২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত মহাকাশে অবস্থানরত উপগ্রহের সংখ্যা ছিল আট হাজারের বেশি। অবশ্য তাদের বেশ কিছু এখন আর সচল নেই। তাদের মহাশূন্যে পাঠানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হলো পৃথিবীর শক্তিশালী মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে ফাঁকি দেওয়া। কীভাবে করা হয় এই প্রায় অসম্ভব কাজটি? আবার মহাশূন্যে পৌঁছানোর পর কোন কৌশলে তারা ভারসাম্যপূর্ণ কক্ষপথে পৃথিবীকে পরিভ্রমণ করতে পারে? আর কীভাবেই-বা পৃথিবীতে বসে তাদের পরিচালনা করা হয়? এসব প্রশ্নের উত্তর জানা না থাকলে চলুন জেনে আসা যাক।
ধরুন, আপনার হাতে একটি টেনিস বল আছে। সেটিকে ওপরের দিকে ছুড়ে মেরে একটি কৃত্রিম উপগ্রহের ভবলীলা সাঙ্গ করতে বদ্ধপরিকর আপনি। কারণ, মনেপ্রাণে আপনি বিশ্বাস করেন, একদিন তাদের ব্যবহার করে রোবটরা দখল করে নেবে গোটা পৃথিবী। তাই সময় থাকতে থামাতে হবে তাদের। যাহোক, আপনি সর্বশক্তি দিয়ে ওপরের দিকে ছুড়ে মারলেন বলটি। সেটি কি আদৌ পৌঁছাতে পারবে কৃত্রিম উপগ্রহগুলোর কাছে?
যদি আপনি সুপারম্যান না হয়ে থাকেন, তাহলে অবধারিতভাবে বলটি কিছুটা ওপরে উঠে আবার বিপুল বিক্রমে নিচের দিকে পড়তে শুরু করবে। কতটা ওপর পর্যন্ত বলটি উঠতে পারবে, তা পুরোপুরি নির্ভর করবে আপনার পেশিশক্তির ওপর। যত জোরে ছুড়ে মারবেন, তত ওপরে উঠবে বলটি। টেনিস বলটির এমন গতি হারিয়ে নিচের দিকে পড়ে যাওয়ার পেছনের মূল কারিগর পৃথিবীর আকর্ষণ বল। এটি শুধু টেনিস বল নয়; বরং অদৃশ্য এক শক্তিশালী বাঁধনে বেঁধে রাখে পৃথিবীপৃষ্ঠ ও এর আশপাশের সবকিছু।
টেনিস বল ওপরের দিকে ছুড়ে মারার মুহূর্তে এর মধ্যে থাকে নির্দিষ্ট পরিমাণ গতিশক্তি। এটি কাজ করে পৃথিবীর আকর্ষণের উল্টো দিকে। যখন গতিশক্তি সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে যায়, তখন সেটি নিচের দিকে পড়তে শুরু করে। তবে যদি আমরা একে যথেষ্ট জোরে ছুড়ে দিতে পারি, তাহলে সেটি পৃথিবীর আকর্ষণ পুরোপুরি প্রতিহত করতে পারবে। পদার্থবিদেরা গণিত (ক্যালকুলাস) ব্যবহার করে সহজে এই গতিশক্তির মান বের করতে পারেন।
পৃথিবীতে থাকা কোনো বস্তু যদি প্রতি সেকেন্ডে কমপক্ষে ১১ দশমিক ২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে, তাহলে সে অনায়াসে গ্র্যাভিটিকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে পারবে মহাশূন্যে। বিজ্ঞানীরা এই বেগের নাম দিয়েছেন মুক্তিবেগ। গ্রহ বা নক্ষত্রভেদে এর মান পরিবর্তিত হয়। যেমন সূর্যের পৃষ্ঠ থেকে যাত্রা করে কোনো বস্তু মহাকাশে পৌঁছাতে হলে প্রতি সেকেন্ডে অতিক্রম করতে হবে প্রায় ৬১৭ দশমিক ৫ কিলোমিটার। সূর্যের আকার পৃথিবীর চেয়ে অনেক গুণ বেশি হওয়ায় এমনটি হয়। অর্থাৎ মুক্তিবেগের মান সম্পূর্ণ নির্ভর করে গ্রহ বা নক্ষত্রের ভর ও ব্যাসার্ধের ওপর।
প্রকৃতির এক অদ্ভুত রহস্যের উত্তর মেলে মুক্তিবেগের মাধ্যমে। একটু ব্যাখ্যা করা যাক। পর্যায় সারণির সবচেয়ে হালকা দুটি মৌল হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম। তারা বেশ সহজলভ্য। খুঁজে পাওয়া যায় পৃথিবীসহ মহাবিশ্বের সবখানে। স্বাভাবিক অবস্থায় তারা গ্যাসীয়। সে হিসেবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে তাদের সরব উপস্থিতি থাকার কথা। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো সেখানে তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না বললে চলে। কেন এমন হয়?
