সন্ধ্যার প্রথম তারা উঠতে না উঠতেই মোবাইলের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছিল বাবার নাম। আঙুলটা একটু ইতস্তত করল। শেষ কবে কথা হয়েছিল? গত ঈদে? নাকি তারও আগে? কল রিসিভ করতেই গলা ভাঙা কাশির শব্দ। “তুই ভালো আছিস তো? কিছু লাগবে না তো?” সেই একই প্রশ্ন, বছরের পর বছর ধরে একই সুর। চোখে জল নেমে এল। এই দূরত্বের ভার, এই অনাকাঙ্ক্ষিত নীরবতার বোঝা – কত হৃদয়কে প্রতিদিন ভারাক্রান্ত করে তুলছে বাংলাদেশের শহর-গ্রামজুড়ে? বাবা-মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের গুরুত্ব শুধু আবেগের কথা নয়; এটি একটি অস্তিত্বের প্রশ্ন, আমাদের ব্যক্তিগত শান্তি, মানসিক সুস্থতা, এমনকি সামাজিক কাঠামোর ভিত শক্ত করার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যখন সেই মূল বন্ধন দুর্বল হতে থাকে, তখন শিকড়হীন গাছের মতোই আমাদের অস্তিত্বও টলমল করতে থাকে। আজকের এই যান্ত্রিক যুগে, ঢাকার উঁচু দালানের ফ্ল্যাট থেকে শুরু করে সিলেটের চা বাগানের কোয়ার্টার পর্যন্ত, এই সম্পর্কের জরুরি মেরামতের সময় এসেছে – শুধু অতীতের স্মৃতির মালা গাঁথতে নয়, ভবিষ্যতের এক অনির্বাণ আলোর পথ দেখাতে।
বাবা-মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের গুরুত্ব: কেন এটি শুধু আবেগ নয়, বিজ্ঞানও
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাবা-মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের গুরুত্ব কে কেবল সাংস্কৃতিক দায়িত্ববোধ দিয়ে ব্যাখ্যা করলে তা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আধুনিক মনোবিজ্ঞান, স্নায়ুবিজ্ঞান এবং সমাজবিজ্ঞান একবাক্যে স্বীকার করে যে এই বন্ধন আমাদের মানবিক বিকাশের প্রাথমিক স্তম্ভ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. তাহমিনা আক্তারের মতে, “মা-বাবার সাথে ইতিবাচক ও উষ্ণ সম্পর্ক শিশুর মস্তিষ্কের গঠনকে প্রভাবিত করে। এটি নিরাপত্তা বোধ, আত্মসম্মান, এবং ভবিষ্যতে অন্যদের সাথে সুস্থ সম্পর্ক গড়ার ক্ষমতার ভিত্তি তৈরি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই বন্ধন দৃঢ় হলে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে উদ্বেগ, বিষণ্নতা এবং ঝুঁকিপূর্ণ আচরণের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।”
- মানসিক স্বাস্থ্যের ভিত্তিপ্রস্তর: সিলেটের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি গবেষণা (২০২২) ইঙ্গিত দেয় যে যেসব তরুণ-তরুণী বাবা-মায়ের সাথে খোলামেলা ও সম্মানজনক সম্পর্ক বজায় রাখে, তাদের মধ্যে মানসিক চাপ, অ্যাংজাইটি এবং ডিপ্রেশনের লক্ষণ অন্যদের তুলনায় প্রায় ৪০% কম। এই সম্পর্কগুলি একটি “ইমোশনাল বাফার জোন” তৈরি করে, জীবনের প্রতিকূলতা মোকাবেলায় শক্তি জোগায়।
