লজ্জা নেই – পরিবার, বন্ধুর সাহায্য নিন।
বয়সভিত্তিক কৌশল: নবজাতক থেকে প্রি-স্কুলার
বাচ্চাদের ঘুম না হলে করণীয় বয়সভিত্তিকভাবে কিছুটা ভিন্ন। এখানে বয়স অনুযায়ী টিপস:
- নবজাতক (০-৩ মাস):
- প্রত্যাশা: ঘুম অনিয়মিত, ছোট ছোট ভাগে (২-৪ ঘণ্টা)। দিন-রাতের বিভ্রান্তি থাকতে পারে।
- করণীয়:
- দিনের বেলা ঘর আলোকিত ও স্বাভাবিক শব্দে রাখুন। রাতে অন্ধকার ও শান্ত করুন।
- জাগ্রত অবস্থায়ই বিছানায় শুইয়ে দিন (যদিও ঘুমাবে না, অভ্যাস তৈরি হবে)।
- কান্নায় দ্রুত সাড়া দিন (ক্ষুধা, ডায়াপার, অস্বস্তি)।
- কোলে শোয়ানোর অভ্যাস এড়ানোর চেষ্টা করুন। “এই বয়সে ঘুমের ট্রেনিং শুরু হয় না, শুধু নিরাপদ ঘুমের অভ্যাস গড়ে তোলা যায়,” বলে জানান চাইল্ড সাইকোলজিস্ট ডা. তাহমিনা আক্তার।
- ৪-১১ মাস:
- প্রত্যাশা: রাতের ঘুম দীর্ঘায়িত হতে শুরু করে (৬-৮ ঘণ্টা), ন্যাপ সংখ্যা কমে। বিচ্ছেদ উদ্বেগ শুরু হতে পারে (৬ মাস থেকে)।
- করণীয়:
- শক্তিশালী ঘুমের রুটিন শুরু করুন।
- নিজে নিজে ঘুমিয়ে পড়ার দক্ষতা শেখানো শুরু করুন (উপরে বর্ণিত সান্ত্বনার ধাপগুলো অনুসরণ করে)।
- বিচ্ছেদ উদ্বেগের সময় রুটিনে আরও বেশি স্নেহ ও আশ্বাস যোগ করুন, কিন্তু ঘুমানোর পদ্ধতি একই রাখুন।
- রাতের দুধ খাওয়ানো ধীরে ধীরে কমিয়ে আনুন/বন্ধ করুন (ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে)।
- ১-২ বছর (টডলার):
- প্রত্যাশা: সাধারণত ১টি ন্যাপ (দুপুরে), রাতে ১০-১১ ঘণ্টা ঘুম। স্বাধীনতা চর্চা, বিছানা থেকে উঠে আসার চেষ্টা, দুঃস্বপ্ন শুরু হতে পারে।
- করণীয়:
- ঘুমের রুটিনে শিশুকেও কিছু ছোট ছোট পছন্দের সুযোগ দিন (“কোন বইটা পড়বো?”, “কোন পাজামা পরবো?”)।
- বিছানা থেকে বারবার ওঠা রোধে দরজায় সেফটি গেট লাগান, শান্তভাবে বারবার তাকে বিছানায় ফেরত দিন (কথা কম বলে, কাজ করে)।
- দুঃস্বপ্নের পর সান্ত্বনা দিন, তার ভয়কে গুরুত্ব দিন, তবে তাকে নিজের বিছানায় ফিরিয়ে নিন।
- বিছানা ছেড়ে আসার জন্য একটি “বেডটাইম পাস” (একটি বিশেষ কার্ড) দিতে পারেন, যেটা সে রাতে শুধু একবার ব্যবহার করতে পারবে (পানি খেতে বা একবার জড়িয়ে ধরতে)।
- ৩-৫ বছর (প্রি-স্কুলার):
- প্রত্যাশা: ১০-১৩ ঘণ্টা ঘুম (রাত + সম্ভাব্য ছোট ন্যাপ/বিশ্রাম)। ভয়, দুঃস্বপ্ন, স্টলিং ট্যাকটিক্স (পানি চাওয়া, আরেকটা গল্প চাওয়া) বেশি দেখা যায়।
- করণীয়:
- ঘুমের রুটিনে আরও বেশি কথা বলুন, তার দিনের কথা শুনুন, ভয় দূর করতে সাহায্য করুন।
- স্টলিং ট্যাকটিক্স সামাল দিন সীমা নির্ধারণ করে (“শুধু এক গ্লাস পানি”, “শুধু একটা গল্প”) এবং রুটিন শেষ হওয়ার পর আরও আলোচনা না করে।
- “স্লিপ ট্রেনার” বা ছোট্ট নাইট লাইট ব্যবহার করুন যা সে নিজে চালু-বন্ধ করতে পারে।
- দুঃস্বপ্নের জন্য “ভালো স্বপ্ন স্প্রে” (সাধারণ পানির বোতল) বা “মনিব্যাগের রক্ষাকর্তা” (একটি পছন্দের খেলনা) এর মতো কল্পনাপ্রসূত সমাধান তৈরি করুন।
কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন?
