জুমবাংলা ডেস্ক : দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বুধবার (৭ আগস্ট) বিকালে নয়া পল্টনে বিএনপির সমাবেশে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি এক বক্তব্যে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এই আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার গৌরবকে কালিমাযুক্ত করার ষড়যন্ত্র এরই ভেতরে আবার শুরু হয়ে গেছে। গণতন্ত্রে উত্তরণের চলমান প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে সারা দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র স্পষ্ট হয়ে উঠছে। প্রশাসনের প্রতি আহ্বান, শক্ত হাতে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করুন। প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। ধর্ম-বর্ণ পরিচয়ের কারণে কেউ যেন নিরাপত্তাহীনতায় না থাকে। সবার আগে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপিসহ গণতন্ত্রের পক্ষের দলগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, ষড়যন্ত্রকারীদের এই নৈরাজ্যের কাছে আমরা হার মানতে পারি না।’
তিনি বলেন, ‘আমি এই মুহূর্তে সারা দেশের বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান রেখে বলতে চাই, আপনারা যে যেখানে বসবাস করেন সেখানে আপনার বন্ধু কিংবা পাড়া-প্রতিবেশী– তিনি মুসলমান-বৌদ্ধ-হিন্দু-খৃষ্টান যে ধর্মীয় পর্যায়ের যেই হোক না কেন, বিশ্বাস যাই হোক না– তার নিরাপত্তায় দেয়াল হিসেবে দাঁড়িয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বসবাসকারী প্রত্যেকটি মানুষের একটিই পরিচয়। সেটি হচ্ছে আমরা বাংলাদেশি।’
পুলিশ অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান মন্তব্য করে তারেক রহমান বলেন, ‘একটি সভ্য এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পুলিশ অপরিহার্য। পুলিশ জনগণের শত্রু নয়। অত্যাচারী হাসিনা বিনা ভোটে ক্ষমতায় থাকার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জনগণের শত্রু হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, বিএনপি বিশ্বাস করে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো প্রত্যেকে বিশ্বাস করে পুলিশের ভেতরে একটি চক্র ছাড়া অধিকাংশ পুলিশ কর্মকর্তা এবং সদস্য চাকরিবিধি মেনে, দেশের আইন-কানুন মেনেই দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করছে।’
তিনি বলেন, ‘হাসিনা পালানোর পরে বর্তমানে সুকৌশলে একটি চক্র পুলিশের মনোবল ভেঙে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। পুলিশকে অকার্যকর করে দেওয়া গেলে দেশকে অস্থিতিশীল করা সহজ। ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর মনে নিরাপত্তাহীন সৃষ্টি করা সহজ।’
বিএনপির পরিচয়ে কেউ অপকর্ম করলে ধরিয়ে দিন- এই আহ্বান জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, ‘অস্থিতিশীলকারীদের আমি হুঁশিয়ার করে বলতে চাই, পুলিশ কিংবা ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর আজ থেকে এই মুহূর্ত থেকে হামলা কিংবা নৈরাজ্য বন্ধ করুন। এমনকি বিএনপির কেউ দলের নাম ব্যবহার করে কোনও অপকর্ম করতে চাইলে তাকে ধরে আইনের হাতে তুলে দিন। কোনও পুলিশের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে যথানিয়মে অভিযোগ দায়ের করুন।’
নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে সমাবেশে নেতাকর্মীদের ব্যাপক জমায়েত। ছবি: নাসিরুল ইসলাম
তিনি বলেন, ‘দেশবাসীর প্রতি আমার বিনীত আহ্বান, কেউ দয়া করে নিজের হাতে আইন তুলে নেবেন না। প্রতিহিংসা-প্রতিশোধে লিপ্ত হবেন না। বিচারের ভার নিজ হাতে দয়া করে নেবেন না। কেবল দৃষ্টান্ত অনুসরণ নয়, নিজে দায়িত্বশীলতার এবং মানবাধিকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন।’
তারেক রহমান বলেন, ‘অতীত সমালোচনা কিংবা নৈরাজ্যের বদলে নৈরাজ্য কোনও সমাধান হতে পারে না। বরং বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘শাসন-প্রশাসনকে সময়োপযোগী করে গড়ে তোলা এখন সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সময়ের দাবি। জ্ঞানভিত্তিক রাষ্ট্র-সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে নিয়োগ কিংবা প্রমোশনে মেধার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার থাকতে হবে।’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘দেশকে আমদানিনির্ভর কিংবা বৈদেশিক ঋণনির্ভরতা থেকে বের করে আনতে হবে আমাদের। দেশীয় উৎপাদন এবং উৎপাদনের প্রযুক্তির নির্ভরতা বাড়াতে হবে। দেশের কর্মসংস্থান তৈরি করে বেকার সমস্যার সমাধান দ্রুতই চেষ্টা করতে হবে। গার্মেন্টস, শ্রম, ওষুধ, আউট সোর্সিংসহ সম্ভাবনাময় খাতগুলোকে নিয়ে রফতানিমুখী বাজারের আওতা যেকোনও মূল্যে বাড়াতে হবে। প্রযুক্তিনির্ভর ও কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে দেশে-বিদেশে শ্রম বাজারে আমাদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মতো দক্ষ ও মেধাবী প্রজন্ম গড়ে তুলতে হবে। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আধুনিক ও বাস্তবসম্মত করার লক্ষ্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার নীতির ওপর অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। সবার জন্য সুবিচার নিশ্চিত করতে আইনের শাসন অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।’