- সামাজিক দক্ষতা ও নৈতিক কম্পাস: বাবা-মা শুধু রক্তের সম্পর্ক নয়; তারা প্রথম শিক্ষক, প্রথম বন্ধু। তাদের কাছ থেকেই আমরা শিখি সহানুভূতি (Empathy), সম্মান, দায়িত্ববোধ, দ্বন্দ্ব সমাধান এবং সামাজিক আচরণের নিয়মকানুন। রাজশাহীর এক গ্রামে পরিচালিত একটি সমীক্ষা দেখায়, পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় যেসব কিশোর, তারা স্কুল ও সমাজে অন্যদের সাথে বেশি সহযোগিতামূলক আচরণ প্রদর্শন করে।
- জীবনের স্থায়িত্ব ও উদ্দেশ্যবোধ: বার্ধক্য বিশেষজ্ঞ ডা. ফারহানা হক (ঢাকার এভারকেয়ার হসপিটাল) পর্যবেক্ষণ করেন, “যেসব প্রবীণ নাগরিক সন্তানদের সাথে নিয়মিত, ইতিবাচক যোগাযোগ রাখেন, তাদের মধ্যে একাকীত্ববোধ, ডিমেনশিয়া লক্ষণ এবং শারীরিক অসুস্থতার হার কম। তাদের জীবনীশক্তি ও বেঁচে থাকার ইচ্ছা অনেক বেশি প্রবল।” অন্যদিকে, সন্তানের জন্যও এই বন্ধন একটি “অ্যানকর” হিসেবে কাজ করে – জীবনের উত্থান-পতনে স্থিতি দেয়।
বড় হওয়ার অর্থ এই নয় যে বাবা-মায়ের দরকার ফুরিয়ে গেছে। বরং, তাদের দরকার বদলেছে – এখন প্রয়োজন শ্রদ্ধায় মোড়ানো সঙ্গ, ধৈর্যে গড়া বোঝাপড়া, আর সময়ের অমূল্য উপহার।
বাবা-মায়ের সাথে দূরত্বের কারণ: বাংলাদেশি প্রেক্ষাপটে এক নির্মম বাস্তবতা
বাবা-মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের গুরুত্ব অনুধাবন করতে গেলে প্রথমে বুঝতে হবে কেনই বা এই দূরত্ব তৈরি হয়। বাংলাদেশের দ্রুত পরিবর্তনশীল সামাজিক-অর্থনৈতিক ল্যান্ডস্কেপে এই ফাটলগুলোর কারণগুলো জটিল ও বহুমুখী:
- জেনারেশন গ্যাপের চরম রূপ: ডিজিটাল বিপ্লব এক প্রজন্মকে নিয়ে গেছে এক অভূতপূর্ব গতিতে, অন্যদিকে পূর্ববর্তী প্রজন্ম অনেক ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়েছেন। চট্টগ্রামের এক ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র রাফির গল্প: “আব্বু মনে করেন মোবাইল গেম মানেই সময় নষ্ট। আমি তাকে বোঝাতে পারিনা যে গেম ডেভেলপমেন্ট এখন বিশ্বব্যাপী বিশাল ক্যারিয়ার। ফলে প্রতিবার ফোনেই তর্ক। কথা বলা কমে গেছে।” এই প্রযুক্তিগত ও চিন্তার পার্থক্য অহংকারে পরিণত হয়, আলোচনার পথ রুদ্ধ করে।
- অত্যধিক প্রত্যাশা ও মানসিক চাপ: “ওর ছেলে ডাক্তার”, “ওর মেয়ে ব্যাংকার” – এই সামাজিক চাপ বাবা-মা ও সন্তান উভয়ের উপরেই মারাত্মক প্রভাব ফেলে। সন্তান যখন প্যারেন্টসের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারে না (বা করতে চায় না), তখন হতাশা, অভিমান, অপরাধবোধ সম্পর্কের মধ্যে দেয়াল তুলে দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানজিনার কথায়: “আম্মু চান আমি বিসিএস দিই। কিন্তু আমার আগ্রহ থিয়েটারে। তাকে হতাশ করতে ভয় পাই বলে অনেক কিছু লুকাই। ফলে সম্পর্কটা দিন দিন ফর্মাল হয়ে যাচ্ছে।”
- জীবনযাত্রার ব্যস্ততা ও ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতা: চাকরি, পড়াশোনা, সংসারের চাপে ঢাকা-চট্টগ্রাম-খুলনার মতো বড় শহরগুলোর সন্তানরা সময়ের অভাবে ভোগেন। আবার, গ্রামে বসবাসরত বাবা-মা’র সাথে শহুরে সন্তানের যোগাযোগ প্রায়শই সীমাবদ্ধ থাকে টেলিফোন কল বা বছরে এক-দুই বার ছুটিতে দেখা। এই শারীরিক দূরত্ব ধীরে ধীরে মানসিক দূরত্বে রূপ নেয়।