কোনো পরমাণুর গড় গতিশক্তি নির্ভর করে তাপমাত্রার ওপর। একই তাপমাত্রার জন্য হালকা গ্যাসগুলোর পরমাণুর গতিশক্তি বেশি হয় এবং ভারী গ্যাসগুলোর পরমাণুর গতিশক্তি হয় কম। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের পরমাণুর গড় গতিশক্তির মান পৃথিবীর মুক্তিবেগের চেয়ে বেশি হয়। ফলে খুব সহজে তারা চলে যেতে পারে মহাশূন্যে। অন্যদিকে নাইট্রোজেন, অক্সিজেন ইত্যাদির মতো অপেক্ষাকৃত ভারী পরমাণুগুলোর গতিবেগ কম হওয়ায় তারা বাঁধা পড়ে থাকে বায়ুমণ্ডলে। ফলে বাতাসের প্রায় ৯৯ শতাংশ তৈরি তাদের দিয়ে। আর মহাবিশ্বজুড়ে প্রাচুর্য থাকার পরও বায়ুমণ্ডলে খুব কম দেখা মেলে হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের।
এবার একটা প্রচলিত ভুল ধারণা দূর করা যাক। পৃথিবীর আকর্ষণ কাটিয়ে বাইরে যেতে হলে সব সময় যে মুক্তিবেগের সমান বা এর চেয়ে বেশি বেগে যাত্রা করতে হবে, তা নয়। যদি যাত্রা করার পরে আলাদাভাবে ত্বরণ প্রয়োগের কোনো সুযোগ না থাকে, তাহলে কেবল এটি সত্য হবে। বল ছুড়ে মারার উদাহরণের কথা আরেকবার ভাবুন। বল হাত থেকে ছুটে যাওয়ার পর এর গতিবেগ ক্রমাগত কমতে থাকে। চাইলেও এ সময়ে ত্বরণ প্রয়োগ করে গতিবেগ বাড়ানোর কোনো উপায় নেই। তাই পৃথিবীর গ্র্যাভিটি ফাঁকি দিতে হলে অবশ্যই বলটিকে ১১ দশমিক ২ কিলোমিটার/সেকেন্ড বেগে যাত্রা আরম্ভ করতে হবে। তবে যদি কোনোভাবে এর ওপরে বল প্রয়োগের মাধ্যমে ত্বরণ সৃষ্টি করা যায়, তাহলে অনেক কম বেগে যাত্রা করেও মহাশূন্যে পৌঁছানো সম্ভব। ঠিক এই কৌশল কাজে লাগানো হয় রকেটগুলোয়।
সূর্যের চারদিকে পরিভ্রমণের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী নিজের অক্ষের ওপরও ঘুরপাক খায়। একে কাজে লাগিয়ে চাইলে আমরা মুক্তিবেগের মান কমবেশি করতে পারি। যদি মহাশূন্যে যাওয়ার জন্য আমরা পৃথিবীর ঘূর্ণনের দিকের সঙ্গে মিল রেখে একই দিকে যাত্রা করি, তাহলে মুক্তিবেগের মান কমে যাবে। আর পৃথিবীর ঘূর্ণনের বিপরীত দিকে যাত্রা করলে ঘটবে উল্টো ঘটনা। এ পদ্ধতিতে মুক্তিবেগের মান ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমবেশি করা যায়। বিষুবরেখার কাছে পৃথিবীর নিজ অক্ষের ওপরে ঘূর্ণন বেগের মান সবচেয়ে বেশি থাকে। ফলে এ অঞ্চল থেকে যাত্রা করলে মুক্তিবেগ কমানোর সর্বোচ্চ সুবিধা নেওয়া যায়। তাই বিশ্বের বেশির ভাগ রকেট উৎক্ষেপণের ফ্যাসিলিটির অবস্থান এখানে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।