‘বিক্রি হইতে আসছি, দাম পাই না’
জুমবাংলা ডেস্ক : ঈদে জামা-কাপড় তো দূরের কথা বাচ্চার মুখে সেমাই দিতে পারব না। গত বিশ দিনে কাজ পাইছি ৪ দিন। কাজ একদমই নাই, যা-ও আছে দাম কম। ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করিয়ে ৩০০ টাকা মজুরি দেয়। কথাগুলো কৃষিশ্রমিক মো. আলমগীরের (২৮)।
গত কিছু দিনের মতো আজ বৃহস্পতিবারও তিনি কাজের আশায় বসেছিলেন ফরিদপুরের মানুষের হাটে। রোজার ৩ দিন কাজের আশায় ফরিদপুরে এসেছেন তিনি।
ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামটে বসে মানুষ কেনাবেচার হাট। সেখানে কাজের আশায় বসে থাকা শত মুখের একজন আলমগীর। বাড়ি বগুড়া জেলার সান্তাহারে। তিনি টাকা পাঠালে ভাতের হাঁড়ি ওঠে চুলায়। স্ত্রী ও তিন বছরের ছেলে অপেক্ষা করে। টাকা পাঠাতে দেরি হলে সেদিন খুব কষ্ট হয় স্ত্রী-সন্তানের। অনেক সময় খাবারও জোটে না বলে জানালেন এই দিনমজুর।
ফরিদপুরে আসার পর এক গৃহস্থের বাড়িতে মাত্র ৪ দিন পেঁয়াজ ওঠানোর কাজ করেছিলেন দৈনিক ৫০০ টাকা মজুরিতে। আর কাজ পাননি। আলমগীরের কথা, ‘এখন এখানেই বসে বসে খাচ্ছি। আজ কী খাব তাও জানি না। যা-ও কাজ আসে ৩০০ টাকা মজুরি বলে। ১২ ঘণ্টা কাজ করে ৩০০ টাকায় কাজ করা যায় না। জিনিসপত্রের প্রচুর দাম বাড়ছে, আমাগো দাম বাড়ে নাই। বিক্রি হইতে আসছি, কিন্তু দাম পাই না।’
ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামট ১নং সড়কের বিপরীতে শিশুপার্ক-সংলগ্ন এলাকায় জিলু কমিশনারের বাড়ির পাশেই বসে মানুষের এই হাট। ফরিদপুরে এটা ‘মানুষহাটা’ নামে বেশি পরিচিত। কেউ আবার বলেন, কিষানের হাট। এখানে সব ধরনের কাজের শ্রমিক পাওয়া যায়। ফরিদপুর, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, বরিশালসহ আশপাশের দশ জেলার গৃহস্থরা এসে এখান থেকে মানুষ বা কিষান কিনে নিয়ে যান।
কাজ না পেয়ে নাটোরে ফিরে যাচ্ছেন কুব্বাত আলী, সোহেল মিয়া, রানা শেখসহ ১২ থেকে ১৩ জনের এক দল। কিষান হাটের রাস্তায় দেখা হলে কোথায় যান বলে জানতে চাইলে বলে ওঠেন তাদের একজন– ‘কাজ নাই তাই বাড়ি যাই’।
কৃষিশ্রমিক ইনসান মণ্ডল (৫১) বলেন, এখন পেট চালানোর জন্যই দেহ চালাই, দেহ না চালাইলে পেটটা চলে না বাবা।
নওগাঁর আত্রাই এলাকার মোফাজ্জল (৫০) বলেন, ‘অনেক মালিক ১০ টাকা কমে মজুর নেওয়ার জন্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘোরে, রোদে পোড়ে, হামাকেরেও পোড়ায়। কিন্তু ১০ টাকা বেশি দামে নিতে চায় না।’
এখানকার বেশিরভাগ কিষান উত্তরের রংপুর, নওগাঁ, জয়পুরহাট, লালমনিরহাট, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের। এ ছাড়া ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুরের লোকও আসেন। জনের হাটে দিনমজুররা আসেন কাজের সন্ধানে। পেঁয়াজ লাগানো, তোলা, পাট বপন, টানা, বাছা, সার ও ওষুধ দেওয়া ইত্যাদি কাজে। এছাড়াও ধান কাটা, গম কাটা, বাদাম তোলা, মসুরি, খেসারি, কালাইসহ বিভিন্ন প্রকার ফসলের মাঠে কাজ করেন এসব লোক।
মানুষের হাটে উত্তরবঙ্গের শ্রমিক কেন বেশি তার উত্তর দিলেন সেখানকার শ্রমিকেরাই। তাদের কয়েকজন জানান, তাদের এলাকায় দিনমজুরের দাম কম। দিনের খাবারের বাইরে মজুরি দেওয়া হয় দুই থেকে আড়াইশ টাকা। কিন্তু দক্ষিণের জেলাগুলোতে দিনমজুরের দাম বেশি। বিশেষ করে পাট বোনা ও কাটা, পেঁয়াজ লাগানো ও ওঠানো এবং ধান কাটার সময় চাহিদা বেশি থাকায় দাম তখন অনেক ওপরে ওঠে। চাহিদা বেশি থাকলে অনেক সময় দিনে তিন বেলা খাবার, থাকার জায়গা বাদেই পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া হয় ৬০০ থেকে ৭৫০ টাকা।
মো. বাবুল মিয়া (৫৫) কুষ্টিয়া থেকে গত বুধবার এসেছেন এ হাটে। তিনি বলেন, ‘আমরা বিক্রি হওয়া মানুষ। আমাগো কোনো দাম নাই। ১২ ঘণ্টা কাজ করাইয়া দাম দিতে চায় ৩৫০ টাকা। তাই যাই নাই। অনেক গৃহস্থ সন্ধ্যার পরেও কাম করায়। কাম না করলে ধাক্কা দেয়। বাপ-মারে গালি দেয়। আমরা কি মানুষ, কন আপনি? তবে সব গৃহস্থ এক না। অনেকেই কাজ শেষ করে ফেরার সময় বোনাস দেয়। কাজ করার সময় ভালো খাওন দেয়।’
আরেক দিনমজুর মিলন সাই (৬৭) বলেন, ‘সামনে রোজার ঈদ। কাজ নাই। কাজ পাব কিনা জানি না। গত বছরও বাড়িতে ঈদ করতে পারি নাই। তবে টাকা পাঠাতে পারছিলাম। এক ঈদ করিছিলাম মাদারীপুরের এক গৃহস্থের বাড়িতে।’
ঝিনাইদহের হরিনাকুণ্ডু উপেজলার জিন্নাহ বিশ্বাস (৪৬) বলেন, বর্তমানে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত দাম উঠছে। এখন পেঁয়াজ ওঠানোর কাজ। কয়দিন পরে পাটের সিজনে চাহিদা বাড়তে পারে।
মানুষহাটার ইজারাদার মো. বাবুল বলেন, ঈদ সামনে রেখে কিষানের উপস্থিতি অনেক। প্রতিদিন দেড়শ থেকে দুইশ লোক কেনাবেচা হয় এখানে। তার বিপরীতে যদি ৫শ থেকে ৬শ কিষান থাকে তাহলে দাম একটু কমবেই। তবে আজ কোনো কেনাবেচা নেই। গৃহস্থরা ৩৩০ টাকায় কিষান নিতে চাইলে তারা বিক্রি হয়নি। সূত্র : সমকাল
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।