- অতীতের আঘাত ও অপূর্ণ যোগাযোগ: কখনো কখনো শৈশব বা কৈশোরে অভিভাবকত্বের ত্রুটি (কঠোর শাসন, অবহেলা, পক্ষপাতিত্ব, মানসিক বা শারীরিক নির্যাতন) গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। এই ক্ষত নিরাময় না করেই সম্পর্ক উন্নয়ন অসম্ভবের কাছাকাছি।
- সামাজিক রীতির পরিবর্তন: যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবারের প্রাধান্য, নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির বিস্তার – এই সামাজিক রূপান্তরও প্রাকৃতিকভাবে প্রজন্মের মধ্যে কমিউনিকেশনের সুযোগ কমিয়ে দিয়েছে।
এই বাধাগুলো চিহ্নিত করাই প্রথম পদক্ষেপ। এগুলো অপরাজেয় নয়। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন সচেতন প্রচেষ্টা, ধৈর্য এবং কখনো কখনো পেশাদার সাহায্য।
বাবা-মায়ের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার কার্যকর কৌশল: থিওরি নয়, প্র্যাকটিক্যাল টিপস
বাবা-মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের গুরুত্ব বোঝার পর আসে বাস্তব প্রয়োগের প্রশ্ন। কীভাবে এই ফাটল জোড়া লাগাবেন? এখানে কিছু প্রমাণিত, বাংলাদেশি প্রেক্ষাপটে উপযোগী কৌশল:
১. যোগাযোগের শিল্পকে আয়ত্ত্ব করুন (Communication is Key)
- শুনুন, সত্যিই শুনুন (Active Listening): শুধু উত্তর দেওয়ার জন্য কান লাগাবেন না। মনোযোগ দিন। বাবা যখন গল্প করেন আত্মীয়-পাড়ার খবর, বা মা যখন রান্নার টিপস দেন, বিরক্ত না হয়ে শুনুন। তাদের কথার মধ্যেও মূল্যবোধ, অভিজ্ঞতা লুক্কায়িত থাকে। “আপনি যা বলছেন, তা আমি বুঝতে চেষ্টা করছি” – এই বার্তাটা দিন।
- “আমি” বক্তব্য ব্যবহার করুন (Use “I” Statements): অভিযোগ বা সমালোচনা করার সময় “আপনি” দিয়ে শুরু করলে তা আক্রমণাত্মক শোনায়। পরিবর্তে বলুন, “আমি কষ্ট পাই যখন…”, “আমার মনে হয়…”, “আমার অনুভূতি হলো…”। যেমন: “আপনি আমার কথা শোনেন না!” এর বদলে বলুন, “আমি কষ্ট পাই যখন আমার কথা বলার সময় মোবাইলে তাকিয়ে থাকেন, আমার মনে হয় তখন আমার কথা শোনা হচ্ছে না।”
- অ-মৌখিক যোগাযোগের গুরুত্ব: চোখে চোখ রেখে কথা বলা, হালকা স্পর্শ (যেমন হাত ধরা), হাসি – এই ছোট ছোট ইশারাই সম্পর্কে উষ্ণতা বাড়ায়। দূরের থাকলে নিয়মিত ভিডিও কল করুন, শুধু কথা বলাই নয়, একে অপরকে দেখুন।
২. সময় দিন – গুণগত সময় (Quality Time Matters)
- রুটিন তৈরি করুন: প্রতিদিন বা প্রতি সপ্তাহে একটি নির্দিষ্ট সময় শুধু তাদের জন্য রাখুন। হতে পারে সকালের চায়ের আড্ডা, রাতের খাবারের পর গল্প করা, বা শুক্রবার বিকেলের বিশেষ সময়। এই রুটিন তাদের গুরুত্বপূর্ণ বোধ করাবে।
- সাথে কিছু করুন (Shared Activities): শুধু বসে কথা বলা নয়, একসাথে কিছু করুন। বাবাকে নিয়ে তার পছন্দের পুরনো বাংলা সিনেমা দেখুন। মায়ের সাথে রান্না করুন – তার হাতে শিখুন সেই বিশেষ ডালের রেসিপি। বাগান করা, ধর্মীয় উৎসবে যাওয়া, এমনকি একসাথে বাজার করা (ঢাকার নিউমার্কেটে বা গ্রামের হাটে) – এই শেয়ার্ড এক্সপেরিয়েন্স বন্ডিং তৈরি করে।