বেশিরভাগ ঘুমের সমস্যাই পরিবেশ ও অভ্যাস পরিবর্তনে সমাধান হয়। তবে কিছু লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে:
- শিশু খুব জোরে নাক ডাকে বা ঘুমের মধ্যে শ্বাস নিতে কষ্ট হয় (Sleep Apnea-র লক্ষণ)।
- ঘুমের মধ্যে বারবার জেগে ওঠা, সাথে প্রচণ্ড কান্না বা ভয়, এবং জাগরণের পর কিছু মনে করতে না পারা (Night Terrors)।
- ঘুমের মধ্যে হাঁটা (Sleepwalking) বা কথা বলা, যা নিয়মিত ও সমস্যাজনক মাত্রায় হয়।
- দিনের বেলা অতিরিক্ত ঘুম ঘুম ভাব, মনোযোগ দিতে অসুবিধা, আচরণগত সমস্যা (খিটখিটে মেজাজ, আক্রমণাত্মকতা) যা ঘুমের অভাবের কারণে বলে মনে হয়।
- শিশুর ওজন বাড়ছে না, বিকাশ ঠিকমতো হচ্ছে না বলে সন্দেহ হলে।
- আপনি মনে করেন তার কোনো শারীরিক ব্যথা বা অসুস্থতা (কানপাকা, রিফ্লাক্স) আছে।
- আপনার নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়লে।
গুরুত্বপূর্ণ লিঙ্ক:
- জাতীয় পুষ্টি পরিষেবা, বাংলাদেশ – শিশু স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নির্দেশিকা
- বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ
- আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিক্স – শিশুদের ঘুমের গাইডলাইন (ইংরেজি)
জেনে রাখুন
প্র: আমার শিশু রাতে বারবার জেগে উঠে দুধ খায়। এটা কি ঠিক?
- উ: নবজাতক ও ছোট শিশুদের জন্য রাতে খাওয়া স্বাভাবিক। তবে ৬ মাসের পর ধীরে ধীরে রাতের খাওয়ানো কমিয়ে আনা উচিত। ৯-১২ মাসের মধ্যে বেশিরভাগ শিশু রাতের খাওয়া ছাড়াই ঘুমাতে পারে। রাতের খাওয়ানোর সাথে ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস যুক্ত হলে তা সমস্যা তৈরি করে। ধীরে ধীরে রাতের খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে আনার চেষ্টা করুন বা পানি দেওয়ার চেষ্টা করুন (ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে)।
প্র: শিশুকে একা ঘুমাতে শেখানোর সঠিক বয়স কখন?