উচ্চ কক্ষ চালুর প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেন, ‘দেশে ও প্রবাসে এমন অনেক বাংলাদেশি রয়েছেন যারা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বিজ্ঞদের অনেকেই সংশ্লিষ্ট হতে চান না। সুতরাং এইসব গুণী মানুষদের রাষ্ট্র পরিচালনায় ও নীতি প্রণয়নে অন্তর্ভুক্ত করতে জাতীয় সংসদে উচ্চ কক্ষ চালু করার প্রস্তাব বিএনপি রেখেছে এরই ভেতরে। রাজনৈতিক এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় গুণগত পরিবর্তন আনতে না পারলে আমাদের এই বিপ্লবে কাঙ্ক্ষিত ফল মিলবে না।’
তারেক রহমান বলেন, ‘সাড়ে ১২ কোটি মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছিল স্বৈরাচার। গত ১৫/১৬ বছর ধরে জনগণের ওপর স্বৈরশাসন চাপিয়ে দিয়েছিল। স্বৈরাচার গণহত্যাকারী হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে হাজারও শহীদের রক্তে রঞ্জিত বিপ্লবের প্রথম ধাপ সফল হয়েছে মাত্র।’
তিনি বলেন, ‘ছাত্র-জনতার এই রক্তঝরা বিপ্লবের চূড়ান্ত লক্ষ্য একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। তাই বিপ্লবের লক্ষ্য বাস্তবায়নে দ্রুততম জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। স্বৈরাচার হাসিনার পতনের রক্তরঞ্জিত বিপ্লবকে সার্থক এবং সফল করতে আসুন নাগরিক হিসেবে দায়িত্বশীল আচরণ করি। বিভেদ-বিরোধ, হিংসা-প্রতিহিংসা নয়, আসুন সবাই মিলে রাষ্ট্র ও সমাজে মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার শপথ গ্রহণ করি। নতুন প্রজন্মের জন্য একটি দুর্নীতিমুক্ত এবং জবাবদিহিমূলক নিরাপদ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি।’
ভার্চুয়ালি দেওয়া বক্তব্যে নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তারেক রহমান বলেন, ‘আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকলে আগামী দিনে বাংলাদেশের জন্য, তারুণ্যের জন্য একটি নিরাপদ ভবিষ্যতে গড়তে পারবো। সবাই যার যার এলাকায় জনগণের সঙ্গে থাকবেন, জনগণকে সঙ্গে রাখবেন। কারণ জনগণই বিএনপির সব ক্ষমতার উৎস।’
তারেক রহমান বলেন, ‘আপনাদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে গণহত্যাকারী হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। প্রমাণ হয়েছে আবারও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ কখনও পরাজয় মানে না, মানতে পারে না এবং মানবে না। বাংলাদেশের পক্ষের শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোনও অপশক্তি বাংলাদেশকে দাবায়ে রাখতে পারবে না ইনশাআল্লাহ। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আর ২০২৪ সালের মুক্তিযুদ্ধ উভয় মুক্তিযুদ্ধেই জনগণের বার্তা একটি। সেই বার্তা হলো শর্ত দিয়ে স্বাধীনতা হয় না। স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণ, স্বাধীনতা অর্জন কিংবা স্বাধীনতা রক্ষায় কোনও শর্ত মানে না, মানতে রাজি না।’
তিনি বলেন, ‘গণহত্যাকারী হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরে আমি প্রিয় বাংলাদেশ থেকে যত মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি, প্রতিটি মানুষের অনুভূতি প্রকাশের প্রথম উচ্চারণ ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে বলছি। দেশ এবং জনগণকে স্বাধীন করতে গিয়ে চোখে-মুখে-বুকে গুলি আলিঙ্গন করা আবু সাঈদ কিংবা মুগ্ধদের মতো হাজারও ছাত্র-ছাত্রী, তরুণ-তরুণীকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে। আহত হয়েছেন অসংখ্য, অগণিত মানুষ। এর ভেতরে ছাত্র-ছাত্রী রয়েছেন, রয়েছেন সাধারণ মানুষ, গৃহিণী, রাজনৈতিক নেতাকর্মী।’
তারেক রহমান বলেন, ‘গণতন্ত্র বিজয়ের ইতিহাসে এই মানুষগুলো স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। গণতান্ত্রিক ছাত্র-জনতার এই বিপ্লবে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সেদিন রাজপথে নেমে এসেছিলেন। গণতন্ত্রের পক্ষের রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি একজন মা যেমন তার সন্তানকে কোলে নিয়ে সেদিন রাজপথে শামিল হয়েছিলেন, একইভাবে শিক্ষক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী-সংস্কৃতিকর্মী, শ্রমিকসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষ সেদিন রাজপথে নেমে এসেছিলেন। ১৯৫২, ’৭১ কিংবা ’৯০-এর মতন দেশের ছাত্র সমাজ বিজয়ের নতুন অমর একটি ইতিহাস রচনা করেছেন। ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ৫ আগস্ট বাংলাদেশ দেখেছে আরেকটি বিজয়। আমি বিএনপিসহ প্রতিটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে দলমত নির্বিশেষে অভিনন্দন জানাই বাংলাদেশের বীর জনতাকে।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।