- শৈশবের স্মৃতিচারণ (Reminiscing): পুরনো দিনের গল্প শুনুন, আলবাম দেখুন। শৈশবের সুখস্মৃতি স্মরণ করলে সম্পর্কে ইতিবাচক আবেগের পুনরুজ্জীবন ঘটে।
৩. ধৈর্য, সমঝোতা ও সীমানা (Patience, Compromise & Boundaries)
- ধৈর্য ধরুন: দশক ধরে তৈরি হওয়া দূরত্ব একদিনে মিটবে না। মনোভাব পরিবর্তন, অভ্যাস বদল সময়সাপেক্ষ। ছোট ছোট উন্নতিতে খুশি হোন।
- সমঝোতার সন্ধান করুন (Find Common Ground): সব বিষয়ে একমত হওয়া অসম্ভব। বিতর্কিত বিষয় (রাজনীতি, ক্যারিয়ার পছন্দ, জীবনধারা) এড়িয়ে চলুন বা সম্মান সহকারে ভিন্নমত প্রকাশ করুন। “আমরা এই বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করতে পারি, কিন্তু এটা আমাদের ভালোবাসাকে কমাবে না” – এই বার্তা দিতে শিখুন।
- সুস্থ সীমানা নির্ধারণ করুন (Set Healthy Boundaries): ভালোবাসা মানে সর্বস্ব ত্যাগ বা অনিয়ন্ত্রিত হস্তক্ষেপ মেনে নেওয়া নয়। সম্মানের সাথে আপনার সীমানা (যেমন ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, সময়, আর্থিক বিষয়) জানান। “আম্মু, আমি জানি তুমি আমার ভালো চাও। কিন্তু এই সিদ্ধান্তটি আমাকেই নিতে হবে। তুমি আমার পাশে থাকো, এটাই আমার চাওয়া।”
৪. কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও ছোট ছোট যত্ন (Gratitude & Small Gestures)
- ধন্যবাদ জানান: তাদের দেওয়া শিক্ষা, ভালোবাসা, ত্যাগের জন্য স্পষ্টভাবে ধন্যবাদ জানান। “আব্বু, তুমি যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমাদের লেখাপড়া শিখিয়েছো, তার জন্য আমি আজীবন কৃতজ্ঞ।” এই স্বীকৃতি তাদের অবদানকে মূল্যবান করে তোলে।
- ছোট ছোট যত্ন (Small Acts of Love): বড় উপহারের চেয়ে নিয়মিত ছোট যত্ন বেশি কাজ করে। মায়ের প্রিয় মিষ্টি এনে দেওয়া, বাবার প্রেসক্রিপশনের ওষুধ কিনে দেওয়া, তাদের স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নেওয়া, তাদের প্রিয় গানটা প্লে করা – এই ছোট্ট উদ্যোগগুলোই হৃদয় স্পর্শ করে।
- অতীত ক্ষমা ও বর্তমানকে আলিঙ্গন (Forgiveness & Embracing the Present): অতীতের বেদনা বা ভুল নিয়ে আটকে থাকলে বর্তমানকে উপভোগ করা যায় না। ক্ষমা করা (যত কঠিনই হোক) মূলত নিজের জন্য। অতীতের ভার কাটিয়ে বর্তমান মুহূর্তে তাদের সাথে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলার দিকে মনোনিবেশ করুন।
যদি নিজেরা পারস্পরিক প্রচেষ্টায় সমস্যা সমাধান না হয়, লজ্জা পাবেন না। বাংলাদেশে এখন মানসম্মত কাউন্সেলিং পরিষেবা পাওয়া যায় (যেমন: জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, বা প্রাইভেট কাউন্সেলর)। পারিবারিক থেরাপি একটি কার্যকর পথ দেখাতে পারে।
বাবা-মায়ের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের সুফল: ব্যক্তি, পরিবার থেকে সমাজ