- উ: কোনো নির্দিষ্ট বয়স নেই, তবে ৪-৬ মাস বয়স থেকে শিশুরা নিজে নিজে ঘুমিয়ে পড়ার দক্ষতা অর্জন করতে শুরু করে এবং তখন থেকেই এই দক্ষতা শেখানো শুরু করা যেতে পারে। এটি একটি ধীর প্রক্রিয়া এবং ধৈর্য ও সামঞ্জস্যের প্রয়োজন। বাচ্চাদের ঘুম না হলে করণীয় এর একটি মূল স্তম্ভ হল এই দক্ষতার বিকাশ।
প্র: টিভি বা মোবাইলে কার্টুন দেখিয়ে ঘুম পাড়ানো যায় কি?
- উ: একেবারেই না। স্ক্রিনের নীল আলো শিশুর মস্তিষ্ককে সতর্ক করে তোলে এবং প্রাকৃতিক ঘুমের হরমোন মেলাটনিনের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত করে। এতে ঘুম আসতে দেরি হয় এবং ঘুমের গুণগত মান খারাপ হয়। ঘুমানোর অন্তত ১ ঘণ্টা আগে সব ধরনের স্ক্রিন (টিভি, মোবাইল, ট্যাব) বন্ধ রাখুন।
প্র: শিশু যদি একটানা অনেকক্ষণ কাঁদে, তাহলে কি তাকে কাঁদতে দেওয়া উচিত?
- উ: “ক্রাই ইট আউট” (Cry It Out) পদ্ধতি অনেক বিতর্কিত এবং সব শিশু বা পরিবারের জন্য উপযুক্ত নাও হতে পারে। এতে শিশুর অবহেলিত বোধ হতে পারে। বরং ধাপে ধাপে সান্ত্বনা দেওয়ার পদ্ধতি (“কম থেকে কমতর”) অনেক বেশি মানবিক ও কার্যকর। আপনার শিশুর টেম্পারামেন্ট এবং আপনার নিজের মানসিক সক্ষমতা বিবেচনা করে পদ্ধতি বেছে নিন। কখনোই শিশুকে অত্যধিক সময় ধরে একা কাঁদতে দেবেন না।
- প্র: বাংলাদেশের গরমে শিশুর ঘুমের সমস্যা হলে বিশেষভাবে কী করণীয়?
- উ: গরমে ঘুম না আসা খুবই স্বাভাবিক। হালকা সুতির ঢিলেঢালা পোশাক পরান। এসি বা ফ্যান চালান, তবে সরাসরি বাতাস শিশুর গায়ে না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখুন। ঠান্ডা পানিতে গোসল করান। প্রচুর তরল (বুকের দুধ/ফরমুলা/পানি) খাওয়ান। ব্ল্যাকআউট কার্টেন ব্যবহার করে দিনে ঘর ঠান্ডা রাখুন। মশারি ব্যবহারে শিশুর গরম লাগলে হালকা সুতির মশারি ব্যবহার করুন।
আপনার ছোট্ট সোনামণির শান্তির ঘুম শুধু তার সুস্থ বিকাশের জন্যই নয়, আপনার নিজের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্যও অপরিহার্য। বাচ্চাদের ঘুম না হলে করণীয় নিয়ে এই জরুরি টিপস গুলো শুধু তথ্য নয়, অসংখ্য মা-বাবার হাতে-কলমে পরীক্ষিত অভিজ্ঞতার ফসল। মনে রাখবেন, প্রতিটি শিশুই অনন্য। কোন পদ্ধতি একদিনেই কাজ করবে না। ধৈর্য ধরুন, ধারাবাহিক হোন, নিজের যত্ন নিন। রাত জাগার সেই ক্লান্তি কাটিয়ে ওঠার পথে প্রতিটি ছোট সাফল্যকেও উদযাপন করুন। ঘুমন্ত শিশুর মিষ্টি মুখ দেখার আনন্দই সব কষ্ট ভুলিয়ে দেবে। আজই শুরু করুন – একটি ছোট্ট ঘুমের রুটিন গড়ে তুলুন, ঘরটাকে একটু অন্ধকার করুন, এবং আপনার সোনামণিকে নিজে নিজে ঘুমিয়ে পড়ার সেই মূল্যবান দক্ষতা শেখানোর যাত্রায় পা বাড়ান। প্রশান্তির রাত এখন আপনার দোরগোড়ায়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।