বাবা-মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের গুরুত্ব শুধু ব্যক্তিগত সুখের জন্যই নয়; এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে পরিবার এবং বৃহত্তর সমাজের উপর:
- ব্যক্তির জন্য:
- দৃঢ় মানসিক ভিত্তি: নিরাপত্তা বোধ, আত্মবিশ্বাস, মানসিক স্থিতিস্থাপকতা (Resilience) বৃদ্ধি পায়।
- সুস্থ সামাজিক সম্পর্ক: পারিবারিক বন্ধনে শেখা সহানুভূতি, শ্রদ্ধা ও যোগাযোগের দক্ষতা বন্ধুত্ব, প্রেম এবং কর্মক্ষেত্রের সম্পর্ককে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে।
- জীবনের অর্থ ও পরিচয়: শিকড়ের সাথে সংযোগ ব্যক্তির আত্মপরিচয়কে সুসংহত করে, জীবনে উদ্দেশ্যবোধ দেয়।
- দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্য: গবেষণা বলে, দৃঢ় পারিবারিক বন্ধন স্ট্রেস হরমোন (কর্টিসল) কমায়, যা হার্টের স্বাস্থ্য, ইমিউন সিস্টেম এবং সামগ্রিক সুস্থতার জন্য উপকারী।
- পরিবারের জন্য:
- স্থিতিশীলতা ও সম্প্রীতি: বাবা-মা ও সন্তানের মধ্যে সুসম্পর্ক পুরো পরিবারের আবহাওয়াকে ইতিবাচক করে, ভাইবোনের মধ্যে দ্বন্দ্ব কমায়।
- প্রজন্মান্তরে জ্ঞানের প্রবাহ: বড়দের অভিজ্ঞতা, পারিবারিক ইতিহাস, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সহজে হস্তান্তরিত হয়।
- বৃদ্ধ বয়সে সুরক্ষা ও যত্ন: সুসম্পর্ক প্রবীণ পিতামাতার একাকীত্ব দূর করে, তাদের প্রয়োজনীয় শারীরিক ও মানসিক যত্ন নিশ্চিত করে।
- সমাজ ও জাতির জন্য:
- সুস্থ নাগরিক গঠন: পারিবারিক বন্ধন থেকে যে মানসিক সুস্থতা, সামাজিক দায়িত্ববোধ ও নৈতিক মূল্যবোধ তৈরি হয়, তা সমাজে ইতিবাচক ও উৎপাদনশীল নাগরিক তৈরি করে।
- সামাজিক সমস্যা হ্রাস: দৃঢ় পারিবারিক বন্ধন কিশোর অপরাধ, মাদকাসক্তি, পারিবারিক সহিংসতা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতাজনিত সমস্যা কমাতে সাহায্য করে।
- সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা: পরিবারই সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, ঐতিহ্য এবং ভাষা সংরক্ষণ ও প্রেরণের প্রধান মাধ্যম। এই বন্ধন দুর্বল হলে সাংস্কৃতিক শিকড়ও দুর্বল হয়।
বাবা-মায়ের সাথে সম্পর্ক কখনো ‘সেটেলড’ বিষয় নয়; এটি একটি জীবন্ত সত্তা, যার জন্য নিয়মিত সেচ, আলো বাতাস এবং যত্নের প্রয়োজন। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া, গন্তব্য নয়।
জেনে রাখুন (FAQs)
১. বাবা-মায়ের সাথে দূরত্ব বেড়ে গেলে প্রথমেই কী করা উচিত?
প্রথমে নিজের মনোভাব পরিষ্কার করুন। অভিমান, রাগ নয় – পুনঃসংযোগের ইচ্ছা প্রাধান্য পাক। একটি ছোট, ইতিবাচক পদক্ষেপ নিন: একটি আন্তরিক ফোন কল (“কেমন আছেন?”), একটি ছোট্ট উপহার, বা শুধুই দেখা করতে চলে যাওয়া। শুরুটা ছোট হোক, কিন্তু искрен (আন্তরিক) হোক। ধৈর্য ধরুন, একবারে সব ঠিক হবে এমন আশা করবেন না।
২. বাবা-মা আমার কথা শুনতে বা বুঝতে চান না বলে মনে হয়, কী করব?
এটি খুবই সাধারণ সমস্যা। নিজের যোগাযোগের ধরণ বদলানোর চেষ্টা করুন। “আমি” বক্তব্য ব্যবহার করুন। তাদের কথা মন দিয়ে শুনুন আগে। এমন সময় ও পরিবেশ বেছে নিন যখন তারা রিল্যাক্সড ও কথা শোনার জন্য প্রস্তুত (যেমন চা/কফির সময়)। বিষয়বস্তু সহজ ও আবেগনিরপেক্ষ রাখুন প্রথমে। ধারাবাহিক প্রচেষ্টা জরুরি।
৩. আমি প্রবাসে থাকি, কীভাবে বাবা-মায়ের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখব?
প্রযুক্তি আপনার বন্ধু। নিয়মিত ভিডিও কল (WhatsApp, Messenger, Skype) করুন – শুধু কথা নয়, একে অপরকে দেখুন। ছোট ছোট জিনিস নিয়মিত পাঠান (অনলাইন শপিং, গিফট হ্যাম্পার)। তাদের দৈনন্দিন জীবনে আগ্রহ নিন। বড় উৎসবে সম্ভব হলে দেশে আসার চেষ্টা করুন। তাদের বন্ধু/আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ রাখুন, যাতে খবরাখবর থাকে।
৪. বাবা-মায়ের সাথে অতীতের কোন আঘাত (Trauma) বা মনোমালিন্য আছে, কিভাবে সামনে আগাবো?
এটি জটিল এবং কষ্টকর। নিজে একা না লড়াই করার পরামর্শ দেওয়া হয়। একজন যোগ্য থেরাপিস্ট বা কাউন্সেলরের সাহায্য নিন। তারা নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করতে পারেন। ক্ষমা একটি প্রক্রিয়া, তাৎক্ষণিক ঘটনা নয়। নিজের নিরাপত্তা ও মানসিক সুস্থতাকে প্রাধান্য দিন। পেশাদার সাহায্য ছাড়া গভীর ক্ষত নিরাময় কঠিন হতে পারে।
৫. বাবা-মা বার্ধক্যজনিত সমস্যায় (Dementia, Alzheimer’s) ভুগছেন, সম্পর্ক উন্নয়ন কীভাবে সম্ভব?
এই অবস্থায় বাবা-মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের গুরুত্ব ভিন্ন মাত্রা পায়। ধৈর্য আর করুণাই প্রধান হাতিয়ার। বাস্তবসম্মত প্রত্যাশা রাখুন – তারা আগের মতো আচরণ বা স্মরণ নাও করতে পারেন। বর্তমান মুহূর্তে উপস্থিত থাকুন। শৈশবের স্মৃতি, প্রিয় গান, স্নেহ স্পর্শ (হাত ধরা) কাজ করতে পারে। তাদের আচরণকে ব্যক্তিগতভাবে নেবেন না। সেবা-যত্নকারীর জন্য নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়াও সমান জরুরি।
বাবা-মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের গুরুত্ব শুধু একটি আবেগিক আবেদন নয়; এটি একটি অপরিহার্য মানবিক বিনিয়োগ, যা আমাদের ব্যক্তি জীবনকে অর্থবহ করে, পরিবারকে শক্তিশালী করে, এবং সমাজকে স্থিতিশীল রাখে। এই বন্ধনই আমাদের প্রথম পরিচয়, শেষ আশ্রয়। আজকের এই দ্রুতগতির, প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে, আসুন আমরা একটু থেমে যাই। ফিরে তাকাই সেই দুই মানুষটির দিকে, যাদের ভালোবাসার আলোয় আমাদের পথচলা শুরু। তাদের চোখে এখনো অপেক্ষা জাগে আমাদের দিকে তাকানোর। সময় ফুরিয়ে আসার আগেই, একটি ফোনকল, একটি স্পর্শ, একটি আন্তরিক ‘আপনাকে ভালোবাসি’ দিয়ে সেই অপেক্ষার অবসান ঘটান। তাদের হাসি হোক আমাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান অর্জন। আজই সময়টা করে নিন – আপনার বাবা বা মায়ের সাথে যোগাযোগ করুন, একটি ছোট কথাই হতে পারে সেই মহৎ যাত্রার শুরু, যা পুনরুদ্ধার করবে হারিয়ে যাওয়া সেতু, রোপণ করবে ভবিষ্যতের ছায়ার বন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।